.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সলমা-জরির কাজ অথবা উৎপলকুমার বসুর আশ্চর্য ভূবন │ মাছুম কামাল

সলমা-জরির কাজ অথবা উৎপলকুমার বসুর আশ্চর্য ভূবন │ মাছুম কামাল
১.
ও শ্বেত বৈধব্য, পাখি, তুমি কারাগার রৌদ্র থেকে ফেলে দাও গরাদের ক্রমপরম্পরা গরাদের মধ্যে থেকে মাল্যবান পাহাড়ের ব্যাকুল লাক্ষাবনে আমারো মস্তিষ্ক, নেশা, চৈতন্য, সমাধি পাদ্রীদের, সন্ন্যাসিনীদের হাতে চলে গেছে।

কবির নাম উৎপলকুমার বসু। কবিতা বইয়ের নাম ‘পুরী সিরিজ’। বাংলা কবিতায় উৎপলকুমার বসু আলাদা কাব্য ভাষায় অনন্য। এবং সন্দেহাতীতভাবেই একজন বড়ো কবি, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না নিশ্চয়। উৎপলকুমারের কবিতার সাথে পরিচিত, কবিতার সত্যিকারের পাঠক এ কথা নির্দ্বিধায় মেনে নেবেন বলি বিশ্বাস করি। ভাষার এমন ছান্দসিক, চকচকে রুপোর পয়সার মত কাজ এত অনন্যভাবে বাংলা ভাষার কবিতায় খুব কমই হয়েছে।

উৎপলকুমার বসু (৩রা আগস্ট ১৯৩৯-৩ অক্টোবর ২০১৫) বাংলা সাহিত্যে মূলত হাংরি আন্দোলনের একজন খ্যাতনামা কবি হিসেবে অধিক পরিচিত। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলে অনেকেই বলে থাকেন। যদিও পাঠসূত্রে বা চিন্তার ব্যাপ্তিতে তিনি সার্বজনীন।

পরে, আন্দোলনের সূত্রে ১৯৬৪ সালে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৬৫ সালে তিনি লন্ডন চলে যান। এবং দুই দশক কবিতা লেখালেখি থেকে বিরত থাকেন। তবে, কবিতা না লেখার জন্য কোনো আপোষ তিনি করেননি। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১১টি:

    ১. চৈত্রে রচিত কবিতা (১৯৬১)
    ২. পুরী সিরিজ (১৯৬৪)
    ৩. আবার পুরী সিরিজ (১৯৭৮) [পুরী সিরিজ-১ এর সংস্কার করা, পরিমার্জিত সংস্করণ]
    ৪. লোচনদাস কারিগর (১৯৮২)
    ৫. খণ্ডবৈচিত্রের দিন (১৯৮৬)
    ৬. শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯১)
    ৭. সলমাজরির কাজ (১৯৯৫)
    ৮. পদ্যসংগ্রহ (১৯৯৬)
    ৯. কহবতীর নাচ (১৯৯৭)
    ১০. নাইট স্কুল (১৯৯৯)
    ১১. টুসু আমার চিন্তামনি (২০০০)

উৎপলকুমারের কবিতার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ‘নবধারাজলে’ নামক একটি কবিতা দিয়ে। অত্যন্ত জনপ্রিয় কিংবা তার নিজস্ব কাব্যভাষার স্বাক্ষর বহন করা কবিতাটা এখানে উল্লেখ করছি—

মন মানে না বৃষ্টি হলো এত
সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পারে
আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের অধিকারে।
স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল
অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার,
তোমার গ্রামে, রেলব্রিজের তলে,
ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার।

এই কবিতাটা তার প্রথম কবিতার বই ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ (১৯৬১) নামক বইয়ে অন্তর্ভুক্ত। এই কবিতাটায় খেয়াল করলে দেখা যাবে, কী চমৎকার এক দৃশ্যকল্পের মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। যার পাঠোত্তর মোহগ্রস্ততা অনেক-অনেকদিন মগজে থেকে যায়।

২.

এরপর তার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘পুরী সিরিজ’ হাতে আসে। এই বইয়ের কবিতাগুলিও তুমুল জনপ্রিয়। তবে, ভাল কবিতা জনপ্রিয়তার তোয়াক্কা করে না। বইয়ের কবিতাগুলি বিভিন্ন সময়ে অনেকবার পাঠ করেছি। এবং কখনোই ক্লিশে মনে হয়নি। বরং রক্তের ভেতর স্বার্থক কবিতা পড়বার এক স্নায়ুবিক, হালকা ঘাম দেয়া স্পন্দন অনুভব করেছি। এই বইয়ের একটা কবিতা (পুরী সিরিজ-১) থেকে উদ্ধৃতি দিতে চাই—

এখন তোমার মুখ চামচের মতন উজ্জ্বল তোমার বিনষ্ট মুখে রুধিদের বিসম্বাদী ডৌল
টলায় নাবিক, পণ্য, কফি, নুন, কস্তুরী, গন্ধক,
নাকছাবিটির হীরা—এত বস্তুগত সবই!

কবিতার অন্তর্গত ব্যাখ্যা দিতে চাওয়া কোনো কাজের কথা নয়। কিন্তু, এই যে উপমা, এবং অলংকারের ব্যাবহার, এ যেনো সূর্যের পরিষ্কার রৌদ্রতেজ, অধিকন্তু তা চোখ ধাঁধিয়ে দেয় না। বরং এক স্নিগ্ধ আবেশ তৈরি করে। এবং কবির ভাষায় যা ‘বস্তুগত’ মোটেই সেরকম নয় এ কবিতা, তারচে' বেশি কিছু; পরম অনুভবের।

উৎপলকুমার বসুর এই কাব্যভাষা এবং এর ব্যবহার দিয়ে অনেকেই প্রভাবিত হয়ে কবিতা লিখেছেন। এটাও কি তার কবিতার শক্তির একটা প্রকাশ নয়? আমি তো অন্তত তাই মনে করি। সে ভাষার দ্যুতি আরেকটু ছড়িয়ে দিতে চাই।
‘পুরী সিরিজ’ থেকে পড়া যাক আরেকটা কবিতা—

দূর থেকে হাত তোলো। যদি পারো জানাও সম্মতি।
নইলে সঙ্কেত আজো বৃথা যায়। চলে যায় নৈশ ট্রেন দূরে
অর্ধেক জাগ্রত রেখে আমাদের। অবিরত যাত্রা কি কাঠের?
লোহার কোরক থেকে আজো দীর্ঘ প্রতিধ্বনিময়
স্টেশনে স্ফুলিঙ্গ পড়ে। দরজায়, উজ্জীবিত নীড়ে
ভাঙা হাত, নষ্ট চোখ, মনে রেখো সেই দুর্ঘটনা।
চলেছি নির্বাণহীন, ক্রাচে বাহু, অন্ধের বিত্ত নিয়ে খেলা
আমাদের প্রস্তাবে কোনোদিন দিলে না সম্মতি।

এই কবিতা পড়ার পর সত্যিই এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকতে হয়। মাথার ভেতর যেনো শব্দের, উপমার এক অব্যর্থ ব্যঞ্জনার ঘোর থেকে যায়, বহু-বহুক্ষণ। উৎপলকুমারের কবিতার আলোচনার জন্য তার কবিতার চাইতে চমৎকার কোনো ইশারা বা ব্যাখ্যা হয় না।

৩.

এই লেখাটা লেখার বেশ কিছুদিন আগে হাতে আসে উৎপলকুমার বসুর আরেকটা কাব্যগ্রন্থ ‘সলমা-জরির কাজ’। বই থেকে আমার খুবই প্রিয় একটা কবিতা উদ্ধৃত করতে চাই—

বন্ধু, তোমার হাতের উপর হাত রাখলেই আমি টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা, ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে, মেয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে, আজ যা বলার আছে তুমি আমাকেই বলো, স্ত্রীর মুখরতার কথা বলো, সহকর্মীদের শঠতার কথা বলো, 
রাতে ঘুম হয় না সেই কথা বলো, আর যদি কাঁদতেই হয় তবে এই কাঁধে মাথা রেখে কাঁদো, বন্ধু।
(সলমা-জরির কাজ ৭)

কবিতাটির বিষয়বস্তু আমরা যদি বাস্তবিকভাবে মিলিয়ে নিতে চাই, তবে এরকম লোক কি আমরা খুঁজে পাব না? নিশ্চয় পাবো। এই যে দৃশ্যকল্প কবিতার, আমরা পড়তে পড়তে কারো না কারো মুখ বসিয়ে নিতে পারি, এখানেই কবিতার রস। যার আস্বাদনে কবিতা-পাঠকমাত্রই থাকেন। এই বইয়ের আরো কয়েকটা কবিতা আছে এমন দৃশ্যকল্প নির্ভর। উৎপলের কবিতাগুলি আমাদের কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতাকে এমন জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে, যার সন্ধানে কবিতার খাঁটি পাঠকেরা থাকেন। 

উৎপলকুমারকে এখনো পড়ি। মুগ্ধ হই। সমালোচনা করি, সেটা শুধুমাত্র তার কবিতার জন্যই। এবং একজন কবির বোধ করি এটাই স্বার্থকতা। কবি উৎপলকুমার বসুর জন্য ভালবাসা। শেষ করছি (সলমা-জরির কাজ ১১) কবিতা দিয়ে—

জেগে উঠেছে বাতাস তার পুর্বাপর নিয়ে 
যেন আমার ছেলেবেলার কুসুমপুরে বিয়ে 

ন-মাসিমার। হে শুকতারা, হে হিমতারাসকল, 
ছড়ায় থাকো, ছন্দে থাকো, রৌদ্রবাহী জল 

সাঁকোর নিচে জীবিত থাকো, ট্যাঙরা মাছও প্রাণী, 
বস্তু শুধু শাশুড়িমাতা, তাঁর পানের বাটাখানি 

বস্তুবাচক। বয়েস হল অনেক, হল বয়েস, 
মানুষ বুড়ো, বৃক্ষ বুড়ো, বুড়ো আমার দেশ, 

শোলার মধ্যে আগুন, আর আগুনপুড়ো খড়, 
হেসে বলি ওরে জামাই আমরা যে তোর ঘর 

ন-মাসিটি নামেই মাসি, বোনের চেয়ে পাজি, 
স্বর্গে যাবে, নরকে যাবে, হায়, কুসুমপুকুরেও রাজি 

জন্মমতো চলে যেতে, যাবেন শ্মশানঘাট দিয়ে, 
সেথা জেগে উঠেছে বাতাস তার পূর্বাপর নিয়ে।



মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,25,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সলমা-জরির কাজ অথবা উৎপলকুমার বসুর আশ্চর্য ভূবন │ মাছুম কামাল
সলমা-জরির কাজ অথবা উৎপলকুমার বসুর আশ্চর্য ভূবন │ মাছুম কামাল
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgZ3SnMYLfS25engwZC5M4aRE1FoTfQA_SqoyVFnYWcd1Vqec0fRlsHm15c81KMIE5VuqK0ucBFIg9xqAuxc31cOJODNlPYU4XHK2gkKfnerwyXrMxjJXpDgTMnio0qVraj74reozJ3EI4/w640-h320/%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%259B%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE-%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B2.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgZ3SnMYLfS25engwZC5M4aRE1FoTfQA_SqoyVFnYWcd1Vqec0fRlsHm15c81KMIE5VuqK0ucBFIg9xqAuxc31cOJODNlPYU4XHK2gkKfnerwyXrMxjJXpDgTMnio0qVraj74reozJ3EI4/s72-w640-c-h320/%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%259B%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE-%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B2.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2020/08/blog-post_11.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2020/08/blog-post_11.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy