.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

আন্তন চেখভের ছয়টি গল্প, ভাষান্তর: সুশান্ত বর্মণ

আন্তন চেখভ - ছয়টি গল্প, ভাষান্তর: সুশান্ত বর্মণ

আন্তন চেখভের ছয়টি গল্প

ভাষান্তর: সুশান্ত বর্মণ

অমর গল্পকার আন্তন চেখভ ১৮৮৯ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে দুইশতটিরও অধিক গল্প লিখেছিলেন। এই গল্পগুলো প্রকাশিত হয়েছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ এবং মস্কোর রুশ ভাষার কয়েকটি সাময়িকপত্রে। কিন্তু কখনো ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয় নি। 'উপন্যাসে যা পাবেন' গল্পটি রুশ থেকে প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করেন কানাডাবাসী রুশ ভাষার শিক্ষক, অনুবাদক পিটার সেকেরিন। বাকী গল্পগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেন নিউইয়র্কবাসী লেখক ও অনুবাদক ইলিনা অল্টার। বিন্দুর পাঠকদের জন্য এই ছয়টি গল্প বাঙলায় অনুবাদ করলেন সুশান্ত বর্মণ, যিনি একজন প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সম্পাদক।
বিন্দু। বাংলা ভাষার লিটল ম্যাগাজিন।

উপন্যাসে যা পাবেন

এক ডিউক, তার অল্পবয়সী সুন্দরী স্ত্রী, পাশের বাড়িতে থাকা ব্যারন, একজন বামপন্থী ঔপন্যাসিক, এক দরিদ্র অভিজাত পুরুষ, এক বিদেশী গীতিকার, বেশ কয়েকজন বোকা খানসামা, এক জার্মান ব্যবস্থাপক, এক ভদ্রলোক এবং আমেরিকা থেকে আসা একজন উত্তরাধিকারী।

এদের কেউই উল্লেখযোগ্য নয়, তবুও তারা সহানুভূতিশীল এবং আকর্ষণীয় মানুষ। এক পাগলা ঘোড়ার কবল থেকে নায়িকাকে রক্ষা করে নায়ক, সে প্রবল উদ্যোমী আর সুযোগ পেলেই শক্তি প্রয়োগ করে।

বিস্তৃত আকাশ, সুদূরপ্রসারী আর অপার দৃশ্যপট, এত উদার যে তাকে বোঝা সহজ নয়। সংক্ষেপে এটাই প্রকৃতি।

বন্ধুরা প্রশান্ত, শত্রুরা বিদ্বেষী, একজন ধনী চাচা, অবস্থার ফেরে উদার অথবা রক্ষণশীল, প্রধান চরিত্রের কাছে তার উপদেশের চেয়ে মৃত্যুই বেশি কাম্য।

দূরের শহর টমবভে বাস করা কাকী। আন্তরিক মুখাবয়বের একজন ডাক্তার, যিনি অসুস্থদের আশা দেন। তিনি টেকো, আর তার পথ চলার জন্য একটি গোলমাথাওয়ালা লাঠি আছে।

আর, যেখানে ডাক্তার আছে, সেখানে রোগ থাকবেই। অতিরিক্ত কাজের জন্য হাড়ের ব্যাথা, মাথাব্যাথা, মানসিক বিভ্রান্তি। একজন মানুষ ডুয়েল লড়াইয়ে আহত হয়েছেন, আর তাকে গরম বাষ্পের স্নান নিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

একজন চাকর, যে তার বুড়ো প্রভুর কাজ করে এবং তার জন্য জীবনের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। সে খুব মজার চরিত্র।

কাকাতুয়া আর নাইটিঙ্গেল পাখির মত কথা বলা ছাড়া সব কাজে পারদর্শী এক কুকুর। মস্কোর কাছাকাছি এক গ্রামীণ বাড়ি, আর দক্ষিণের কোথাও থাকা এক বন্ধকী সম্পত্তি।

বিদ্যুৎ, যা গল্পের গায়ে কোন কারণ ছাড়াই জড়িয়ে আছে।

রাশিয়ার চামড়া দিয়ে তৈরি একটি ব্যাগ, জাপান থেকে আসা একটি চাইনীজ ডিনার সেট, ইংল্যান্ডের চামড়া দিয়ে তৈরি ঘোড়ার স্যাডল, একটি নিখুঁত রিভলভার, ভাঁজ করা কাপড়ের স্তুপ এবং চিংড়ি, মাশরুম, শ্যাম্পেন ও আনারসের এক মহাভোজ।

আড়িপেতে শোনা সূত্র থেকে পাওয়া কোন এক দারুণ আবিষ্কার।

অসংখ্য আবেগপ্রবণ শব্দাবলী, আর যেখানে সম্ভব সেখানেই জটিল শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা।

গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা সম্পর্কে স্বল্প পরামর্শ। প্রায় কোন উপসংহার থাকে না।

শুরুতে সাতটি ক্ষয়িষ্ণু পাপ এবং শেষে শুভ পরিণয় অর্থাৎ বিবাহ।

সমাপ্তি


কোনটা আরও ভাল

বয়স্ক ও শিশু উভয়ই শুড়িখানায় যেতে পারে, কিন্তু স্কুলে যায় শুধু শিশুরাই।

মদ হজমে সাহায্য করে, চর্বি জমায়, হৃদয়ে আনন্দ নিয়ে আসে। স্কুল এর কোনটাই করতে সক্ষম নয়। লোমোনোসভ বলেছেন- “বিজ্ঞান তারুণ্যকে সমৃদ্ধ করে, প্রবীণের দানকে দেয় মহিমা।" কিন্তু মহান ভ্লাদিমির প্রায়ই বলেন- “রুশদের আনন্দ পান করাতে।" কোনটা যে বিশ্বাস করি? নিশ্চয় পুরনোটাই।

স্কুল থেকে ট্যাক্স আসে না।

রেনেশাঁস থেকে আসা সচেতনতার ব্যবহার এখনও প্রতিষ্ঠিত না। কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব স্পষ্ট। পিপাসা কোন ডিগ্রি নয় এক চুমুক ভদকা চায়।

সব জায়গায় পানশালা আছে, কিন্তু সবখানে স্কুল নেই।

এতসবকিছু এই সিদ্ধান্তে আসার জন্য যথেষ্ট যে পানশালা বিলুপ্ত করা উচিত হবে না। কিন্তু স্কুলের মূল্যায়ন পুনর্বিবেচনাযোগ্য।

শিক্ষিত হওয়াকে একেবারে বাতিল করা যাবে না। সেটা পাগলামো হবে। মানুষ যেন অন্তত পানশালার নাম পড়তে পারে।


একের ভিতরে দুই

সেই খুনী জুডাস বা বর্ণচোরা চ্যামেলিয়নদের বিশ্বাস করবেন না। আমাদের সময়ে হাতমোজা হারানোর চেয়ে বিশ্বাস হারানো সহজ – এবং আমি তাই হারিয়েছি।

সেই সন্ধ্যাবেলা, আমি ঘোড়ার গাড়িতে চড়েছিলাম। একজন বড়সড়ো কর্মকর্তা হিসেবে এটা ঠিক ছিল না। কিন্তু এই ঘটনার সময়ে আমি উলের বড় কোট পড়েছিলাম আর সেটার মারটিন কলার দিয়ে মুখ ঢেকেছিলাম। জানেন তো এটা সস্তা, এছাড়া আবহাওয়া ঠাণ্ডা ও শেষ ট্রিপ হলেও গাড়িটি ভর্তি ছিল। কেউ আমাকে চিনতে পারেনি। মার্টিন কলারটি আমাকে ছদ্মবেশে ভ্রমণ করতে সাহায্য করেছে।

যেতে যেতে আমি খর্বাকৃতির লোকটিকে পর্যবেক্ষণ করে অবাক হয়েছিলাম। আমি ভাবলাম "না, ইনি সেই ব্যক্তি নন।" খরগোশের লোমের কোট পরা বেঁটে লোকটির দিকে এক দৃষ্টিতে থাকিয়ে থেকে তাকে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। ইনি কি সেই ব্যক্তি? না, ইনি তিনি নন। আমি ভালভাবে দেখেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

খরগোশের লোমের কোট পরা খাটো লোকটি একেবারে আমার কেরানীদের একজন ইভান কাপিটোনিচ এর মত দেখতে। ইভান কাপিটোনিচ ছোটখাট, কিংকর্তৃব্যবিমূঢ়, চুপচাপ প্রকৃতির। শুধু পড়ে যাওয়া রুমাল তুলতে এবং সালাম জানানোর সময় তার অস্তিত্ব বোঝা যায়। সে তরুণ, কিন্তু তার পিঠ অবনত, হাঁটুগুলো ভাঁজ করা, হাত নোংরা, বাহু টানটান যখন সে সচেতন থাকে…তার মুখাবয়ব দেখতে এমন, যেন দরজায় সজোরে ধাক্কা খেয়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। সেটা এতটাই বিষন্ন এবং করুণাপ্রত্যাশী যে তার দিকে তাকিয়ে যে কেউ ফুঁপিয়ে শোকগীতি গাওয়া শুরু করে দেবে। আমার মুখোমুখি হলেই সে কাঁপতে কাঁপতে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। যেন আমি তাকে খেয়ে ফেলব অথবা খুন করব। আর যখন তাকে তিরস্কার করি, তখন সে স্থির হয়ে যায়, আর তার শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাঁপতে থাকে। আমি তার মত সাদামাটা, বিনত এবং নগণ্য আর কাউকে পাইনি। এমনকী তার চেয়ে নির্বিরোধী কোন প্রাণীর কথাও আমি জানিনা।

খরগোশের লোমের কোট পরা ছোটখাট লোকটি এই ইভান কাপিটোনিচের কথা বিশেষভাবে মনে করিয়ে দিল। শুধু এই মানুষটি তার মত অতটা বিনীত নয়, অমন হতবুদ্ধি মনে হচ্ছে না। নিজেকে খোলামেলাভাবেই তুলে ধরছেন আর সবচেয়ে বিরক্তিকর হল তিনি পাশের লোকটির সাথে রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন। গাড়ির সবাইকে তা শুনতে হচ্ছে।

“গামবেট্টা বাজে কথা বলেন” - তিনি হাত নাড়াতে নাড়াতে বলছেন। "এটা অবশ্য বিসমার্কের জন্য ভালই হয়েছে। গামবেট্টা নিজের অবস্থান বোঝেন। তিনি জার্মানদের সাথে যুদ্ধে গিয়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইভান মাটভিচকে নিয়ে আসতে পারতেন। এটা দারুণ হত, তাই না? তিনি রাশিয়ার আত্মাবাহী একজন ফরাসী। কী মেধাবী একজন মানুষ!”

উফ! কী অবিশ্বাস্য নোংরামী!

যখন কন্ডাক্টর টিকেট চাইল, তখন তিনি বিসমার্ককে ছেড়ে দিলেন। "বাসের ভিতরটা এত অন্ধকার হওয়ার কোন কারণ আছে কি?” - কন্ডাক্টরের দিকে চেয়ে বললেন। "তোমাদের সাথে জ্বালাবার মত কোন মোমবাতিও কি নেই? কী বোকামী? এটা খুবই খারাপ যে তোমাদেরকে এসব শেখানোর মত কেউ নেই। অন্য দেশ হলে এসব শিখতে। তোমরাই জনগণের সেবা করছো, জনগণ তোমাদের সেবা করে না। শয়তানের দল। কিছুই বোঝে না। এখানে দায়িত্বরত কে?”

কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি আমাদেরকে সরে যাওয়ার দাবী তুললেন। "সরে যান! যা বলা হচ্ছে, তা করুন! ম্যাডামকে একটি সীট দিন। কিছুতো ভদ্রতা দেখান। কন্ডাক্টর, এই কন্ডাক্টর। তুমি ভাড়া নিয়েছো, এখন একটা সীট দাও। এটা অশোভন।"

“এখানে ধূমপান করা নিষেধ!” কন্ডাক্টর তাকে চীৎকার করে ধমক দিল।

“কে নিষেধ করেছে? কার সেই অধিকার আছে? এটা স্বাধীনতার বরখেলাপ। আমি কাউকে আমার স্বাধীনতা আটকানোর অধিকার দেইনি। আমি একজন মুক্ত মানুষ।"

ওহ! কী অবিশ্বাস্য উদ্ভট! তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। না, এটা সে নয়। হতে পারে না। সেই লোকটি স্বাধীনতা বা গামবেট্টা শব্দগুলোই তো জানে না।

সিগারেটটা ফেলতে ফেলতে সে বলল – "আমাদের কত সুন্দর প্রথা ছিল। আর এখন এসব মানুষের সাথে থাকতে হচ্ছে। এরা আইন ও কাঠামোর জন্য একেবারে পাগল। সংকীর্ণমনা, আচারনিষ্ঠ! দম বন্ধ হয়ে আসছে।"

আমি হাসি থামাতে পারলাম না। হাসি শুনে সে আমার দিকে বাঁকাভাবে তাকাল। তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল। সে আমার হাসিকে চিনতে পেরেছে। হয়ত আমার কোটটিকেও। তার পিঠ সঙ্গে সঙ্গে বাঁকা হয়ে গেল, মুখাবয়ব ফ্যাকাসে হয়ে গেল, কণ্ঠ থেমে গেল, হাত স্থির ও হাঁটু বাঁকা হয়ে গেল। কী তাৎক্ষণিক পরিবর্তন‍! আমার আর কোন সন্দেহ নেই। এটাই ইভান কাপিটোনিচ, আমার কেরানী।

সে বসে পড়ল ও খরগোসের লোম দিয়ে নিজের নাক ঢেকে ফেলল। এবার আমি তার মুখের দিকে তাকালাম।

"এটা কী হতে পারে”, আমি ভাবলাম- এই অপগণ্ড, বিনীত লোকটি 'সংকীর্ণতা', ‘স্বাধীনতা' শব্দগুলোর কথা কীভাবে বলে? সত্যিই? এটা কী হতে পারে। হ্যাঁ, সে জানে, এটা অস্বাভাবিক, কিন্তু সত্য। ওহ! কী অবিশ্বাস্য উদ্ভট!

এতকিছুর পর, বিশ্বাস করুন, এই বর্ণচোরাদের বাহ্যিক গঠন বিচার করার জন্য দুঃখিত! আমার আর কোন বিশ্বাস নেই। একবারই ঠকেছি।


আত্মা নিয়ে কয়েকটি ভাবনা

একজন বিদ্বান শিক্ষক ও তার স্ত্রীর মতে, আত্মা হল মানসিক অবস্থার একটি অবোধ্য সত্তা। এর সাথে দ্বিমত করার কোন কারণ আমার নেই।

এক পণ্ডিত লিখেছেন- “আত্মা আবিষ্কার করতে একজন মানুষের পোষাক খুলে ফেলে তার পা বেল্ট দিয়ে বাঁধ। এরপর পায়ের গোড়ালিতে আঘাত কর। এবার যা খুঁজছ, তা পাবে।"

আমি আত্মার পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি। অভিজ্ঞতা থেকে এই বিশ্বাস পেয়েছি। আমার নিজের আত্মা আমার পার্থিব ভোগান্তির কালে অনেক প্রাণী ও বৃক্ষের হৃদয় পরিভ্রমণ করেছে এবং গৌতম বুদ্ধ যে জগৎ ও পর্যায়ের কথা বলেছেন তার সবগুলোর অভিঘাত সহ্য করেছে।

যখন জন্মেছিলাম তখন ছিলাম এক কুকুরছানা। যখন জীবনযাত্রায় ঢুকলাম তখন ছিলাম রাজহাঁস। সরকারী চাকুরীতে ঢুকে হয়ে গেলাম এক গোলআলু। বস আমাকে কঠিন হৃদয়ের তেজস্বী ব্যক্তি বলে মনে করেন, বন্ধুরা মনে করে গর্দভ, মুক্তচিন্তকরা মনে করে আমি একটা ভেড়া। যখন রেলপথ ধরে একা হেঁটে যাই তখন নিজেকে খরগোশ মনে হয়, গ্রামে বাস করি গেঁয়ো কৃষক হয়ে, আর নিজেকে আমি অনুভব করি একটি জোঁক হিসেবে। কোন এক তহবিল তছরূপের ঘটনায় আমি ছিলাম বলির পাঁঠা, বিয়ে করে হয়েছি শিংযুক্ত গরু। পরিশেষে খুব বাস্তব হল, আমি পেয়েছি একটি স্ফীত ভূড়ি এবং পরিণত হয়েছি এক সফল শুকরে। (১)

(১) ‘সফল শুকর' বা "সত্যের সাথে শুকরের আলাপ" হল ১৮৮১ সালে মিখাইল সাল্টিকভ-সেনড্রিন এর এক নাটকের দৃশ্য যেখানে সত্য শুকরের সাথে আলাপন শেষে খাদ্যে পরিণত হয়।


সংগ্রহ

সেই দিন সাংবাদিক বন্ধু মিশা কভরভের সাথে দেখা করার জন্য থেমেছিলাম। সে সোফাতে বসে নখ পরিষ্কার করতে করতে চা খাচ্ছিল। সে আমাকে এক কাপ চা দিয়ে আপ্যায়ন করল।

“আমি পাউরুটি ছাড়া চা খাই না।" আমি বললাম। "আমাকে পাউরুটি দেয়া হোক।”

“শর্তহীনভাবে! আমি বরং শত্রুকে পাউরুটি দেব, কিন্তু কোন বন্ধুকে না।”

“এ তো অদ্ভুত। কেন নয়?”

“এই কারণে। এইদিকে এসো।”

মিশা আমাকে টেবিলের কাছে নিয়ে গেল এবং একটি ড্রয়ার টান দিয়ে খুলল।

“দেখো”

আমি ড্রয়ারের দিকে তাকিয়ে বিশেষ কিছু দেখতে পেলাম না।

“আমি কিছুই দেখছিনা… কী সব ছাইপাঁশ… পেরেক, কাপড়ের টুকরো আর কয়েকটা ইঁদুরের লেজ…”

“ঠিক, ওইসব দেখো। আমি দশ বৎসর ধরে এই পেরেক, ন্যাকড়াগুলো জমাচ্ছি! এটা এক বিশেষ সংগ্রহ।”

মিশা ওই আবর্জনাগুলোকে জড়ো করে খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে নাড়াতে লাগল।

“এই পোড়া দেশলাইয়ের বাক্সটি দেখেছো?” একটা সাধারণ অর্ধদগ্ধ ম্যাচবক্স দেখিয়ে সে বলল। "এটা একটা মজার ম্যাচ। গত বৎসর সেভাসটিনভের বেকারী থেকে কেনা বারনকা কেকের মধ্যে এটাকে পেয়েছি। গলায় আটকে দমবন্ধ হতে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস পিঠে আঘাত করার জন্য বউ বাড়িতে ছিল। নাহলে এই ম্যাচ আমার গলায় আটকে যেত। এই নখটি দেখেছো? তিন বৎসর আগে ফিলিপভের বেকারী থেকে কেনা স্পঞ্জ কেকের ভিতরে এটাকে পেয়েছি। হাত পায়ের স্পর্শ ছাড়া এই স্পঞ্জ কেক তৈরি হয়, তুমি বুঝতে পারছো, তার মধ্যে এই নখ ছিল। এ এক খাপছাড়া অবস্থা। পাঁচ বৎসর আগে মস্কোর সেরা দোকান থেকে কেনা সসেজের মধ্যে এই সবুজ টুকরোটা গেঁথে বসেছিল। এই সিগারেটের মুড়োটা রেলস্টেশনের কাউন্টারে বসে খাবার সময় বাঁধাকপির স্টু'র মধ্যে ছিল। এই পেরেকটি পেয়েছি একই স্টেশনের এক মাংসের কাবাবে। এই ইঁদুরের লেজ ও আঁচলের টুকরো পেয়েছি একটিমাত্র ফিলিপোভ পাউরুটিতে। এই ছোট মাছটি, যার শুধু কাঁটা অবশিষ্ট আছে, আমার স্ত্রী একটি স্পেশাল কেকের ভিতরে পেয়েছে। সেই কেকটি তাকে উপহার দেয়া হয়েছিল। এই প্রাণী, যার নাম ছারপোকা, পেয়েছিলাম জার্মানীর এক বিখ্যাত দোকানের মগভর্তি বিয়ারের মধ্যে। আর এই একটুকরো পক্ষীমল এক অবকাশযাপন কেন্দ্রের রেস্তোরায় বসে একটি সুস্বাদু পাইয়ের টুকরোর সাথে প্রায় গিলে ফেলেছিলাম। আর বাকীগুলোর ঘটনাও প্রায় একইরকম বন্ধু।

“কী এক বিস্ময়কর সংগ্রহ!”

“হ্যাঁ, এসবের ওজন হয়ত দেড় পাউন্ড হবে, সবকিছু হিসেব না করেই আমি অসাবধানে কত কী যে গিলে হজম করে ফেলেছি। হয়ত পাঁচ বা ছয় পাউন্ড তো হবেই।

মিশা আলগোছে খবরের কাগজটি তুলল, সাবধানে তার সংগ্রহ মুড়িয়ে আবার ড্রয়ারে রেখে দিল।

আমি কাপটি হাতে তুলে নিলাম, চা খাওয়া শুরু করলাম। পাউরুটির কথা আর তোলাই হল না।


প্রকট বাতিকের কাহিনী

সভ্যতা, তার উপকারের পাশাপাশি মানবতারও কিছু ভয়ানক ক্ষতি করেছে। এতে কারও সন্দেহ নেই।

ডাক্তাররা এই প্রসঙ্গে একেবারে অনড়। গত কয়েক দশকের পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত স্নায়বিক দৌর্বল্যের উৎস হিসেবে যা চিহ্নিত হচ্ছে তা একেবারে অকারণে না। কী আমেরিকা কী ইউরোপ, সবখানে একই রকমের মানসিক অসুস্থতা দেখা যাচ্ছে। শুরু হয় সাধারণ স্নায়ুশূল দিয়ে, যা পরিণত হয় হয় ভয়ংকর মনোব্যাধিতে। আমি নিজে বেশ কয়েকটি প্রবল মনোরোগের ঘটনা দেখেছি, যার কারণ পাওয়া যাবে শুধুমাত্র সভ্যতায়।

আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন, প্রাক্তন পুলিশ কমিশনারকে জানি। 'সমাবেশ অবৈধ' করা উচিত, এমন ভাবনায় তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। অতএব, যেহেতু একাধিক মানুষের বৈঠক বা সমাবেশ নিষিদ্ধ, সেহেতু তিনি তার বনজ সম্পত্তি ধ্বংস করে ফেলেছেন, পরিবারের সাথে খাবার খেতেন না, কৃষকদের গবাদিপশু নিজের জমিতে ঢুকতে দিতেন না ইত্যাদি। একদিন যখন তাকে ভোট দিতে ডাকা হল তিনি অবাক হয়ে চীৎকার করে বললেন “জনসমাবেশ যে অবৈধ তা কি তোমরা জানোনা?”

একজন অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট, যাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল সততা বা দূর্নীতির জন্য (আমার সঠিক মনে নেই)। কাউকে বন্দী করা বিষয়ে বিবেচনাবোধ হারিয়ে ফেলেছিলেন।

তিনি বাক্সের ভিতরে বিড়াল, কুকুর ও মুরগী আটকাতেন আর পূর্বনির্ধারিত সময় পর্যন্ত বন্দী করে রাখতেন। তিনি তেলাপোকা, ছাড়পোকা আর মাকড়সাদেরও বোতলবন্দীর রায় দিতেন।

যখন তার হাতে টাকা আসত, তখন পাশের গ্রামে গিয়ে গ্রেফতার হতে ইচ্ছুক কাউকে ভাড়া করতেন। তিনি বলতেন- “তোমাকে আটকেছি সোনা। হারাবার কীইবা আছে তোমার? তোমাকে আমি ছেড়ে দেব। কিছু কৃতিত্ব তো আমাকে দাও।”

কোন স্বেচ্ছাসেবী পেলে, তাকে বন্দী করতেন, দিন রাত পাহারা দিতেন, আর মেয়াদ শেষ হবার আগে মুক্তি দিতেন না।

আমার কাকা, ছিলেন কোয়ার্টারমাস্টার, খেতেন পঁচা পাউরুটির গুড়ো, আর জুতায় লাগাতেন কার্ডবোর্ডের সুখতলি। যে চাকররা তাকে অনুসরণ করতো, তাদেরকে তিনি উদারহস্তে পুরস্কৃত করতেন।

আমার কর-সংগ্রাহক শ্যালক, “সংস্কার খারাপ”- এই ধারণা সম্বন্ধে ক্ষ্যাপাটে ছিলেন। কিছুদিন আগে চাঁদাবাজির কারণে পত্রিকায় নিন্দিত হয়েছিলেন। তার মাথায় গণ্ডগোলের এটাই হয়ে গেল প্রাথমিক ভাষ্য। তিনি মস্কোর সবগুলো পত্রিকার গ্রাহক হলেন, পড়ার জন্য না। প্রত্যেক সংখ্যায় তিনি মর্যাদাহানিকর খবর খুঁজতেন। এরকম কিছু পেলে হাতে রঙিন পেন্সিল তুলে নিয়ে সেগুলো চিহ্নিত করতেন। গোটা পত্রিকায় দাগ দিয়ে তিনি সিগারেটের কাগজ হিসেবে কোচম্যানের হাতে তুলে দিতেন। আর পরবর্তী সংখ্যা না আসা পর্যন্ত বেশ শান্তি অনুভব করতেন।

মন্তব্য

BLOGGER: 5
  1. ঝরঝরে অনুবাদ। ভালো লাগলো পড়ে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ, চেষ্টা করেছি মাত্র৷ সকল প্রশংসা সম্পাদকের৷

      মুছুন
  2. গল্পগুলো আগে পড়িনি৷ ভাল লাগলো

    উত্তরমুছুন
  3. আমি এই স্বাদের গল্প আগে পড়িনি। দারুণ অনুভূতি। অনুবাদক চমৎকার কাজ করেছেন। পড়তে ক্লান্তি লাগেনি।

    উত্তরমুছুন
  4. সাবলীল ও অনিবার্য

    উত্তরমুছুন
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,25,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: আন্তন চেখভের ছয়টি গল্প, ভাষান্তর: সুশান্ত বর্মণ
আন্তন চেখভের ছয়টি গল্প, ভাষান্তর: সুশান্ত বর্মণ
আন্তন চেখভের ছয়টি ছোটগল্প বাঙলায় অনুবাদ করেছেন সুশান্ত বর্মণ। আন্তন চেখভ ১৮৮৯ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে দুইশতটিরও অধিক গল্প লিখেছিলেন।
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEhFJfzdohVGnM5-DrbqNmsQ5EmZlJyOZZlXyuLzNxWxq99972xbh7Sxv1O-7W64-nzYisg9NGzzKUpCRU_Ca3919Qs12BLDrJkKp5-moeGZNvAPlMncxHKehbl5biVwuECWKhRQtPel0nv_Y-frdrB_uRnjJxhP6HwFl83O9bVDhLIs0sDw-QpseFoY=w320-h180
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEhFJfzdohVGnM5-DrbqNmsQ5EmZlJyOZZlXyuLzNxWxq99972xbh7Sxv1O-7W64-nzYisg9NGzzKUpCRU_Ca3919Qs12BLDrJkKp5-moeGZNvAPlMncxHKehbl5biVwuECWKhRQtPel0nv_Y-frdrB_uRnjJxhP6HwFl83O9bVDhLIs0sDw-QpseFoY=s72-w320-c-h180
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2021/11/anton-chekhov-short-story-bengali-susanta-barman.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2021/11/anton-chekhov-short-story-bengali-susanta-barman.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy