.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : জিয়াউল আহসান

আশির গল্পকারদের আরেক দিকপাল সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। অক্লান্ত লেখনী এবং বিষয় বৈচিত্র্যে অনন্য। আশির বিপ্লবী যুবকদের অনেকেই জীবন -ব্রহ্মাণ্ডে লীন হয়েছেন। কারো চ্যুতি ঘটেছে, কেউ কেউ ইহজগৎ ছেড়েছেন; কিন্তু সৈয়দ রিয়াজের সত্তা এখনো অক্লান্ত-দ্রোহী। দীর্ঘ শীতঘুমের পর কেউ কেউ ফিরেছেন গতি-ন্যুব্জতায়। সৈয়দ রিয়াজের বৈশিষ্ট" তিনি বিরতিহীন ক্ষুদ্ধ, নিরাপসী, মেজাজী, সরব সোচ্চার। দ্রোহ তার মগজে, মননে, সত্তায়। সাহিত্য তার শোণিতে প্রবাহিত। এই অঙ্গীকারাবোধ প্রতিফলিত তার নিরীক্ষাধর্মীতায়। নিরীক্ষাধর্মীতা তাঁর লেখার অনন্যতার নির্দেশক। নিরীক্ষাধর্মীতার বন্ধুর-কন্টকাকীর্ণ-নিঃসঙ্গ পথে স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যে কখনো আশ্রয় করে খেয়ালীপনা, ভাঙ্গা-গড়ার দুর্দম চালচিত্র, উদ্দাম গতিময়তা - কখনো শব্দ, কখনো বাক্য, কখনো  কাহিনী তৈরির বহমান ব্যাকরণ ভেঙ্গে যে স্বাতন্ত্রিকতায় উদ্ভাষিত হন সেখানে তিনি হয়ে ওঠেন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বি। কখনো পাঠক তার সাথে পথ চলে, কখনো তিনি পরিণত হন পথিক-পথিকৃৎ। সমগ্র স্বাভাবিকতা দুমড়ে-মুচড়ে তথা প্রথা অস্বীকারের মানসিকতায় যে বোধে উন্নীত হন তারই যন্ত্রণাকাতর প্রতিফলন তার গল্পের ছত্রে ছত্রে। এবং রিয়াজুর রশীদ অনন্য হয়ে ওঠেন। সৈয়দ রিয়াজের এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের গল্পগুলো পৃথকভাবে আলোচনার দাবী রাখে।

আশির দশকের মাঝামাঝি তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে যখন তিনি কলম ধরেন, তখন বিশ্বে তত্ত্বের জোয়ার বইছে। কার জন্যে কোনটা উপযুক্ত, কে কোনটা বেছে নেবে, নন্দনতত্ত্বের ব্যাখ্যাদান চলছে, উত্তরাধুনিকতা সদ্য অবতরণ করেছে, পুঁজিবাদ-সাম্যবাদ মুখোমুখি
এবং লাতিন সাহিত্যের ধাক্কা এবং ইত্যাকার আরো বিষয় – এই হলো প্রেক্ষিত। ছোট - কাগজে নিয়মিত প্রায় একযুগের নির্মোহ-সংগ্রামী সাহিত্যচর্চার পর্যায়ে ১৯৯৪-এর বইমেলায় প্রকাশিত হয় দুই মলাটের ভেতর প্রথম বিস্ফোরণ 'আগুনের বিপদ আপদ'। মেজাজের সাথে সঙ্গতি রেখেই তাবৎ অস্বীকারের প্রেক্ষাপটে তিনি ঘোষণা করেন - 'লেখক ও প্রকাশক উভয়ই এই গ্রন্থের কোনো প্রকার আলোচনা আবশ্যক মনে করে না।' 'আগুনের বিপদ আপদ'-এর গল্পগুলো যা-ই হোক না কেন, তাঁর এই বীর্যবান কণ্ঠ চমকিত করে। এটা সৈয়দ রিয়াজের সাথে বিশেষভাবে যায়। একমাত্র তিনিই বলতে পারেন, স্রষ্টার সমালোচনা হয় না। কেউ মানুক, কি না মানুক, তাতে কিছু যায় আসে না। স্রষ্টার সমালোচনায় জ্ঞান তথা যোগ্যতা ও ধীশক্তি এবং ব্যাপক পঠন-পাঠনের মাধ্যমে স্থান-কাল-পাত্রভেদে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের ক্ষমতা অপরিহার্য। তথাকথিত পারিতোষিক- ভূক-গতানুগতিক-স্বজাহির-অনুরোধালোচনা-পিচ্ছিল পর্যালোচনার মহামারী সাহিত্যকে যে পঙ্কিলতায় আকীর্ণ করেছে স্বজ্ঞান-অবহিত পাঠক মাত্রই জ্ঞাত। এবং সৈয়দ রিয়াজ এ বিষয়ে সচেতন। এই গ্রন্থে (আগুনের বিপদ আপদ) সন্নিবেশিত দশটি গল্পের অন্যতম "মারণ দাঁত" মুক্তিযুদ্ধের গল্প এবং লেখকের তৃতীয় গ্রন্থ 'লাশ নাই'তে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
'লাশ নাই' মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। এরপর আমাদের হাতে আসে 'শাদা কাহিনী' (১৯৯৬) রিয়াজুর রশীদের প্রথম গ্রন্থের শিল্পী-সত্তার স্ফুরণ-উপস্থাপন ও বিকাশ 'শাদা কাহিনী'তে আরও পরিণত, খোলস খুলে বেরিয়ে আসা এবং স্পষ্টত বিবর্তনমুখী। 'আগুনের বিপদ আপদ'এর পর লেখক প্রচলিত কোনো ফর্মকেই ধারণ করেননি। কিংবা অন্যকথায় বলা যায়, কোনো ফর্মকেই আস্ত রাখেননি। প্রথম গ্রন্থে যে সুখ-পাঠ ছিলো, বর্ণনা-বাচনে প্রেক্ষিত -চিত্র আঁকার যে ভঙ্গী ছিলো পরবর্তীতে তিনি তা থেকে বেরিয়ে আসেন। ছোট কাগজের গল্পকারদের এটা নিয়তি। তাঁর ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় ঘটেনি।

'আগুনের বিপদ আপদ'-এ দশটি গল্পের ভেতর 'অলৌকিক সংবাদ', 'বস্ত্রহীন প্রতিবিম্ব', 'আক্রন্দন হৃৎ-যাত্রা', 'চোখ বিষয়ে', 'মারণদাত' এবং 'আগুনের বিপদ আপদ' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 'অলৌকিক সংবাদ' মাজার তথা ধর্ম ব্যবসায়ীদের অন্ধকার কাহিনী। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের গল্পের ছায়া অবলম্বণে সাধারণ কাহিনী হলেও 'বস্ত্রহীন প্রতিবিম্ব' সুখপাঠ্য ঝরঝরে গতিময় প্রহসন। অসাধারণত্ব আমাদের বাস্তবতায় এর অভিযোজন এবং আবেদন, যা হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যে সর্বজনীন। 'আক্রন্দন হৃৎ-যাত্রা' স্বগত সংলাপ সমৃদ্ধ এবং পরবর্তীকালের রিয়াজুর রশীদের লেখার পরিচয়বাহী। হাসিব নামের এক চরিত্রের অন্তরালে সম্ভবত লেখক নিজেকেই প্রত্যক্ষ করেন। জন্ম-মৃত্যু তথা এই ধরাধামে আগমন ও প্রত্যাবর্তনের মাঝে মানুষ নামের প্রাণী ধীরে ধীরে কীভাবে সমাজ নামের আপেক্ষিক বন্ধনে ধর্ম-সম্প্রদায়ের জালে জড়িয়ে পড়ে তা ক্রমান্বয়ে মূর্ত হয়েছে এই গল্পে। সমাজকে ব্যবচ্ছেদ করা - শুরুর পর্যায়ে লেখকের নিরীক্ষাধর্মীতার অনন্য দৃষ্টান্ত -এবং আপাতসত্যের সাবলীল ঘোষণা তাঁর কল্পনাশক্তির দাঢ্যতার পরিচয়। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের চিন্তা-চেতনা বাস্তবতা উপলব্ধির যৌগিক বিশ্লেষণ। লেখক কয়েকভাবেই দেখার চেষ্টা করেছেন সমাজে অনুচ্চারিত আমাদের অন্ধত্ব, বিশ্বাস, প্রথা, আচার-আচরণ (বিশেষভাবে অলসতা) তথা অন্তঃস্থলে লুকায়িত কার্যকর কর্মবিমুখতার অস্পষ্ট চিত্র মেলে গল্পটিতে। এ জাতির সমাজ-সংস্কার অনেক কিছুই মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। কিন্তু 'না বলা কথা', 'লেখকের উদ্দেশ্য' তথা ‘মনোস্পৃহা' ইত্যাদি মিলিয়ে একটি জটিল গল্পের অবতারণা ঘটেছে। অবশ্যই বলতে হবে, গল্পের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত।
নাগরিক জীবন কোনো সম্পূর্ণতার সন্ধান দেয় না। আমাদের প্রাত্যহিক জীবন বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের সমষ্টি বা একটি থেকে আরেকটিতে উল্লম্ফন। যেনো নির্দিষ্ট সময়ান্তে বা ঘটনার প্রয়োজনে প্রেক্ষিত বিবেচনায় দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর। যার মধ্যে আপাত কোনো সাযুজ্য নেই। 'চোখ বিষয়ে' গল্পে লেখক আমাদের স্থান-কাল-পাত্রের মন ও মানসের বিক্ষিপ্ততা আঁকার প্রয়াস পেয়েছেন। বস্তুত এতে গল্প আছে কাহিনী নেই। বর্ণনা আছে ব্যপ্তি নেই। কিন্তু যা আছে তা এতো সহজ-সরল বাঙ্ময় নয়। তাই বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। যে প্রেক্ষিতে গল্পাংশগুলো নির্মিত তা আলোচনা করার প্রয়োজনে সমাজ- সংসার-রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি- মানস ব্যাখ্যা করা আবশ্যিক। এবং সে কারণে আরো গভীরে যেতেই হয়।

একমাত্র অমিলেই সভ্যতা এগিয়ে চলে; জ্ঞান সৃষ্টি হয়। এই ভূখণ্ডের শিক্ষিত লোক বাঙলা, বাঙালিত্বকে যতোটা ক্ষতি করেছে, খর্ব করেছে, তার নজির মেলা ভার। আমরা সাধারণভাবে অক্ষমাশীল-অধৈর্য-অবিশ্বাসী। আবেগ আমাদের যতোটুকু দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে তার চেয়ে বেশি। আমাদের প্রাপ্তির খাতায় কেবলই শূন্যতার আধিক্য। অর্জন না থাকলে বিয়োগের ব্যথা বড়ো কঠিন হয়ে বাজে। মেধাহীনরা অন্যের মেধা স্বীকারে লজ্জা ও ভয় পায়। মেধাকে স্বীকার করে নিলে প্রকারান্তরে মেধাই শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং বুনিয়াদ মজবুত করে তোলে। পাগলামো ছিলো, আছে, থাকবেও। কারণ কে না জানে। স্বনিয়ন্ত্ৰিত পাগলামো সৃষ্টিশীলতা, সুন্দর ও সৌকর্যের অংশ। শ্রেষ্ঠত্বের যশে ভোগা ব্যক্তি এবং সামাজিক মানসিকতা নিছক জামাপ্যান্ট ছাড়া নগ্ন মধ্যবিত্তসুলভ দৃষ্টিভঙ্গী বই কিছু না। প্রয়োজন মানুষকে চালনা করে। কিন্তু এই মানসিকতা পোষণকে প্রয়োজন বলা যাবে না। তাই এটাকে কেউ যদি অহমিকা বলে,ভুল হবে না।এটা আত্মঘাতি। বাস্তবতার নিজস্ব গড়ন, ধরন ও সত্তা রয়েছে। স্বসৃষ্ট বিশ্বের বাসিন্দা সুস্থতার সংজ্ঞা দিতে পারে না। এবং অবশ্যই সবসময় মনে রাখতে হবে দৃষ্টিভঙ্গীটাই বড়ো কথা। ক্ষমতা বাড়ে না, অনভ্যাসে বিদ্যার ক্ষতি। বাংলাদেশের পরিমণ্ডলে যাবতীয় অনৈতিকতা ও দুর্নীতির বুৎপত্তি গৃহ ও ব্যক্তি মানস। সংসার-সমাজ-রাষ্ট্রের যাবতীয় অসংগতি-দুর্গতির মূলে দুর্নীতি ও অনৈতিকতা। সমাজে অপরাধ প্রশ্রয় পায় বলেই, এক সময় সমাজ অপরাধী হয়ে ওঠে। এদেশে 'শিক্ষা'র নামে 'দীক্ষা' দেয়া হয়। ফলে যা হয় তা অন্ধ- অনুকরণ, অনুসরণের নামান্তর। আমাদের প্রতিটি ঘর প্রতিভা নষ্ট করার এক একটি কারখানা। মিথ্যা কথায় আমরা সন্তানদের ভোলাই, অসৎ উপার্জনে ভরন-পোষণ করাই এবং বুঝে কিংবা না বুঝে এমনসব উদাহরণ অনুকরণীয় হিসাবে সন্তানদের সামনে হাজির করি, যা মূলত ভ্রান্ত এবং এতে সন্তানদের বিভ্রান্ত করার পথটাকেই সুগম করে তুলি। এখন ছেলেমেয়েরা ইনকিউবেটরে বাস করে এবং এই পরিবেশের বাইরে তারা প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন বিশ্বাসহীনতা নিয়ে বড়ো হচ্ছে। আমরা নিজেরাই নিজেদের বারবার গিনিপিগে পরিণত করি; আবার নিজেরাই তা থেকে বের করে আনার কথা বলি, এটা দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছু নয়। সংসার-সমাজ-রাষ্ট্রের অসংগতি-দুর্গতির হাত থেকে অদূর কেন সুদূর ভবিষ্যতেও রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। লেখক আমাদের এই অবস্থা ও অবস্থানকে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়। এই হতাশাবাদের বিপরীতে গিয়ে বলা যায়, সব আনন্দের শেষে থাকে স্থবিরতা, নিস্পৃহতা, বিষাদ এবং দীর্ঘশ্বাস। যা-ই হোক, 'চোখ বিষয়ে' লেখক আমাদের মধ্যবিত্তের পলায়নপর মানসিকতাও দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সমাজের পঙ্কিলতা একটানে বেআব্রু করে দেখিয়ে নিয়েছেন তাবৎ অসঙ্গতি। এতে হয়তো সমাজে কোনো আঁচড় পড়বে না কিন্তু আমরা অন্তত বোধ দিয়ে হলেও নিজেদের কদর্যতাকে ঘেন্না করতে শিখতে পারি- ....."বাসটি কোঁকাতে কোঁকাতে এসে উগড়ে দিল একগাদা লোকজন, আবার চেটেপুটে নিল যা সম্ভব।...."
রিয়াজুর রশীদের লেখনীসুলভ এ ধরনের বাক্য অন্যান্য গল্পের মতো এ গল্পেও যথেষ্ট, যা আমাদের চমকিত করে। কিন্তু পাঠককূল সর্বদা শুদ্ধ হয় না। তাই বক্তব্যকে কতোটা ধারণ করে বলা দুষ্কর।
শিল্পবিপ্লব নগর সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। নগর সভ্যতা মানুষের ভেতর বিভাজন এনেছে। করে তুলেছে অসহায়-নিরূপায় ও ভাগ্যাশ্রিত। অসহায়তা এবং অনিশ্চয়তার সাথে ধর্মের যোগসূত্র দৃঢ় বিশ্বাসের চাকা ঘুরতে শুরু করে যা অনেকটাই আরোপিত, হতাশা- উৎসারিত, অসহায়ত্ব-আশ্রিত। এ থেকে বোধহয় নিস্তার নেই। রিয়াজুর রশীদের লেখায় যৌনতার প্রাসঙ্গিক ব্যবহারও রয়েছে। 'সন্তানগণ ও দুধভাত' ও 'অবনত ধারাপাত 'গল্পে মানুষের আস্থা-বিশ্বাসের চরিত্র মূল্যায়নে লেখক যথেষ্ট সফল।

'মারণদাত" গল্পটির অসাধারণত্ব বর্ণনায় স্বতন্ত্রভাবে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। বলাই বাহুল্য সৈয়দ  রিয়াজুর রশীদের এই ধরনের গল্পের সংখ্যা কম নয়। মুক্তিযুদ্ধকে
অনুধারণ ও উপলব্ধি করতে হলে ‘মারণদাঁত' গল্পটি উপযুক্ত দৃষ্টান্ত। প্রথম শব্দ থেকেই কাহিনীর সূত্রপাত। বর্ণনাটা এমন- 'সর্পিলাকার, পিচ্ছিল, দীর্ঘ এক শ্বাপদ - যথা, একটি অজগর যেন; জিহ্বা মৃত্যুবিস্তারী - পাকস্থলী তার ক্ষুধার্ত-ভয়ঙ্কর। মুখ গহ্বরের বিশাল হা। হা করে সে গলধ:করণ প্রক্রিয়াতে - একেকটি সুরুৎ করে টান দেয়, সঙ্গে সঙ্গে রাশি রাশি ত্রাসিত মানুষজন গ্রাসিত হয়ে চলেছে অনবরত। এই হলো রাত্রি; অন্ধকার, নিকষ – যা মৃত্যুগন্ধী।'

প্রতিটি শব্দই যেনো একেকটি কাহিনী। একেকটি বাক্য যেনো ইতিহাসের বর্ণনা। 'মারণদাত' শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এরকম জমাট-রগরগে। গল্পটি পরে আলোচনায় আসবে।

“দাত নাই শিং নাই নখ নাই' সর্বার্থে লেখক অন্তর্লীন গল্প। ঢং-টা কাব্যিক। উপস্থাপনার বিষয়টি ছাড়া 'চোখ বিষয়ে' গল্পের সাথে তুলনীয়। ‘আগুনের বিপদ আপদ'-এ আমরা আবার ঋদ্ধ, পরিণত গল্পকার হিসাবে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের সাক্ষাৎ পাই। গল্পের জবেদালির চরিত্র যে উত্থান-পতন এবং বৈপরীত্যের ভেতর দিয়ে যায় থমকে পড়ার অবকাশটুকু দেয় না – পাঠক বারবার ফিরে আসে নিজের কাছে, আত্মজিজ্ঞাসার মতো।
বুড়ি দাদীর সাথে প্রেক্ষিতজনিত মানসিক ব্যবধান এবং বৃদ্ধার চরিত্রের যে আকুতি তিনি লেখচিত্রে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে মুন্সিয়ানার পরিচায়ক। পরবর্তী গল্প 'আগুনবাজ'-এ হাসেন পাগলা, নিশিগন্ধা গ্রাম এসবের মাঝে লেখক দক্ষভাবে কাহিনীকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যান এবং পরিণতি পর্যায়ে তুলির শেষ আঁচড় বোলাতে গিয়ে তথাকথিত ফর্মকে অস্বীকার করে ছোট কাগজের ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী কাতারে উন্নীত হন।

"শাদা কাহিনী'তে 'নূরুল এসলাম ইন্তেকাল' করে। এই চরিত্র লেখকের কুশলতায় ক্রমাগত নারী বদলায়, হয়তো পুরুষের সহজাত বহুগামীতার চিত্র আঁকতে চেয়েছেন। গল্পের বুননে ভাষাগত এবং উপস্থাপনজনিত সংবদ্ধতা আপাতদৃষ্টে পাঠকস্বার্থের পরিপন্থী মনে হতে পারে কিন্তু লেখক যখন বলেন, পুরুষ এবং রমনীর পরিশ্রম, দায়িত্ব ও কর্তব্য ৫০ঃ৫০, তখন যথার্থই আশাহত হতে হয়। কারণ শারিরীক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যগত কারণে পুরুষ ও নারীর পরিশ্রম, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সমান বণ্টন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণেই স্বীকৃত নয়। আমরা জানি লেখক বিজ্ঞানের ছাত্র। সুতরাং তিনি এটা জানেন। সম্ভবত নারী-পুরুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরতে এই অবতারণা। এবং গল্প যেহেতু মোটাদাগে কেবল বিনোদনই না,সামাজিক-অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক বিষয়; তাই বিচার-বিবেচনা সংকীর্ণ করা অনুচিত। অধিকন্ত ছোট গল্পের সামাজিক দায়বদ্ধতা অসীম এবং ছোট কাগজের ছোট গল্পের ক্ষেত্রে মুষড়ে পড়া, নোংরা, পঁচা-পঙ্কিল প্রথা ও মানসিকতাকে ঝাঁকুনি দেয়াটাও মুখ্য।

গল্পের শুরু থেকেই 'শাদা কাহিনী'র সম্ভাবনাময় অসাধারণ শিল্প-সত্তাকে অস্বীকার করা যায় না। গল্প বলার এক পর্যায়ে লেখনীকুশলতায় গল্পটি বাস্তবিকই অসাধারণ হয়ে ওঠে। চুনাতিপাড়ার আবুইল্যার রাত-দিন যাপনের কাহিনীর সাথে গ্রামটির কাল আকালের দিনলিপি একই সূত্রে গ্রন্থিত হয়ে যায়। গল্পের কোথাও কোথাও আবেগ থরো থরো কম্পমান, কাব্যিক সুষমা লেখকের অতীতের লেখাগুলিকে ছাড়িয়ে গেছে। 'যৌনতা' শব্দোল্লেখের প্রতি লেখকের সহজাত সংবেদনশীলতা এখানেও প্রতিভাত। এবং "শাদা কাহিনী' গড়তে গিয়ে লেখক (হয়তোবা) আপেক্ষিক সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়ে পরতে পরতে যে চিত্র এঁকে চলেন তাকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখা চলে না।

'সুপ্রভাত?- এ আলীম পাটোয়ারীর সাথে গল্পের প্রান্তে এসে লেখক পাঠকদের যে অবস্থানে এনে দাড় করান, তা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। এখানে চরিত্রের বর্তমান আছে, অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ নেই – সাহিত্য কিংবা গল্পের ক্ষেত্রে এটা মূখ্য নাও হতে পারে। লেখকের সফলতা, তিনি 'সুপ্রভাত?' গল্পের মেয়াদী আবেদন তৈরিতে সমর্থ হয়েছেন।

'অথবা ইন্দ্রজাল' গল্পে সম্ভবত লেখক আবহমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে দু' একটি চরিত্রের বিকাশ-বিশ্লেষণ-পরিণতি দেখাতে চেয়েছেন। সাধারণভাবে প্রত্যেক লেখকই স্বতন্ত্র শিল্পী-সত্তাকে ধারণ করেন, সে বিবেচনায় বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতাও স্বাভাবিক। পরিশেষে কালের পরীক্ষায় এই স্বতন্ত্র অবস্থান নির্ধারিত হয়। এটা পরের কথা। গল্পে মানব চরিত্রের স্বাভাবিক আচরণের অন্তরালে যে অস্বাভাবিক, অনৈতিক, সংবেদনহীন বৈশিষ্ট বিদ্যমান স্থান-কাল-পাত্রের উপযুক্ত সম্মিলনে তার প্রকাশ ঘটে। নয়নপুর গ্রামের পাহারাদার সামাদ মির্জা রাতের অন্ধকারে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মানব প্রবৃত্তির নির্লজ্জ প্রকাশ প্রত্যক্ষ করে।

'অন্ধকারে মোম গলে' একটি প্রেমের গল্প, লেখক বলেছেন। হ্যাঁ, প্রেমেরই গল্প। দায়িত্বটা পাঠকের। গল্পকার রচনা করে যান আর পাঠককে বুঝে নিতে হয়। পুনরাবৃত্তির দোষে দুষ্ট গল্পটিতে সম্ভবত প্রেমের সংকট দৃশ্যমান। জীবন বিশ্লেষণ তথা আত্মবিশ্লেষণ, ঠাঁই হারিয়ে ফেলা যৌনাভিজ্ঞতা; অতঃপর মানসিক রোগী, প্রত্যাবর্তন এবং বিয়ে ও তৎপরবর্তী বিদেশ গমন। গল্পটির ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য হলো খণ্ডকালীন অনুভূতি বিশ্লেষণের প্রয়াস। নেতিবাচক অন্যতম দিকটি হলো পাঠককে গল্পের গভীরে যেতে নিরুৎসাহিত করে। তারপরও 'প্রেমের গল্প' হয়তো এই অর্থে, প্রতিটি বিশ্লেষণান্তে লেখক জীবনের কথা বলেন, জীবনের জন্য বলেন। এতে ভাষাগত অগম্যতা এতো বেশি, লেখককে নিজেকেই সরব হতে হয়; গল্পটি প্রেমের। অন্যথায় অন্য গল্পের সাথে মিলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা ষোলোআনা। অথচ পরবর্তী গল্প 'ক্ষুধাচিত্র' এক কথায় অনবদ্য। ব্যক্তিক পটভূমে রচিত আবহমান বাংলার নীরব দুর্ভিক্ষের পণ্ড প্রতিলিপি। সবধরনের পরিসংখ্যানের বাইরে প্রাকৃতজনের ব্রাত্য-কাহিনী, যা বৈজ্ঞানিক যুক্তির বিচারে মানব-দুগর্তিকে সবসময় গড় হিসাবে বিবেচনা করে আসছে। ফলত গণনায় অবহেলিত এককচিত্র, সামগ্রিক মানবিকতায় যা সাধারণত গবেষকদের দৃষ্টি কাড়ে না। 'ক্ষুধাচিত্র' এই অন্ত্যজ শ্রেণীর খণ্ডকাহিনী। এখানে জমেদালী প্রাতাহিক বিরূপতা তথা আশাভঙ্গের ভেতর দিয়ে জীবনযুদ্ধের পরিগণনায় বার বার গড়মিল করে ফেলে। মানুষের প্রবৃত্তির অন্যতম উপাদানগুলো যেখানে নিষ্পেষিত, সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির লালসার কাছে সেই সব ব্রাত্যজনদের যে শুধু আপোষ করতে হয় তা নয়, রীতিমত আত্মসমর্পন। লেখক যথার্থই জীবনের প্রতিচিত্র এঁকেছেন অসামান্য লেখনীতে।

"শেষ দিবস... ১টি রিপোর্ট' গল্পে লেখক নৈর্ব্যক্তিকভাবে কাহিনী বলে চলেন এবং পাঠককেও করে তোলেন আবেগশূন্য। ফলত গল্পের প্রতি সাধারণ আকষর্ণশূন্যতা তৈরি নির্মোহভাবাবিলতাদুষ্ট। লেখক এখানে যে নাগরিক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়। যেমন জীবন যখন যান্ত্রিক তখন এর পূর্বাপর সবই জ্ঞাত। তাই বৈচিত্রহীন, করেছেন তা বিদ্ধস্ততার পর্যায়ে না গেলেও যান্ত্রিক করে তোলে। মানুষের অহমের অন্তর্গত স্বার্থপরতার প্রকাশ দেখাতে গিয়ে সমাজকে ন্যাংটো করে ফেলেছেন, যার অন্যতম অংশীদার সমাজের আমরা সবাই।

'মুখোশ… বেঁচে থাকা…' গল্পে লেখক নিজের সঙ্গে কথা বলে যান। স্বগতঃ সংলাপে নাটকীয়ভাবে ও ভঙ্গীতে উন্মোচন করে চলেন, ব্যবচ্ছেদ করেন আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি। গল্পে তাই এক ধরনের আত্মরতিপ্রবণতার ধারণা মেলে। লেখক 'স্যাডিস্ট বলতে যা বুঝিয়েছেন, তা সম্ভবত 'ম্যাসোকিস্ট' অর্থে ব্যবহৃত হয়। গল্পটি সুখপাঠ্য। রিয়াজুর রশীদের লেখা নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়; কিন্তু শেষ কথা বলা যায় না। কারণ পাঠক হিসাবে আমরা লেখকের কাছে অসাধারণ আরো লেখা প্রত্যাশা করতেই পারি। আমাদের উচিত তাঁকে আরও সময় দেয়া।

'মারনদাঁত' গল্পের প্রকাশভঙ্গী কবিতার। গল্পের পটভূমি একাত্তর। এখানে লেখক যেনো নিজেকেই গল্প শোনান। মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে লেখকের প্রথম নিরীক্ষাধর্মী গল্প। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর আমরা ইতিহাস হিসাবেই জানি। লেখক এখানে ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন। পূর্বে যেমন বলা হয়েছে, প্রথম শব্দ থেকেই কাহিনীর সূত্রপাত; প্রতিটি শব্দই যেনো একেকটি কাহিনী; একেকটি বাক্য যেনো ইতিহাসের বর্ণনা। গল্পটি লেখকের প্রথম গ্রন্থ 'আগুনের বিপদ আপদ'-এ অর্ন্তভুক্ত হয়। সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের বিশাল পরিমণ্ডলকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে তুলে ধরতে দুই মলাটে আবদ্ধ করার এই প্রয়াস। লেখকের উদ্দেশ্য মহৎ বলা যায়। গল্পে মুক্তিযুদ্ধের পশ্চাৎপট, অনুক্রম নয় মাসের যুদ্ধে বার বার এসেছে।

'দীর্ঘজীবী হোক আবুল হুসেন'-এর (১৯৯৭) পরিসর ব্যাপ্ত – একাত্তর এবং উত্তরকাল। অনেক বেশি প্রতীকী এবং কাহিনীর অনুসঙ্গ বর্ণনায় স্থান-কালের সীমা ছাড়িয়ে যায়। অতীত নির্ভর গল্পটিতে পাঠক নিঃসন্দেহে এক ধরনের পূর্ণতার স্বাদ পায়। আবুল হুসেনের স্মৃতির শোণিতে একাত্তর কথা বলে চলে। খলিফা পট্টির আবুল হুসেন সুঁই-সুতোর খেলায় বাংলাদেশের সীমানা ধরতে পেরেছিলো ঠিকই। বর্ণনা নির্ভর গল্পটির অসাধারণ সার্থকতা হলো, সাধারণ মানুষকে প্রতীকী অর্থেও একটা কণ্ঠস্বর দিতে পেরেছেন। ইতিহাস বলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষই ছিলো প্রধান চরিত্র। সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা, সামরিক কৌশল নিয়ে সাধারণ মানুষ এতে যুক্ত হয়নি। পরিবেশ-পরিস্থিতি প্রয়োজনের তাগিদে সাধারণ মানুষ সহজ-সাধারণ বিবেচনায় তার কর্তব্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলো। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মহান ও স্বতঃস্ফূর্ত। আমরা নেতা বানিয়েছি আমাদের প্রয়োজনে, নেতৃত্বের ভারার্পণও করেছি আমাদের প্রয়োজনে। তাই নেতা-নেতৃত্ব মূলত প্রতীকী। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, 'নেতৃত্ব' বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে একটা সিস্টেমের অর্ন্তগত। গল্পকার সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের এই ভাবনা আমাদের চমকিত করে। 'লাশ নাই' গ্রন্থের সবগুলো গল্পই নিরীক্ষাধর্মী। 'লাশ নাই', 'গল্পটি ভূতের নয়' এধরনের নামকরণেও লেখকের একই চিন্তা-চেতনা কাজ করে থাকবে।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সময়ের সন্তান। স্থান-কালের পরিবর্তন সম্বন্ধেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তাঁর লেখায় দ্বান্দ্বিকতা, সংকল্প, অন্তরীপ দর্শন, শ্রেণি-চেতনা এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্ববিরোধীতা ক্রিয়াশীল থাকাও অসম্ভব নয়। সবই আমাদের সমাজের উপাদান। নিঃসন্দেহে তিনি চিত্রকাল্পিক এবং তা সামগ্রিকতায় বিকশিত। ভাষা এবং এর উপস্থাপনায় তিনি বিশেষভাবে মনোযোগী এবং সংবেদনশীল। সুতরাং ভাষার ব্যাকরণ তাঁর কাছে বিশেষ গুরুত্ববহ। যা মূলত একজন কবির বৈশিষ্ট্য। এ কারণে কখনো কখনো তাঁর উপস্থাপনা হয়ে ওঠে কাব্যিক। অনবরত অনড় নিরীক্ষাধর্মী গল্প রচনা করেছেন। সাধারণ-সাদামাটা ধন্যবাদে এর সমাপ্তি ঘটে না। শব্দ ভেঙ্গে শব্দ, বাক্য ভেঙে বাক্য নির্মাণে সিদ্ধহস্ত সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ একজন কুশলী গল্পকার এবং গল্পের কুশীলব। তাঁর লেখায় শিল্পীসত্তার উপস্থাপন ও বিকাশে এক ধরনের খোলস খুলে বেরিয়ে আসার বিবর্তনমুখী প্রয়াসধর্মীতা স্পষ্ট।

'জননীর জন্য গল্প এবং লেখকের হত্যাকাণ্ড' গ্রন্থে রচনা দু'টি। প্রথমটি প্রবন্ধ 'জননীর জন্য গল্প এবং লেখকের হত্যাকাণ্ড', অন্যটি 'সোমেন যদি বেঁচে থাকত। প্রথম লেখা নিয়ে বলার কিছু নাই। প্রবন্ধে হেন কিছু নাই যার স্থান হয়নি। বাংলা সাহিত্যের আদি-অনাদি-মধ্যকাল তথা নাতিদীর্ঘ ইতিহাস, বাংলা ছোট গল্পের রকম-সকম, সমাজবাস্তবতা, রাজনীতি-ভাঁজনীতি, দর্শন, মনভ্রমণ, ভারি প্রবন্ধ-খাঁটি প্রবন্ধ, লেখকের দায়িত্ব-কর্তব্য ইত্যাদি ইত্যাদি। তাসত্ত্বেও এখানে গল্প আছে, বলা যায় অনেকগুলি গল্প আছে, তাহলো স্কেচ। প্রতিটি স্কেচই স্বতন্ত্র গল্প। দু'একটি স্কেচ বাদে বাকি সব শিশুতোষ। দ্বিতীয়টি প্রবন্ধ-গল্প 'সোমেন যদি বেঁচে থাকতো'। বস্তুতঃলেখকের গল্পগুলোর আবহ মোটামুটি এ ধরনের। এটাকে একটি ঘরানা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বিভিন্নভাবে ইতিমধ্যে যা বলার চেষ্টা হয়েছে, মানবিক অনুভূতির এলোমেলো, কোনো নিয়মের ধার না ধেরে কাটাকুটির মাধ্যমে সংবেদনকে তীব্র করে প্রত্যক্ষ আঘাত। এবং সীমার প্রসঙ্গে তিনি যথার্থই বলেন, গল্পের সীমা নির্দেশ করতে নেই। এ দেশ-মাটি-মা সব তাঁর কাছে জননী তুল্য। মাতৃভক্তির অপার উপাদান তাঁর লেখায় ছড়ানো-ছিটানো।

সোমেন যদি বেঁচে থাকতো। তবে কি এ বঙ্গের ইতিহাস ভিন্ন খাতে বইতো? হতে পারে, আবার না-ও পারে। হলেও কিছু যায় আসে না। না হলেও না। কারণ স্বাধীন বাংলায় মানুষের মুক্তি ঘটেনি। সোমেন বেঁচে থাকলেও তাঁর কাজ করার সময়টা থাকতো ঔপনিবেশিক কাল (বৃটিশ পরবর্তী পাকিস্তান)। এবং শতবর্ষী হলেও শারিরীকভাবে থাকতো অক্ষম, অসমর্থ। সোমেন বেঁচে থাকলে এ মাটিতে একটি অন্যায় কম সংঘটিত হতো? সম্ভাবনা কম। বামপন্থী কর্মী সোমেনের মৃত্যু রাজনীতিতে সংযোজন-বিয়োজন কিছুই করেনি। যা করেছে তা হলো বাংলা সাহিত্য, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে মজাদার আলোচনার খোরাক যুগিয়েছে। সোমেন ধরনের অনেক মৃত্যুই বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ঘটেছে। কোনো মৃত্যুই বৃটিশরাজের চেতনায় আঁচড় কাটেনি। বৃটিশরা চাইলে আরো বিশ-পঁচিশ বছর অনায়াসে ভারত শাসন করতে পারতো। কিন্তু তারা জানতো, যেহেতু চলে যেতেই হবে, সসম্মানে যাওয়াই ভালো। আর বামপন্থিদের ভূমিকা ও কার্যকারীতা সম্পর্কে ভালো কথা বলার অবকাশ কম। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বামপন্থিরা শুধু চাপার জোর দিয়ে বাঙালিদের সাথে কেবল প্রতারণাই করে গিয়েছে।

যা-ই হোক, সোমেন বেঁচে থাকা এবং না থাকার তাৎপর্য হলো ধারাবাহিক অন্যায় সংঘটনের গতি হ্রাস পাওয়ার একটা প্রত্যাশা তৈরির সম্ভাবনা। সোমেন বাঁচতে চেয়েছিল নিশ্চয়। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সোমেনকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন।

'জননীর জন্য গল্প এবং লেখকের হত্যাকাণ্ড'কে একটা কবিতা বলাই ভালো। যা কিছু সুখপাঠ্য, তাই কবিতা। এই সুখ প্রবৃত্তির সুখ । লেখক তাঁর সমস্ত জ্ঞান-সৃষ্টিশীলতা দিয়ে চেয়েছেন, যা কিছু মঙ্গলজনক। তবে দু'টি রচনা তথা সমগ্র বইটাতে আমরা যাকে পাই, তিনি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, তাঁর মনোজাগতিক কাঠামো-বৈশিষ্ট্য । তিনি বুদ্ধিজীবী বনতে চাননি। নন্দনতত্ত্ব তাঁর মাথাব্যথা নয়। গল্পের পরিবর্তন-বিবর্তন নিয়েও ভাবিত নন। গল্পের প্রয়োজনেই না, আর্থ-সামাজিক অসাম্যের সূত্র সন্ধানে সংসার-সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে অসঙ্গতি দৃষ্টে কেবল নিজের সাথেই বোঝাপড়া করেছেন অনবরত, যা তাঁর লেখার পরতে পরতে দৃশ্যমান। আমরা জানি, কৌশল প্রয়োগ করে স্বার্থ হাসিলের নামই ক্ষমতা। স্বীয়-স্বার্থ অগ্রাহ্যকারী যখন স্বার্থের স্বনির্ধারণী মাত্রা যে মেনে চলে, তখন হয়ে ওঠে অনন্য। এই স্বনির্ধারণী মাত্রাই তাকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র করে। কৌশলবাজ, স্বার্থপর, পরধনলোভীদের কারণে এখানে সন্দেহ আছে, সম্ভাবনা নেই। এখানে আইন সন্দেহকে দৃঢ় করে; সম্ভাবনার অপমৃত্যু নিশ্চিত করে। এদের ব্যক্তিত্ব হলো সামাজিক অভিনয়; যা সম্পূর্ণ আরোপিত, দীর্ঘমেয়াদী চর্চার ফল। এদের স্বার্থ রক্ষা করে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেট ব্যবসায়ী। তাই নেতৃত্বের ভূমিকায় যারা থাকে তাদের চরিত্র নিয়ে কেউ হয়তো প্রশ্ন উপস্থাপন করতে পারে। এদের চোখ শৃগালের, সে চোখে ধূর্ততা খেলা করে । কিন্তু সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ কি তাঁর সব কথা বলতে পেরেছেন? যতোটুকু বলেছেন, তা বুঝতেও হয়তো সময় লেগে যাবে। সৌভাগ্য তিনি এখনো সৃষ্টিশীল এবং অকৃত্রিম ভালোবাসায়, অপরিসীম মমত্বে তাঁর চিন্তা-দুঃশ্চিন্তার উত্তাপের লেখচিত্র উপহার দিয়ে যাচ্ছেন।

যেমনটা বলা হয়েছে রিয়াজুর রশীদের লেখায় বৈশিষ্টগতভাবে রয়েছে খামখেয়ালিপনা। শব্দ ভেঙ্গে জোড়াতালি দিয়ে, বাক্যের কাটাকুটির মধ্য দিয়ে বাক্যের নির্যাস দিয়ে তিনি বাক্য নির্মাণ করেন। ব্যাকরণের সূত্র ছুড়ে ফেলে অর্থকে বাঙ্ময় এবং অনুভূতিশীল করতে কখনো তিনি কবিতার স্টাইলে শব্দ সাজিয়ে বাক্য নির্মাণ করেন; ষাটের দশকে অ্যাপলোনিয়েরের কবিতায় আমরা যেভাবে পাই। অবশ্যই স্বীকার্য নিরীক্ষাধর্মী ছোটগল্প সবার জন্যে নয়। কবিতার লেখক এবং কবিতার পাঠক যেমন সবাই হতে পারে না, ছোট কাগজের ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বিশেষত আমরা যখন নিরীক্ষাধর্মী এবং প্রথাবিরোধী গল্পের কথা বলি। এ জন্যেই বারবার ভাঙ্গাগড়ার প্রশ্ন আসে। যার মূল উদ্দেশ্য পুনঃ পুনঃ আঘাতে চেতনা জাগ্রত করা। এটাই ছোট কাগজের উদ্দেশ্য এবং দর্শন। তাই শুধু কাহিনী ভাঙ্গাগড়ার প্রশ্নই আসে না, –উপস্থাপন, স্টাইল, ফর্ম, শব্দ ভেঙ্গে শব্দ, বাক্য ভেঙ্গে বাক্য কিংবা শব্দগুচ্ছ, বাক্যগুচ্ছ তৈরি - সবই এর ভেতর পড়ে। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎ, বুদ্ধদেব, মানিক, অদ্বৈত; হাল আমলের শওকত ওসমান, রিজিয়া রহমান, হুমায়ূন আহমেদ বিবেচনায় এই ধারার হৃদয়ঙ্গম অসম্ভব। প্রসঙ্গত সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহকে এই গতানুগতিক ধারায় ততোটা ফেলা যাবে না। শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্বতন্ত্র, তবে উল্লেখিত গতানুগতিক ধারার উন্নত সংস্করণ।

সনাতনী ব্যাকরণ ভেঙে স্বতন্ত্র ব্যাকরণ নিমার্ণের খেয়ালই সৈয়দ রিয়াজুর রশীদকে পৃথক পরিচিতি দিয়েছে। ব্যাকরণের কাঠামো ভেঙে আবার ব্যাকরণ গড়ার সাথে কাহিনী নির্মাণের দায়িত্ব জুড়ে দিলে বিষয়টা আর সহজ থাকে না। তারপরও গল্প আঁকার দুর্দম ক্ষমতা বাস্তবিকই বিস্মিত করে। বস্তুতঃ ভাঙ্গাগড়ার জটিলতার মধ্য দিয়ে গল্প বের করে আনার ক্ষমতা সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের সহজাত। তাঁর প্রতিটি গল্পই যেনো একেকটি চিত্রকলা। তাই তিনি গল্প লেখেন না, ছবি লেখেন। এই ছবি লিখতে গিয়ে তিনি মানুষকে, সমাজকে, সময়কে যেভাবে ব্যঙ্গ করেন তাতে প্রকৃতই এর ভেতরের কৃত্রিমতার প্রকাশ ঘটে যায়। পাঠকের বোধোদয়ের উন্মেষ ঘটে এবং পরিপার্শ্বকে নতুনভাবে দেখা সহজ হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যে মাইকেলের হাতে কিছুকাল তারপর গত শতকের ত্রিশের দশক ব্যতীত প্রেমের উপন্যাসের স্থান দখল করতে অন্যকোনো উপাদান বাংলা সাহিত্যে কখনোই খুব একটা আসেনি। মেধা, মাত্রাজ্ঞান ও মস্তিষ্কবিশিষ্ট গদ্য লেখকের ঘাটতির কারণে অন্যান্য বিষয়কে উপজীব্য করে কালোত্তীর্ণ সৃষ্টিতে আমাদের বন্ধ্যাত্ব স্বীকৃত। আমাদের লেখকদের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ সত্য হলো, সবাই জনপ্রিয়তার মোহে থেকেছে, মেতেছে ও পরিচালিত হয়েছে। বড়ো-ছোটো কেউই বাদ যায়নি। এ জাতির মেধাবৈকল্য কিছুটা ব্যাপকাকারে নিরসনের সূচনা ঘটে ত্রিশের দশকে। এই 'ইউফোরিয়া' বা 'উচ্ছ্বাস যুগে'র স্থায়ীত্ব মোটামুটি বিশ বছর। গুণগত পরিবর্তনের কিছুটা আভাস আবার দেখা মেলে ষাট দশকে এই বাংলায়। তারপর আশির দশকে আরো সুসংহতভাবে বিশেষ করে ছোটগল্পের ক্ষেত্রে। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ এই দশকের অন্যতম কাণ্ডারী।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের 'গল্প অন্যান্য ও ছবিলেখা' গ্রন্থভূক্ত লেখাগুলো 'শাদা কাহিনী' (১৯৯৬), "দীর্ঘজীবী হোক আবুল হুসেন' (১৯৯৭), 'লাশ নাই' (১৯৯৯), 'জননীর জন্য গল্প এবং লেখকের হত্যাকাণ্ড'-ভূক্ত (২০০৬) লেখাগুলোর মতোই। 'জননীর জন্য গল্প এবং লেখকের হত্যাকাণ্ড' এবং 'গল্প অন্যান্য ও ছবিলেখা' গ্রন্থদুটি বিশেষভাবে বলতে চাই, কারণ এতে লেখকের লেখনী-বৈশিষ্ট্যের প্রায় সামগ্রিক প্রকাশ ঘটেছে।

যে দুঃশাসনের কালে (জেনারেল এরশাদের ৯ বছর ব্যাপী সামরিক শাসন) সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের আবির্ভাব তখন কলম ধরা ছিলো সাহসের বিষয়। তখন ক্ষোভের প্রকাশটাও ছিলো গঠনমূলক। ঐ সময়ের গল্পগুলোই 'আগুনের বিপদ আপদ'-এ ঠাঁই পায়। (এ সময়েই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উনসত্তরের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত বিখ্যাত এবং এ বিষয়ে একমাত্র সফল রাজনৈতিক উপন্যাস 'চিলেকোঠার সেপাই" প্রকাশিত হয়।) নব্বইয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেও গণমানুষের প্রত্যাশার অপনোদন ঘটে না। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদও লেখনীতে হয়ে ওঠেন আরো আগ্রাসী। সচেতন ও দায়িত্বশীল লেখকদের মধ্যেও জান-মাল-প্রেম ঘরানার গল্প থেকে বের হয়ে আসার প্রবণতার সূত্রপাত ঘটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এরশাদের বাক-স্বাধীনতাহীনতা আশির প্রমিথিউসদের ব্যুৎপত্তিতে সহায়ক হয়েছে। সময়, সমকালীন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, দেশিয় রাজনীতির উত্থান-পতন, পুঁজিবাদের নববিকাশ, সত্তর বছর যাবৎ পুঁজিবাদের ক্রমাগত ছোবলে মরণদশায় কবলিত সমাজতন্ত্র, দু'হাজার বছরাধিক ধরে চলে আসা নন্দনতত্ত্বের এতোকালের প্রতিষ্ঠিত ধারণায় ঘুণে ধরার প্রেক্ষাপট (আরিস্তোতলের ‘পোয়েটিক্‌স্’সহ হোরেস, লুঙিনাস এবং বিভিন্ন সময়ে লেখা অন্যান্যদের নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক রচনা বিবেচনায়), লেখকের দায়বদ্ধতার নতুন বাস্তবতা ইত্যাদি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের লেখনীতে ছাপ ফেলে যেতে থাকে। গড়ে ওঠে স্বতন্ত্র মৌলিকত্ব। "গল্প অন্যান্য ও ছবিলেখা' লেখকের ভাষায় একটি গল্পের কঙ্কাল হিসাবে অভিধিত হলেও তা প্রকৃতপক্ষে গল্প এবং প্রত্যাশিত অসাধারণত্ব নিয়ে কোনো দ্বিমত হবে না।

লিখিয়েদের গল্পের শেষটানা কেবল প্রবণতাই নয়, দায়িত্বের ভেতরেও পড়ে। তিনিও ব্যতিক্রম নন। কিন্তু তাঁর গল্পের ভেতরে পরিবর্তনের মাত্রা ও গতি অন্য কারো সাথে মেলে না এবং তা অপ্রাসঙ্গিক ও অসংগতও না। গল্প একঘেয়ে মনে হয় না। মন্তাজ-আবহ তৈরির মাধ্যমেও তিনি ফর্ম তৈরির প্রচেষ্টা চালান। কখনো এই গতির মাত্রা দ্রুত হলেও কাহিনী অন্ততঃ শ্লথতায় আক্রান্ত হয় না। গল্পের সীমিত আঙ্গিকে এই ঘন বাঁক পরিবর্তন আশির গল্পকারদের মধ্যে একমাত্র সৈয়দ রিয়াজুর রশীদেই সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। রূঢ় বাস্তবতার চিত্রায়ণ, মনের অন্তঃনিহিত গভীরে যে মনস্তাত্ত্বিক সংশ্লেষ খেলা করে কিংবা তথাকথিত সত্য-সুন্দর, ন্যায়-নৈতিকতার প্রগাঢ়তা, স্ববিরোধীতা, পরস্পর- বিরোধিতার যুথবদ্ধ কাহিনী-চিত্র নির্মাণে এই বাক পরিবর্তনের আঙ্গিক বা ফর্ম পাঠককে ঝিমিয়ে পড়তে দেয় না। যদিও নির্দিষ্ট কোন ফর্ম বা আঙ্গিকের প্রতি দায়বদ্ধহীনতা এবং নিজের তৈরি ফর্মকেও অবলীলায় অস্বীকারের মানসিকতা তাঁর লেখায় সহজাত। এই অর্থে তিনি বিবর্তনবাদী। গল্পে তিনি ছবি আঁকেন। কিন্তু শুধু প্রতিকৃতি কিংবা প্রতিবিম্ব এঁকেই ক্ষান্ত হন না। এমনভাবে সমাপ্তি টানেন, যেনো তারপরও গল্প থেকে যায়। গদ্যের সাথে সন্ধি করে করে শব্দের সীমানা পেরিয়ে তিনি কাহিনী গড়তে এক একটি স্তর নির্মাণ করেন। এটা তাকে ভিন্নমাত্রায় স্বকীয়তা দান করেছে। বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় শ্রমশীলতার দৃষ্টান্তে তাঁর অসাধারণ মমত্ববোধ ধরা পড়ে। বোধ ও বিশ্বাস বারবার হোঁচট খেয়ে মূল্যবোধের ভিতকে নড়বড়ে করে দেয়। তখন লেখকের সাথে পাঠকও অনুশোচনাবিদ্ধ হন এবং প্রচলিত প্রথা-বিশ্বাস- মানসিকতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। উভয়েই একই কাতারে নীত হয়। তাই গল্প শুধু গল্প নয়, একেকটি ট্রাজেডির বিনির্মাণ। গ্রিক সাহিত্যের ট্রাজেডির মতো নয়। গ্রিক সাহিত্যে 'নেমেসিস' বা 'নিয়তি' রয়েছে এবং তা নির্ধারিত। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ক্ষেত্রে ভিন্নতা হলো তিনি এই 'নেমেসিস' বা নিয়তিকেও নিয়ন্ত্রণ করেন। ন্যায়-নীতিনির্ভর, আদর্শিক, সৃষ্টিশীল, গঠনমূলক, উৎপাদনমুখী মূল্যবোধ সহায়ক সাহিত্য সৃষ্টির সুবিধাবাদী মত-পথকে দুমড়ে-মুচড়ে কঠিন সত্যের নির্যাস বের করে পাঠকের সামনে মেলে ধরেন এবং চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, নীতি- নৈতিকতা, আদর্শ, গঠনমূলক ধাঁচের শব্দ কপচিয়ে সুবিধাবাদীরা কীভাবে তোমাকে প্রতারিত, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং শোষণ করছে। সময়ের প্রচলিত প্রথাগত দাবীকে অস্বীকার করে কালোত্তীর্ণ হওয়ার সহজাত লোভকে জয় করতে না পারলে এমন সৃষ্টি অসম্ভব।

আশির প্রমিথিউস গল্পকার সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। লেখালেখিতে অক্লান্ত সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ এখনো সৃষ্টির উল্লাসে স্বকোপলকল্পিত পথে রঙে,-- আকার, প্রকার ও আঙ্গিনায় নিঃসঙ্গচিত্তে বিরতিহীন খেলে চলেছেন বিশুদ্ধ প্রান্তরে স্বসৃষ্ট আর্দ্রতায় স্বীয় সৃষ্টি সুখে।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: একজন গল্পকার ও নৃতাত্ত্বিক এবং তাঁর নিরীক্ষীয় বাস্তবতা
জিয়াউল আহসান
 

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,318,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,56,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,15,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,37,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : জিয়াউল আহসান
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : জিয়াউল আহসান
► জিয়াউল আহসানের প্রবন্ধ
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s16000/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s72-c/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/11/Ziaul-Ahsans-article-on-Syed-Riazur-Rashid.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/11/Ziaul-Ahsans-article-on-Syed-Riazur-Rashid.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy