.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সন্দীপ দত্ত সংখ্যা : স্বপনকুমার মণ্ডল

মৃত্যুর পরে মানুষ বেঁচে থাকে অভাবে আর স্বভাবে। সেখানে স্বভাবের মহত্ত্ব ও বৃহত্ত্ব আপনাতেই অভাববোধের গরিমার চেয়ে অনেক বেশি সরব ও জনপ্রিয়। স্বাভাবিক ভাবেই সময়ান্তরে অভাববোধ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, বিকল্প অস্তিত্বে নিঃস্ব হয়ে যায়। ইতিহাসের পালাবদলে কালের পুতুল থেকে প্রতিমা সময়ান্তরে মূর্তি থেকে বেদিতে পরিণত হয়। তার পরেও অভাববোধের আভিজাত্যে মানুষের বেঁচে থাকার ইতিহাস নানাভাবেই প্রকাশমুখর হয়ে ওঠে। আসলে শূন্যতাতেই পূর্ণতার পরিচয় মেলে। একজনের অস্তিত্ব কতটা জায়গা জুড়ে ছিল, তা তার শূন্যতায় ক্রমশ নিবিড়তা লাভ করে। গাছের কাণ্ডের মতো জীবনের কাণ্ডকারখানা সবই জীবিতকালে দেখা যায়। তার মূল কতটা গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে, তা মৃত্যুর পরে আবিষ্কৃত হয়। সেখানে কারও অনুপস্থিতিই তার উপস্থিতির পরিসরকে বুঝিয়ে দেয় অবিরত। সেক্ষেত্রে সম্প্রতি প্রয়াত  লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্তের (২৪ জুলাই ১৯৫১-১৫ মার্চ ২০২৩) অভাববোধই তাঁর বেঁচে থাকার বিশল্যকরণী। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে যে শূন্যতাবোধ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তার মধ্যেই তাঁর অস্তিত্ব ক্রমশ অঙ্কুর থেকে মহীরূহ হয়ে ওঠার প্রতীক্ষায়। সময়ের পাকদণ্ডি বেয়ে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনকে নিয়ে তাঁর প্রায় সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময় (১৯৭৮-২০২৩) ধরে প্রদর্শনী থেকে সংরক্ষণ, লাইব্রেরি থেকে গবেষণা কেন্দ্রে বিস্তৃতির অভিনব কর্মতৎপরতাই তাঁকে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। প্রায় একক উদ্যোগে এরকম অসীম আত্মপ্রত্যয়ী সন্দীপ দত্ত নিজেই একটি লিটল ম্যাগাজিন। তাঁর অবর্তমানে তাঁর অতুলনীয় শূন্যতাই বলে দেয় বাংলার লিটল ম্যাগাজিন ঠিকানাহীনতায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে। সেই ঠিকানা যে তাঁর নিজের মতো করে তিনি তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন, তার প্রচার প্রসার ঘটিয়েছিলেন, তার মুখে আভিজাত্যের আলো ফুটিয়েছিলেন। সেই আলোয় সন্দীপ দত্তের মুখটি বহুদূর থেকে দেখা যেত, বহু সময় পরেও দেখা যাবে। সেই আলো যে তাঁর একান্ত আপনার,বহু ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও বাঁচিয়ে রেখেছিলেন একান্ত আপন করে। তিনি নিজেই লিটল ম্যাগাজিনের আলোকদিশারি হতে চেয়েছিলেন। সেই দুর্গম পথে তাঁর অভাব যে চিরকালের। তাঁকে বিস্মৃত না-হওয়ার পথ তিনি নিজেই সযত্নে আগলে রেখে গেছেন আজীবন। তাঁর লিটল ম্যাগাজিনময় জীবনে তিনি একাকী নিঃসঙ্গ পথে হেঁটেছেন, সঙ্গে সামিল করেছেন অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনের সৈনিককে, সাহারা দিয়েছেন অবারিত, অবিরত। তাঁকে বিস্মৃত হয় কার সাধ্যি!

আসলে বাংলায় লিটল ম্যাগাজিনের ব্রাত্য পরিসরকে সন্দীপ দত্ত যেভাবে সঞ্চয় থেকে সংরক্ষণ, প্রদর্শনী থেকে  লাইব্রেরি ও গবেষণার মাধ্যমে জনমানসে নিবিড় করে তুলেছেন, তাতে শুধু একজন সংগঠকের অসাধারণ ভূমিকাই উঠে আসে না, রীতিমতো একটি আন্দোলনের রূপ লাভ করে। সেক্ষেত্রে তাঁর ধারা ধারাবাহিক কর্মতৎপরতা শুধু লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে জনমানসের ধারণাই পরিবর্তিত হয়নি, লিটল ম্যাগাজিনের ধারক-বাহকদের মধ্যেও নতুন করে আত্মপ্রতিষ্ঠার সাধ ও স্বপ্ন জেগে উঠেছে। শুধু তাই নয়, লিটল ম্যাগাজিনের স্বল্পস্থায়ী জীবনও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, তার বিশ্বাসও সন্দীপ দত্ত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এজন্য পত্রিকার নতুন সংখ্যা বেরোলেই বেঁচে থাকার টিকা নেওয়ার জন্য সন্দীপ দত্তের কাছে হাজির হতো। সেখানে নির্বিচারে সকলের অবারিত দ্বার,অবিরত সমাদর। আশ্রয় অনেকেই দিতে পারে, প্রশ্রয় কেউ কেউ। আর প্রতিষ্ঠাদাতা বিরলপ্রায়। সন্দীপ দত্ত অত্যন্ত সচেতনভাবেই বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের আশ্রয় থেকে প্রশ্রয় এবং শেষে প্রতিষ্ঠার পথে ব্রতী হয়েছেন। সেখানে তাঁর আত্মসচেতন প্রকৃতি আপনাতেই শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। অন্য পাঁচজনের মতো তিনিও সাহিত্যচর্চায় সক্রিয় হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ছোটবেলা থেকেই তাঁর সাহিত্যানুরাগ একটু বেশি মাত্রায় ছিল। কলেজজীবনেই পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, সাহিত্য চর্চায় ভিড়েছেন। কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন, কাব্য ও প্রবন্ধের একাধিক বইও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। প্রবন্ধ-সংকলন সম্পাদনাও করেছেন তার মধ্যেই। আবার সেসবে বিরতিও টেনেছেন গভীর আত্মসচেতনতায়। লিটল ম্যাগাজিনের বহুমুখী প্রতিষ্ঠায় নিজেকে যত সক্রিয় করেছেন,ততই তাঁর স্বকীয় সাহিত্যচর্চা লিটল ম্যাগাজিনের প্রচার-প্রসার ও সমৃদ্ধি এবং গুরুত্ব প্রকাশে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তন-মন-ধন সব দিয়েই তিনি তার সেবা করেছেন।

১৯৭২-এর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পরিত্যক্ত আবর্জনার মতো করে জড়ো করে রাখা অনাদৃত সাময়িক পত্রপত্রিকাকে দেখে প্রতিবাদ করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। শেষে তার প্রতিবিধানে নিজেই উদ্যোগী হন। তাঁর কল্পনা ক্রমশ স্বপ্নের দিকে এগিয়ে চলে। অথচ তখন সন্দীপ স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র। অন্যদিকে ১৯৭০-এ কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে ‘পত্রপুট’ নামে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনাও করতে শুরু করেছিলেন। ক্রমে সেটিও তাঁর লিটল ম্যাগাজিন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৬-এ শুরু থেকেই তিনি কলকাতা বইমেলায় পত্রপত্রিকা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। অন্যদিকে সেই ছাত্রজীবন থেকেই তিনি নানাভাবে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে নিজের জীবনকে জড়িয়ে নেন। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে ও নানাভাবে সযত্নে সংগ্রহ করে প্রথমে ৬৫০টি পত্রিকা নিয়ে ১৮/এম্, টেমার লেনে নিজের বাড়িতে প্রদর্শনী করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পরে আরও শখানেক পত্রিকা নিয়ে লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র করেই ক্ষান্ত হননি, যাতে সেসবের সম্পদ ও সম্মান সমাদর লাভ করে তার জন্যও উদ্যোগী হন। টেমার লেনের বাড়ির নিচতলায় ১৯৭৮-এর ২৩ জুন তাঁর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান (তার আগেই তার সূচনা হয়েছিল। সর্বসাধারণের জন্য সে বছর থেকে যাত্রা শুরু হয়। তা নিয়ে গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত হয় পরের বছর ১৯৭৯-তে।) ‘বাংলা সাময়িক পত্র পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র’ই ১৯৯৬-এ সরকারিভাবে নথিভুক্ত হয়ে ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’ হয়ে ওঠে । এতে সাময়িক পত্রপত্রিকার মধ্যে তাঁর লক্ষ্য যে লিটল ম্যাগাজিনেই ছিল,তা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, লিটল ম্যাগাজিনের স্বতন্ত্র লাইব্রেরির আভিজাত্যও তাতে সুস্পষ্টতা লাভ করে। অন্যদিকে লিটল ম্যাগাজিন ও তার সম্পাদক এবং পিএইচ্. ডি গবেষককে প্রতিবছর সম্মাননা জানানোর মহতী উদ্যোগ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। সেক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিন ও তার সম্পাদকের প্রতি যে সম্মান প্রদানের সদিচ্ছার মধ্যেই লিটল ম্যাগাজিনের স্বীকৃতি ও সমাদরের গৌরব সৌরভ ছড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে লিটল ম্যাগাজিনের কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিককেও সম্মাননা প্রদান শুরু হয়।

অন্যদিকে গবেষক সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির নিবিড় যোগ তৈরি হয়। প্রতি বছর একাধিক কৃতী গবেষকদের সম্মানিত করার ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে উচ্চশিক্ষার বনেদি আভিজাত্য জুড়ে যায়। শুধু তাই নয়, পিএইচ্. ডি গবেষকের কাছে এই সম্মাননা গবেষণার কাজ করার প্রেরণা জোগায়, তার মনে স্বপ্নের ঝারবাতি জ্বালিয়ে দেয়। এই সম্মাননা বর্তমান লেখকও পেয়েছিলেন ২০০৭-এ। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ‘শিবরাম চক্রবর্তী: লেখকসত্তার বিবর্তন’ বিষয়ে গবেষণার জন্য ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’-এর মাখনবালা দাস স্মারক গবেষক সম্মাননা অর্পণ করা হয়েছে। গবেষণার মানের উপরেই এই সম্মাননা বিবেচনা করার কথা বলতেন সন্দীপ দত্ত। এরকমভাবে গবেষক সম্মাননা প্রদানের ধারাবাহিক আয়োজন ইতিপূর্বে কোনো প্রতিষ্ঠানে ছিল না। সেদিক থেকে তার অভিনবত্ব অনস্বীকার্য। বাংলার সারস্বত সমাজের সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কই শুধু নয়, একাডেমিক ক্ষেত্রেও যে লিটল ম্যাগাজিনের বনেদি ভূমিকা বর্তমান এবং তা উত্তরোত্তর আরও নিবিড়তা লাভ করেছে, সে ধারাটি যাতে অব্যাহত থাকে সেবিষয়ে সন্দীপ দত্তের অবিসংবাদিত ভূমিকাই তাঁকে অনন্য করে তুলেছে।

আসলে তিনি প্রথম থেকেই ছিলেন লক্ষ্যভেদী অর্জুন। লিটল ম্যাগাজিনকে নিয়েই তাঁর চিন্তাভাবনা প্রসারিত হয়েছে। লেখালেখির মধ্যে যেমন তা উঠে আসে, পত্রপত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তেমনই তাঁর পরিচয় মেলে। তাঁর মধ্যে ‘লিটল’-এর বৃহৎ ভূমিকাকে জনমানসে নিবিড় করার সদিচ্ছা ক্রমশ সক্রিয়তা লাভ করে,তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। অবশ্য তার জন্য অদম্য চালিকা শক্তি জরুরি। মনের জোর বেশি দূর স্থায়ী হয় না। নদীর নিম্নগতির মতো গতি হারিয়ে ছড়িয়ে পড়ে, অগভীর হয়। সেজন্য চাই তীব্র আঘাত ও যন্ত্রণা যা মনকে কুরে কুরে খায়, দেখিয়ে দেওয়ায় বা প্রমাণ করায় আত্মপ্রত্যয়ী করে রাখে আজীবন। তাও পেয়েছিলেন সন্দীপ দত্ত। ১৯৮২-তে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে  পিএইচ্. ডি করতে গিয়ে শুধু প্রত্যাখ্যাত হননি, রীতিমতো অপমানিত হয়েছেন। দিকপাল অধ্যাপক সুকুমার সেন তাঁর গড়ে তোলা বিশ্বাসকেই সরাসরি তীব্র আঘাত করে বলেন, ‘লিটল ম্যাগাজিন আসলে জঞ্জাল’। এরূপ মন্তব্যে তিনি আবার নতুন করে জেগে ওঠেন। আরও বেশি সক্রিয় হয়ে আসরে নেমে পড়েন। আঘাত যে শুধু দুঃখ দেয় না, এগিয়ে চলার রসদও জোগায়, পথচলার পাথেয়ও হয়ে ওঠে। সেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেই তিনি ‘লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা’র আয়োজন করেন। এতে শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র সরকার, শুদ্ধসত্ত্ব বসু, বার্ণিক রায়, দেবকুমার বসু প্রমুখের মতো বিশিষ্টজনদের উপস্থিতি তাঁকে বাড়তি অক্সিজেন জোগায়। পরবর্তীতে সুকুমার সেনের মন্তব্যকেই ধারণ করে তাঁর নীরব প্রতিবাদ সরব হয়ে ওঠে। তাঁর সেই ‘পত্রপুট’-এর বইমেলা সংখ্যায় লেখা হয় ‘জঞ্জাল রাবিশকে প্রশ্রয় দেবেন না’। অন্যদিকে ‘লিটল ম্যাগাজিন কিনুন/ লিটল ম্যাগাজিন পড়ুন’ লেখা শেফের মতো টুপি পড়ে নিজেই বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠেন। সেই টুপির সঙ্গে পরে তাঁর সাদা টি শার্টেও বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিনের চলমান বিজ্ঞাপনই সন্দীপ দত্তের স্ববাকমূর্তি লাভ করে।

অন্যদিকে ১৯৮৯-এ অখ্যাত ও অজ্ঞাত লেখকদের জন্য সন্দীপ তৈরি করেন ‘লেখক ব্যাঙ্ক’ নামে একটি অভিনব উদ্যোগ নেন। তাতে উপেক্ষিত, বঞ্চিত লেখকদের লেখা সংগ্রহ করে প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য বছর তিনেক চলার পর তা বন্ধ হয়ে যা। তা যে তাঁর লিটল ম্যাগাজিন নিয়েই চিন্তাভাবনাপ্রসূত, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আবার তিনি ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’ থেকে লিটল ম্যাগাজিনের মহার্ঘ অথচ দুর্লভ লেখা পুনর্মুদ্রণ করে প্রকাশের জন্য ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ নামে ব্যতিক্রমী একটি পত্রিকা নিয়মিত ভাবে প্রকাশ করতেন। এমনকি, ইংরেজি ভাষায় একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করা যায় কিনা,তা নিয়েও ভেবেছিলেন। সবদিক থেকেই তাঁর সক্রিয় উদ্যোগ ছিল লিটল ম্যাগাজিনের ব্রাত্য পরিসরকে আভিজাত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। সেক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে  তাঁর স্বচ্ছ ধারণাই তাঁকে সে কাজ ব্রতী করেছিল। সেই কাজের ধারাবাহিকতাই তাঁর ব্যতিক্রমী পরিচয় ক্রমশ নিবিড় হয়ে ওঠে। বিশিষ্ট লেখক সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘ধ্রুবপদ’ (এটি লিটল ম্যাগাজিন নয় বলে সম্পাদকীয়তে জানিয়েছেন।) পত্রিকার ‘অন্য রকম বাঙালি’ (২০০৭)-তে স্বাভাবিক ভাবেই ঠাঁই পেয়েছেন সন্দীপ দত্ত। সেখানে তাঁর চিন্তায় লিটল ম্যাগাজিনের পাঁচটি বিশেষত্ব উঠে আসে: ‘১. যে কোনো দেশ জাতির সাহিত্য সংস্কৃতির প্রধান ধারক ও বাহক সেই দেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলি। ২. লিটল ম্যাগাজিনের অবস্থান বিগ ম্যাগাজিনের বিপরীতে। ৩. লিটল অর্থাৎ কম পুঁজিতে বৃহৎ চিন্তার প্রকাশ। ৪. লিটল ম্যাগাজিন যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির বিরুদ্ধ। ৫. জাতীয় জীবনের কোনো সাম্প্রতিক সমস্যা বা জ্বলন্ত বিষয় নিয়ে জনমত গড়ে তোলা।’ লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অস্তিত্ব সংকটের সমূহ সম্ভাবনা। ঈহা মানে ইচ্ছা থেকে ঐহিক বা মনের মিলে ঐক্যের আধারে ক্ষুদ্রের বৃহতের হাতছানি সময়ান্তরে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। উপেক্ষা ও অবহেলায় ইচ্ছে মরে যায়, ঐক্য ভেঙে পড়ে। লিটলের বারুদ অজান্তেই নিঃস্ব মনে হয়। সেক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষত্বে অনিয়মিত ও স্বল্পায়ু যেমন স্বাভাবিকতা লাভ করে, তেমনই তার সাধ ও সাধ্যের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে সীমিত পরিসরেই তার অস্তিত্বের প্রকাশ আকাশ হতে চায়। তাতে অনেকের মনে হতে পারে বামনের চন্দ্রস্পর্শাভিলাষ। যেমনটা সুকুমার সেনেরও মনে হয়েছিল। অথচ দেহের উচ্চতায় নয়, মন ও মানের উৎকর্ষে লিটল ম্যাগাজিনের সেই অভিলাষ অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং অবাস্তব নয়। সন্দীপ দত্ত লিটল ম্যাগাজিনের সেই অপরিহার্য প্রকৃতিকেই সবুজ করে তুলেছেন।

মূল্য থাকলেই লোকে রক্ষা করে,আর তা বাড়লে আগলে রাখে। অমূল্য হলেই করে সংরক্ষণ। সন্দীপ দত্ত লিটল ম্যাগাজিনের মূল্য বাড়িয়ে সংরক্ষণ করেই ক্ষান্ত হননি, অমূল্য করে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। আর তা তিনি করেছেন যথাসময়ে। সময়ে জল ধরে রাখতে না পারলে গ্রীষ্ম ও বর্ষা এক হয়ে যায়। বিশ শতকের সত্তরের দশকে সময়ের অস্থিরতায় লিটল ম্যাগাজিনের জোয়ার এসেছিল।  আশির দশকে আসে তার বৈচিত্র। সন্দীপ দত্ত সেই সময়ে তাঁর অভিযান শুরু করেছিলেন। তিনি সেই ‘জঞ্জাল’ সাফাই করেননি, বরং আরও সংগ্রহে সক্রিয় থেকেছেন, আগাছার মতো বাড়িয়ে তোলাতেও অগ্রসর হয়েছেন। বই জরুরি, লিটল ম্যাগাজিন অপরিহার্য। সেক্ষেত্রে বইমেলার সঙ্গেই শুধু নয়, সমান্তরাল ভাবে চলার ফলে জেলায় জেলায় লিটল ম্যাগাজিন মেলার বিস্তারেও তাঁর অবদান স্মরণীয়। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি ভাবে তার আয়োজনেও সন্দীপ দত্তের ভূমিকা সমীহ আদায় করে নেয়। বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় নয়, লিটল ম্যাগাজিনেই দেশ ও জাতির পরিচয় আন্তরিক হয়ে ওঠে। মাটির মানুষের যোগ যে পত্রিকায় নিবিড় হয়ে ওঠে, সেই লিটল ম্যাগাজিনই অবজ্ঞা ও অবহেলায় শিকার হয়ে ওঠে। সন্দীপ দত্ত সেই শিকারকেই অস্বীকার করাতে ব্রতী ছিলেন আমৃত্যু। মৃত্যুর আগে বেশ কয়েক মাস দেখেছি নিয়মিত ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন। তাতে লিটল ম্যাগাজিনের অমূল্য সম্পদ নিয়ে পোস্ট করতেন, আবার অখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ও সম্পাদকের জন্ম-মৃত্যুতে শুভেচ্ছা ও শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁর এসবের মধ্যেই লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলনের পরিচয় আন্তরিক হয়ে ওঠে। আন্দোলন আভিজাত্য লাভে বিপ্লবে পরিণত। লিটল ম্যাগাজিনের সার্বিক স্বীকৃতি ও মান্যতাতে তাঁর আন্দোলনের সেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষণীয়। লিটল ম্যাগাজিন আজ বাণিজ্য পত্রিকার পরিপূরক হিসাবে মান্য ও সমাদৃত। শুধু তাই নয়, সন্দীপ দত্তের অপূরণীয় অনুপস্থিতিও বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় জায়গা দখল করেছে। সেখানে তাঁর আন্দোলনের বড় সাফল্য। সব থেকে তাঁর বড় জয় তিনি নিজেই আজ গবেষণার বিষয়আশয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় প্রত্যাখ্যাত তরুণটিই যে লিটল ম্যাগাজিনের জঞ্জালের স্তূপের মধ্যে অবিরত অমূল্য রত্ন ভাণ্ডারের হদিশ দিয়ে ও তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তোলার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। অজানা খনির পরশমণিকে শুধু বিশ্ববিদ্যাচর্চায় নিবিড় করেননি, জনমানসে দিয়েছেন বনেদি আভিজাত্য। সেক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের আরও এক নাম সন্দীপ দত্ত। নিজের জীবন উৎসর্গ করেই তিনি তাকে মননের উচ্চাসনে বসিয়েছেন। পুরাণে ভগীরথ সাধনা করে গঙ্গাকে মর্তে এনেছিলেন। একালে সন্দীপের সাধনা ভগীরথের বিপরীতে, আরও কঠোর ও কঠিন। তিনি লিটল ম্যাগাজিনকে মর্তের ধূলিকণা থেকে মননের স্বর্গে স্থায়ী করেছেন। সাধারণের অসাধারণ প্রকাশে সন্দীপ দত্ত যে নিজেই একটি চলমান লিটল ম্যাগাজিন ছিলেন, তা তাঁর অসমসাহসী একক লড়াইয়েই প্রতীয়মান। তাঁর লড়াই থেমে গেলেও তাঁর লিটল ম্যাগাজিনের লড়াই জারি রেখে গিয়েছেন। লিটল ম্যাগাজিনের প্রেরণা, শক্তি ও সাহস সবই যে তিনি উজাড় করে ছড়িয়ে দিয়েছেন শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে, দেশ থেকে দেশান্তরে। মৃত্যুতে হাত অকেজো পড়ে, কিন্তু  হাতছানি চলে অনন্তকাল। লিটল ম্যাগাজিনের সেই হাতছানির নামও সন্দীপ দত্ত।

সন্দীপ দত্ত: লিটল ম্যাগাজিনের আধুনিক ভগীরথ
স্বপনকুমার মণ্ডল


মন্তব্য

BLOGGER: 1
  1. লিটল ম্যাগাজিন অন্তপ্রাণ সন্দীপ দত্তকে বাংলাদেশ থেকে এভাবে সম্মান জানানো কেবল বিন্দুর পক্ষেই সম্ভব৷ সেলুট জানাই সম্পাদক সাম্য রাইয়ানকে

    উত্তরমুছুন
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সন্দীপ দত্ত সংখ্যা : স্বপনকুমার মণ্ডল
সন্দীপ দত্ত সংখ্যা : স্বপনকুমার মণ্ডল
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhM8L2XeOb1R0l-kwYryhtOWiv2NoT83u4EJ_BV21Og7mvs5TpuzfZAMWK33Q8VN4K8Hbl74Ai85AiRhp7XkpmxZiIZ0NBlM-rYnpYAp8iiPJUdZwifgwIkYIb9jowS-lTj9dUE8sZrwgORSrxXnddE3OqhxFuRMSF1SZurDn8aEzz2QZATLrhliIeUAHc/s16000/sandip-datta-bindu-littlemag-cover.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhM8L2XeOb1R0l-kwYryhtOWiv2NoT83u4EJ_BV21Og7mvs5TpuzfZAMWK33Q8VN4K8Hbl74Ai85AiRhp7XkpmxZiIZ0NBlM-rYnpYAp8iiPJUdZwifgwIkYIb9jowS-lTj9dUE8sZrwgORSrxXnddE3OqhxFuRMSF1SZurDn8aEzz2QZATLrhliIeUAHc/s72-c/sandip-datta-bindu-littlemag-cover.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/12/swapan-kumar-mandal-article-on-sandip-datta.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/12/swapan-kumar-mandal-article-on-sandip-datta.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy