.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

অভিজিৎ বসুর প্রবন্ধ: ডানা অলা মোমবাতি খুন

অভিজিৎ বসুর প্রবন্ধ: ডানা অলা মোমবাতি খুন
প্রতিদিন  সকাল  থেকে রাত পর্যন্ত  কতোগুলো ছায়ার সাথে বসবাস। নিজেকে নিজের আগুনে পুড়তে দিলে দেখি নিয়তি ছুটছে উদোম শরীরে। শবের উত্থানে সূর্যকে নিয়ে এ এক বাজি ধরার খেলা। হয়তো হেরেও চলে কেউ। শ্বাস নেওয়ার মতো ডুব দিতে থাকি হলুদ জলের ভেতর। রক্তের সাথে ভারাক্রান্ত আকাশের বিনিময়। হয়তো কেউ ভাবে শালা পাগল।আর এই উচ্চারণে কুরোশোয়ার ছবির সাথে দেরিদা,ফুকো,ফ্রয়েড চেতনার আঁতলামি ঘ্রাণ।

মাথার ভেতর ঢুকে চলে উৎপলকুমার বসুর কবিতা। সাইলেন্ট সিনেমার মতো চার্লি চ্যাপলিন ঘুরে চলে মাথায়।

উৎপলকুমার বসুর জন্ম ১৯৩৭ সালের ৩ আগস্ট কলকাতায়। কিন্তু তাঁর ছেলেবেলার বেশি সময় কেটেছে কুচবিহারের দিনহাটায়। মা অসুস্থ হওয়ায় মাসি তাঁকে দিনহাটায় নিয়ে আসেন। কয়েক মাস পরেই কবির মা মারা যান। তারপর দিনহাটায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সময়টা ছিল বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ। তখনকার দিনহাটা আজকের মতো এত উন্নত ছিল না। বৈদ্যুতিক আলো পৌঁছায়নি তখনও। দিনহাটার রূপকার কমল গুহ মহাশয়কে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর উৎপলকুমার বসু আবার কলকাতায় চলে যান। সেখানে তাঁর বাবা তাকে স্কটিশ চার্চ -এ ভর্তি করিয়ে দেন। তারপর আশুতোষ কলেজ থেকে বিএসসি ও প্রেসিডেন্সি থেকে এমএসসি করেন।পড়বার সময় থেকেই লেখালেখিতে আত্মপ্রকাশ।

আলোক সরকার, কালীকৃষ্ণ গুহ, প্রকাশ কর্মকার এবং ভূমেন্দ্র গুহের সঙ্গে যুক্তভাবে উৎপলকুমার বসু এক সময় সম্পাদনা করেছেন কবিতা ও কবিতাবিষয়ক ভাবনার পত্রিকা দরগারোড।

কবিতাজীবনের শুরুতেই নিজের সঙ্গে চলমান ছায়ার সংঘর্ষ হয়েছে। হাংরি প্রজন্ম আন্দোলনের আভায় ডুবে ছিল তার প্রকাশভঙ্গি ও কবিতার টেনে আনা আত্মা। এই আন্দোলনসূত্রে ১৯৬৪-তে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়; ফলে যোগমায়া কলেজের অধ্যাপনা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হয় তাঁকে। কবিতা লেখা থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছেন বটে কিন্তু কবিতার অদৃশ্য বীজ বহন করেছেন অনুরক্ত চুমু খাওয়ার মতো করে। ভূতাত্ত্বিক জরিপ ছিল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়নের বিষয়। দেশে-বিদেশে এই বিষয়ে গভীর পাঠ তাঁকে পথ দেখিয়েছে নতুন এক পথের। পরীক্ষা নিরিক্ষার অনুধাবন আর গভীর বোধ নতুন রাস্তায় এনে দাঁড় করালো কবির ভেতরগত দৃষ্টিকে। দ্বীপান্তরের দ্বীপে নীল আগুন। তাই সমসাময়িকের হাজারো গোলক ধাঁধার পথে তাঁকে আমরা পাই যেন এক অভিমানি-নিঃসঙ্গ দ্বীপের স্বপ্নবাজ কবিতার মতো।

লেখালেখির প্রথম দিকে পুজো সংখ্যার দেশ এ লেখা প্রকাশিত হয় তাঁর। ওঠা বসা ছিল আনন্দ বাগচী, দীপক মজুমদার ,দীপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এঁদের সঙ্গে। ক্রমশ কৃত্তিবাস পত্রিকার ঘরের লোক হয়ে উঠলেন তিনি। দীপক মজুমদার কবিতা চাইতেন না, চাইতেন কবিতার খাতা। যোগাযোগ হয় শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে। বোনের বিয়ে হয় শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে। বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি চাকরি ছেড়ে চলে যান প্যারিসে। সেখান থেকে লণ্ডন। লণ্ডনে এডুকেশন অথরিটি তাঁকে পড়াতে বলেন। সেখানে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্ট ও আরও বেশ কিছু সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। তাঁর বন্ধুত্ব ছিল 'ব্যান্ডিট কুইন' -এর লেখিকা মালা সেনের সঙ্গে। লণ্ডন আর প্যারিসে থাকার সময় ফিল্ম মুভমেন্টের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। প্রায় এক যুগ কাটিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। যোগদান করেন মেঘমল্লার-এ। শুরু হল পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে নতুন করে সাহিত্য আড্ডা ও সাহিত্য চর্চা। পরবর্তীকালে নব্বই দশকের শুরুতে এই উদ্দেশ্যেই তাঁর প্রস্তাব ও পরিকল্পনা।

উৎপলকুমার বসুর কবিতা ‘স্তম্ভের লাইন’,
কোনে দিন,কোনো খানে তুমি তাকে মুক্তি দিয়েছিলে,
এখন কপাল তার ভরে গেছে চন্দনে, চুমোয়

শ্মশানের ধারে বসে থাকি। উষ্ণ মাংসের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় পোড়া এক ঘ্রাণে অবিরাম  ছুটে চলেছে কান্নার বোল। শেষ বিকেলের লাল সূর্য মাঠের আলোয় প্রতিফলনের পরে অর্ধদগ্ধ হিজিবিজি পাণ্ডুলিপিতে হানা দিচ্ছে। পাতলা একটা যন্ত্রণার নেমে আসে। শিউরে উঠি। কেউ আমাকে নিয়ে চলে আরো সামনে। আগুনের কাছাকাছি। পবিত্র হাসি আর পাপবোধ নারীর স্তন চুষে চুষে টানার মতো দেবতারা ভুলে যায় পথ।
উৎপলকুমার বসুর লাইন, এই নদী অশ্রু নদী তবে।
'কৃত্তিবাস', ‘কফি হাউসের আড্ডা’, হাংরি জেনারেশনের ক্ষুধার্ত ভাবনায় সব এলোমেলো করে তোলা ও পোস্টমডার্ন মানসিকতাকে সামনে রেখে নতুন করে জীবন শুরু হয় তাঁর । কবি হিসেবে উৎপলকুমার বসুর প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা একই সময়ে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চৈত্রে রচিত কবিতা' (১৯৬১) -র ভাষা কবিতার শব্দগুলোর বুকে চপেটাঘাত করার মতো ব্যাপার। অনেকটা প্যারাডক্স খেলার মতো।
‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের গত পূর্ণিমায় কবিতার কয়েকটা লাইন,
জ্যোৎস্না এখানে নেই। তাকে কাল হাই-ইস্কুলের
পোড়ো বারান্দার  পাশে দেখা গেছে।সে তার পুরনো
আধো নীল শাড়িটি  বিছিয়ে ঐখানে শুয়েছিল।
গতানুগতিক হাঁটার চলনকে বদলে নিলেন পরিমিত শব্দ চয়নে। তাঁর কবিতায় ছিল সাবকনশাসনেসের মিথোলিজক্যাল টার্মের ব্যাপার। অনেকটা যাদুকরের মতো।

‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ বাংলা কাব্যে আলাদা অনুরণনের জায়গা। আর যেখানে তরুণ কবিরা হয়ে উঠেছেন এক স্নিগ্ধ যোদ্ধা। বারেবারে সেই পাঠে সভ্যতার পাঠও বিন্যাস এসেছে তাদের কাছে।

১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘পুরী সিরিজ’। বইটি আকারে চটি হলেও সমসাময়িক সময়কে ধরতে পেরেছে দারুণভাবে। রহস্যময় বাক্যবিন্যাস, জটিল অবচেতন মনের ভেতরগত দর্শন। বিনিময় প্রথার এক দারুণ মিশেল। বিশেষ পদ্ধতিতে পাঠকও উন্মোচন করেন এর ভেতরের মশলাদারই উপাদান। পূনর্গঠন প্রক্রিয়ায় কবি আর কবিতা আর পাঠকের ভেতর যোগসূত্রের দারুণ সূত্র সংযোগ।
‘পুরী সিরিজ’ কাব্যগ্রন্থের শাদা ঘোড়া কবিতায়,
পশ্চিমে চালুর দিকে। পিতৃহীন রণ-ক্লান্ত মধ্যদেশ জানে
প্রবল হাতুড়ি গড়ে ধর্ম শুধু। পড়ে গেছে সাড়া
অদ্ভুত বাতাস-তাকি দোলা দেয়
খেজুরমর্মরে

১৯৭৮ -এ দীর্ঘ প্রবাস থেকে ফিরেও তীক্ষ্ণ এক সুতীব্র চিৎকারে বিনির্মাণ করলেন ‘আবার পুরী সিরিজ’। এখানেও ফুটে ওঠে ঢেউতোলা জীবন আর জনপদেরই কথকতা। আর অতল সেই জলে ডুবে যাওয়ার ইঙ্গিত। যেখানে পাঠককেই দায়িত্ব দেওয়া হয় উন্মোচন করার কৌশল।
‘আবার পুরী সিরিজ’ কাব্যগ্রন্থের একটা কবিতা ভাবায় বেশ। কবিতার নাম ‘আগুন আগুন’,
তোমাদের বিচলিগাদায় আমাকে দিয়েছে ঘর-গ্রীষ্মে এত আগুন লাগাব, জেনো,এই গ্রীষ্মে-আমি নিরুপায়-তোমাকে লাফিয়ে যেতে দেখব তোমার পুকুরের জলডিঙিটির দিকে-তোমার অস্বাভাবিক খাঁচার চকোরগুলি নষ্ট হয় হোক-পুকুরের শাপলায় তুমি নষ্ট  হও-

হলুদ খামের ভেতর গেঁথে থাকে পুরনো প্রেম, পুরনো স্মৃতি, পুরনো পঙক্তি। ব্যর্থতার সাথে বসবাস আমার। ঝিনুকের মতো ক্ষুধার উদ্রেক হলে গভীরতর জল ঘুমন্ত কাঠের মলাটের এসে থেমে যায়। জীবন তারপরও কেমন যেন চলে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা চোখ। মাছি উড়ে গেলে বিমূর্ত ভাবনার আফ্রোদিতির নেশা ধরে যায়। নেশা...

১৯৮২ তে প্রকাশিত ‘লোচনদাস কারিগর’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটির নাম ‘সই লুডো খেলা’—
মূক তুমি তাকিয়ে রয়েছ ঠান্ডা ভাতের থালার দিকে
কী দেখছ তুমি জানো আধ-হাতা ডাল

গদ্য আর কবিতা মিশেল উৎপলকুমার বসুর গদ্যে। কৌরব প্রকাশনী থেকে ১৯৯৪-তে প্রকাশিত হয় উৎপলকুমার বসুর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ধূসর আতাগাছ’। এরপর প্রতিবিম্ব প্রকাশনী থেকে বের হয় তাঁর কয়েকটি গল্প। উৎপলের গদ্য পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে এ এক এলোমেলো সময়ের ভেতর চলন। উৎপলের গল্প পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে কবিতার ঠাস বুননে হয়ে উঠেছে গল্প।
‘বাবুরাম প্রচারশিল্প’, ‘সরলতা মিরর হাউস’, ‘ধূসর আতাগাছ’, ‘বড়দিন’, ‘ঘড়ি’, ‘নরখাদক’, ‘টোকিও লন্ড্রি’, ‘একদিন’, ‘শীতের সকালে’, ‘রত্নাকর দেখেছিল’ এমন দশটি গল্পে উৎপল বসু খুলেছেন সাহিত্যের আরেকটি জংশন, যেখানে আখ্যানের তীরন্দাজের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হয়েছে। আর রক্তের অনুভবের ভরাট স্বরের দেখা পেয়েছি । এক পাতার ‘সরলতা মিরর হাউস’ থেকে ‘রত্নাকর দেখেছিল’র মতো দীর্ঘ গল্প লিখেছেন তিনি। দু-একটি উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যাবে উৎপল বসুর গল্পগদ্যের ধার। স্বতন্ত্র লেখা হিসেবেও পাঠ করা চলে। এমনকি  একটি গদ্যে বিভিন্ন অংশের আলাদা আলাদা ঘর আছে। সুতরাং আপনি যে কোনাে দরজাতেই কড়া নাড়তে পারেন। আর খুলে যাবে সিম সিম একটা গুপ্ত গুহা। যেখানে লুকানো আছে এলোমেলো  ভাবে বিভিন্ন  রত্ন ভাণ্ডারের।

‘ধূসর আতাগাছ’ গদ্যে:
কাজেই দেখা যাচ্ছে স্তব্ধতা আমাদের আজো বিচলিত করে।
অনিশ্চয়তা ভালো লাগে না। চুপ-করে-থাকা লােকের দিকে তাকিয়ে ভয়
হয়। সকাল আটটা গড়িয়াহাটের মিনিবাসে। ড্রাইভার আসেনি।
ক্লিনার এক টুকরো দড়ি খুজে বেড়াচ্ছে। স্কুল যাত্রী একটি বালক উঠে এসে
সামনের দিকে বসে। তারপর চিৎকার করে দুরের বন্ধুকে ডাকে : ঘােষ,
এদিকে আয়, জায়গা রেখেছি
বাপ-কা-বেটা ঐ বালকটির দিকে তাকিয়ে আমার আজ সকালের স্তব্ধতা।
ভাঙে
এবং মনে পড়ে কিছুদিন আগে পুরুলিয়া ক্যাম্পে এইভাবে সকালবেলার
স্তব্ধতা ভেঙেছিল একদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে দেখলাম দুটো মুরগি
কাটা হ’ল পেয়ারা গাছের নীচে এবং আমাদের সর্ট ওয়েভ অনুষ্ঠানে বিরতির

চিৎকার, মুরগি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, পেয়ারা গাছ আবার গড়িয়া হাট। সব কিছু স্তব্ধতার মাঝে এগিয়ে চলে শেষের দিকে আমরা দেখতে পাই।

সুযােগে ছেলেরা প্যান্টে পা গলালো আটটায় চা
আমি কোনাে তফাৎ দেখি না, বস্তুত মানুষের সঙ্গে মানুষের আমি
কোনাে তফাৎ দেখি না, জানি তার মতো হারামজাদ প্রাণী দু’টি নেই, সর্বদা
কুট কষছে, সর্বদা তার ঠিকাদারি, একে চালাচ্ছে, তাকে চালাচ্ছে, তার আত্মকেন্দ্রিকতা ততটুকু যতটুকু সে ‘শো করে, বাকী সবটুকু, নিরানব্বই ভাগ প্যাচপয়জার, তুমি বেড়াল-কুকুরকে গড় কোরাে, কিন্তু মানুষকে নয়
শুনি, অতীতের বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে আহারের অভাবে, শীতে বা
দাবানলে, ডুবে যাওয়া দ্বীপের সঙ্গে জল হয়েছে কতাে না মেরুদণ্ডী,
এগুলি শােনা কথা, কিন্তু ভাবি, এই সেদিন কার যেন লেখায় পড়লুম কোননা
এক রৌদ্রকরােজ্জ্বল সকালে মানুষ তার নষ্ট সরলতার সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে।
এবং আর ফিরবে না।

মাঝে মাঝে মনে হয় কেনো তিনি গদ্য কমে লিখলেন। এই লেখাটা এলোমেলো মনে হতে পারে। মনে হতে পারে শালা এটা কি কোলাজ কোনো ফিল্মি চিত্র। না কি ট্রেনে চলা সাধারণ কোনো জীবনের আখ্যান। শেষের কয়েকটি  লাইন:

উচ্চমধ্যবিত্তদের জন্য চাই প্লট শুধু,
কাঠা তিনেক, নিজেদের ভদ্রাসন নিজেরা বানিয়ে নিক, ঐ দিকে রেললাইন,
ডাঙা জমি, এক মেঘলা দুপুরে এই প্রান্তরে বেড়াতে এসেছিল অপু আর
দুর্গা, দু’জনেই বৃষ্টিতে ভিজেছিল, আর শুনেছিল টেলিগ্রাফের থামে, কান
পেতে, দূর-দূরান্ত থেকে ভেসে আসা মানুষের কথা, সেই সব মানুষের
ফিসফিসানি যারা প্রলাপে কথা বলে, যাদের তাড়া করে ফিরছে একদল
উন্মাদ মৌমাছি
নষ্ট সততার গন্ধ তাহলে তাদের ও পিছু নিয়েছে
চার ইস্কুপে রিচার্ড গোমেস ( কল মি অফি) খুলে ফ্যালে ট্রানজিসটরটাকে।
তারপর চৌম্বক শন্না দিয়ে টেনে বের করে এক-একটি মরচেপড়া বলটু।
কাটা নখের মতো ও গুলি মেয়ে ছিটকে পড়ে এবং আমি কুড়িয়ে নিই, জড়াে
করে রাখি প্লেটের পাশে।

এই গদ্যে আমার মতো পাঠক খুঁজে নেই নষ্ট আত্মার গন্ধ। উন্মাদ কিছু নাট বলটু জড়ো করে চেয়ে চেয়ে দেখি। মেঘলা দুপুরে প্রলাপ বকছে কেউ।

কবিতার মতোই গদ্যের ভাষাও ছিল বহু ভাবনায় ভাবিত ও রহস্যের জালে বন্দী। তাঁর প্রায় সব লেখাই ঘুরে ফিরে কবিতার কাছে এসে মিশেছে। তাই কবিতা রচনার নেপথ্য কাহিনীও নেশা ধরিয়েছে। চিরচেনা এক টুকরো জীবন কিংবা ঘটনাকে রহস্যে আবৃত করে সেই রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন পাঠকের উপর। এভাবেই তাঁর কবিতায়  ঘটে সেতুবন্ধন ঘটে কবি ও পাঠকের মধ্যে। আর তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা কবিতার মুকুট ছাড়া শাসক। ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’, ‘পুরী সিরিজ’, ‘আবার পুরী সিরিজ’, ‘লোচনদাস কারিগর’, ‘খণ্ড বৈচিত্র্যের দিন’, ‘সলমা-জরির কাজ’, ‘সুখ-দুঃখের সাথী’, ‘কহবতীর নাচ’, ‘নাইটস্কুল’, ‘বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে’, ‘পিয়া মন ভাবে’, ‘বেলা এগারোটার রোদ’, ‘অন্নদাতা যোসেফ’, ‘হাঁসচলার পথ’ ইত্যাদি বিভিন্ন বইয়ের কবিতাগুচ্ছকে দৃশ্যমান রাগিণীর শব্দ ও প্রাণের শ্বাসে এক একটা অক্ষর থেকে যন্ত্রণা, প্রেম, মৃত্যুর  গোলক ধাঁধা এঁকেছেন। প্রথাগত সুন্দরের টান উর্বশীদের চোখের টানের সীমানা ভেঙে উৎপলকুমার বসু ভেতরগত যত্ন ও রাগের মিশেলে অতিচেনা কবিতাকে করে তুলেছেন আত্মার কাছাকাছি। অনিবার্য কবিতার এক অনুভূতিতে ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতার নামকরনের খোলসে। আর খোলসের ভেতর অ্যালকহলিক নেশা ধরা মাতাল সময় ধরা দিয়েছে।

মাতাল সময়কে কাছে টানার স্রষ্টা ২০১৪ সালে পান সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। ‘পিয়া মন ভাবে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য এ পুরস্কার পান তিনি। বইটির প্রকাশ করেছিল পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশনা সংস্থা ‘সপ্তর্ষি’। উৎপলকুমার বসু ২০১৫ এর ৩ অক্টোবর ৭৬ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে না-ফেরার দেশে চলে যান।

কবিতার আলাদা টোন। অনিবার্যভাবে উঠে আসে বাংলা কবিতায় তাঁর নাম। আলাদা স্বর অবচেতনার কোলাজ ভেঙেছেন সিকি আধুলির শব্দে। উৎপলকুমার বসু এই শ্মশানের বুকে একটা বিপ্লব বুনে দেন। তিনি যেমন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 
কবিতার খন্ড ব্যবহার করেছেন ইমেজ হিসেবে। আর ইচ্ছে করেই তিনি ইমেজ কমপ্লিট করেন নিয়ে। উন্মাদের জগতে পোস্টমর্ডানিজমের হট্টগোল। এ এক তাড়না। একটা সিস্টেমের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। 

তাই তিনি ভাঙতে চেয়েছেন লাইনের গন্ডি। একটা জায়গায় তিনি বলছেন,তিনি মেইন স্ট্রিম লেখক নন। ভ্যাঁন গগ কতটা প্রতিকূলতার মধ্যে ছবি এঁকেছেন। রিলের মতো কবি কোনো চাকরি করেন নি। এর তার সাহায্যে থেকেছেন। নিজের লেখা ছাড়া কিছুই ভাবে নি। তিনি ও তাই মনে করেন। টি এস এলিয়েট, এজরা পাউন্ড, জেমস জয়েস, সতীনাথ ভাদুড়ী, কমল কুমার মজুমদার, জীবনানন্দ দাশ তার খুব প্রিয়। আর কমল চক্রবর্তীর গদ্য। আর তার লেখক জীবনের বাউণ্ডুলেপনার পাঠ নিয়েছেন কমল কুমার মজুমদারের কাছ থেকে।

একবার শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু বেড়াতে গেছেন। তখন শক্তি চট্টোপাধ্যায় একের পরে এক চতুর্দশপদী কবিতা লিখছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সাধারণত রাত নয়টা দশটা থেকে লিখতেন। একরাতে দু’-তিনটে সনেট লিখলেন তারপর শুনালেন উৎপলকুমার বসুকে। তারপর বললেন,লেখতো আমার মতো কবিতা।
উৎপলকুমার বসু লিখলেন, উনিশশো বাষট্টি শেষ হলো। কবিতার এক জায়গায় আছে,
এবার শীতের বনে অপরাহ্ন দ্রুত পড়ে এল
এবার শীতের বনে অপরাহ্ন চলে যায় দ্রুত
এবার বৎসরান্তে প্রত্যেকের নাম আমি খাতায় লিখেছি

তোমাদের সঙ্গে, বন্ধু, নতুন আলাপ হল
তারো আগে অন্য বহু বন্ধুত্বকে মনে পড়ে
বস্তুত, বনের মধ্যে, নির্বাসনে, কাঠের বাড়িতে
সমসাময়িক বলে কিছু নেই

শক্তি  সেদিন ভোর পর্যন্ত লিখেছিলেন।

উৎপলকুমার বসু বলছেন, আমি তো ভয়ঙ্কর রকমের পড়াশুনা বিরোধী, পুস্তক বিরোধী। ’চন্ডালের হাত দিয়া পোড়াও পুস্তকে’ মাইকেল বলেছিলেন। আর আমার বন্ধু সন্দীপন বলতো আমার বুক সেল্ফে চব্বিশটা বই থাকে আর একটা বই বেশি ঢোকালে সবকটা পড়ে যাবে। একটা সময় পড়ার সংখ্যা সত্যিই কমে আসে। আমারও একই ব্যাপার।

কিন্তু আপনিতো প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দর্শন বিষয়ক চর্চা-টর্চা করেন। উত্তর-আধুনিকতা নিয়েও আপনাকে কথা বলতে দেখা যায়। তো academics আর কবিতা দুটোকে কীভাবে মেলান? আবার জ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধেও যৌবনে তো অনেক কথা বলেছিলেন।

এই প্রশ্নের উত্তরে উৎপল বসু:
কবিতাও অন্যভাবে একই জ্ঞানচর্চা করে। কিন্তু academics এর থেকে কবিতা অনেক বেশী অরগ্যানিক। বিশেষত: আমি এবং আরও হাতে গোনা কয়েকজন এই অরগ্যানিক ব্যাপার স্যাপারগুলোকে ছুঁতে চেয়েছি। ধরা যাক একটা গাছ জন্মালো, সেই গাছ বড় হয়ে যে কত বড় হবে, তার কোথা দিয়ে ডাল বেরোবে, কোথা দিয়ে ফুল বেরোবে - এ আমরা কেউ জানিনা, এবং এই রহস্যটা আছে বলেই আমরা খুব সুখে আছি, বা অন্তত: এই internet, এই তথ্য উন্মুক্তি, এই প্রযুক্তিনির্ভরতা, এই বিজ্ঞানকেন্দ্রিকতার যুগের চেয়ে কিছু দিন আগেও অন্তত: সুখে ছিলাম বলা যেতে পারে। আর যারা reductionnist, যারা এই রহস্যটাকে ভাঙতে ভাঙতে অনু-পরমানুর সংযোগ বি-সংযোগে একটা বোমা বানাতে চায়, একটা চুল্লি।একটা বোমা বানাতে চায়, একটা চুল্লি বানাতে চায় - প্রতিটি সৃজনকর্ম ওসবের বিরোধী। বৃক্ষরোপন থেকে শুরু করে সঙ্গীত, কবিতা, painting এই সব তো অরগ্যানিক, সব কিছুর মধ্যেই শ্বাস-প্রস্বাস... প্রতিটি সৃজনকর্ম একটা সিস্টেমের কথা বলে। যে সিস্টেমটা পৃথিবীর শুরু থেকে আছে। সৃজনকর্ম তো atomistic নয় আর তাই প্রতিটি সৃজন পৃথিবীর কথাই তো বলে এসেছে। তার জন্য আমার সঙ্গে রাস্তার কুকুরেরও অসম্ভব মিল। আমি তো কুকুর বেড়ালের প্রতিটা চলাফেরা, অভিব্যাক্তি বোঝার চেষ্টা করি। ওদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। মেশার চেষ্টা করি।

আমার কবিতা জৈব, আমার কবিতা অযৌক্তিক: উৎপলকুমার বসু
সাক্ষাৎকারঃ অতনু সিংহ। সাথে ছিলেন- শৈবাল সরকার, প্রকাশ মাঝি।

সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল ২০০৯ সালে।সেই সাক্ষাৎকার থেকে অনেক ব্যাপার পরিষ্কার একট ধারনা পাওয়া যায়।সিস্টেম,চুল্লির ভেতর আগুন, অনু-পরমাণুর রহস্য।অর্গানিক ব্যাপার। ইন্টারনেটের আগের ভালো লাগার ব্যাপার। গতিকে ছুঁয়ে দেখা।
 
আর তাই Erotics এর এত গুরুত্ব আমাদের যৌথ চেতনে?

এর উত্তরে উৎপল বসুঃ 
Erotics এর থেকে আমি বলবো মেটাফিজিকস ভারতীয় শিল্পচর্চার মেটাফিজিকাল বোধ ইন্দ্রিয় চেতনায় বরাবর খুবই কেন্দ্রে থেকেছে। মেটাফিজিকসের চর্চা ভারতীয়রা বারংবার করেছে। স্থাপত্য, ভাষ্কর্য থেকে শুরু করে মহাকাব্যেও। ভারতীয় জাদুঘরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ শ্যামলবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। আমি ওনাকে বলছিলাম - ভারতীয় মন্দির শিল্পে এত কিছু আছে। কামকলা আছে, শিকার আছে অথচ কৃষি নেই। উনি আমাকে বললেন চন্দ্রকেতু গড়ে -এ কৃষিকাজের ভাষ্কর্য আছে। কাস্তে দিয়ে কৃষক ফসল কাটছে। এগুলিই হচ্ছে ব্যাপার। যামিনী রায় বলতেন সারা পৃথিবী দুভাগে ভাগ - ভারত এবং অ-ভারত।

কমলকুমার ও আপনার সমসাময়িক আবহ আপনাকে কতটা প্রভাবিত করেছে?

উৎপল বসু:
কমলদা আমাকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিতেন। ওঁর সঙ্গে খালাসিটোলায় যেতাম আমরা। আমি, দীপক, শক্তি আরও অনেকে। কমলদার গদ্যে সিনট্যাক্স - ওর নিজস্ব ডিকসান আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। এ তো সবাই জানে। তবে কৃত্তিবাসের বন্ধুরা আর কমলদা ছাড়াও আমার প্রচুর বন্ধু-বান্ধব। দেশ-বিদেশে। যেমন রুবি। রুবি হচ্ছে খিদিরপুর ডক এলাকার একজন মাস্তান (ছিল)। তবে একেবারে কংগ্রেসি কায়দায় শাদা পাঞ্জাবি পাজামা পড়ে থাকত। আমায় ও বলত তুই ওই মুর্খ লোকটার সঙ্গে মিশিস কেন? তো আমি জিজ্ঞাস করি যে, কে? ও বলে ওই যে খালাসিটোলায় তোরা যার সঙ্গে যাস। যারা পেছন ঘুরে বেড়াস। তোদের কোন প্রোফাইল সেন্স নেই। আমি বুঝতে পারি যে রুবি কমলদার ব্যাপারে বলছে আর কমলদাও আমাকে রুবির সঙ্গে দেখলে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। সে এক মজার ব্যাপার। আর একটা মজার ব্যাপার মনে পড়েছে - আমি দীপক আর কয়েকজন একবার ঠিক করলাম 'দয়ালবাবার আখড়া' নামে একটা মুক্ত, যা হবে সমান্তরাল ভাবনা চিন্তার একটা ঠেক। যেমন ধর সেখানে ফাটাকেষ্ট পড়াবে 'ল অ্যান্ড অর্ডার', পোস্তার কোন এক ব্যবসায়ী পড়াবে 'ইন্টারন্যাশান্যাল ট্রেড'। তার ক্লাশ হবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে। এই ধর আজ হেদুয়া তো কাল কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর মূর্তির পাদদেশে। ব্যাপার অনেকদূর এগিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটা নিয়ে সর্বসম্মতিতে পৌঁছানো গেল না। প্ল্যানটাই ভেস্তে গেল।

হাংরি জেনারেশনের বন্ধুরা?

উৎপল বসু:
ওঁরা আমার চেয়ে অনেকেই বয়েসে বেশ অনেক ছোট। তবু প্রথমে আমি, সন্দীপন, শক্তি, বিনয় সবাই হাংরি আন্দোলনে ছিলাম। আমার এজন্য চাকরি জীবনে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের সংগঠনিক বিষয় তেমন একটা ছিল না। আজ ধর এখান থেকে কেউ হাংরি বুলেটিন ২৮ বের করল তো পরশু ত্রিপুরা থেকে কেউ হাংরি বুলেটিন ১৫ বের করল। তবে বাসুদেব দাশগুপ্তর 'রন্ধনশালা' বইটার আমি ছিলাম প্রকাশক আর ফালগুনীর সঙ্গে জীবনে একবারই রাস্তায় দেখা হয়। ও তখন ভাঙ গাঁজা কিছু একটা খেয়ে টলছিলো। 'নষ্ট আত্মার টেলিভিশন' বইটা আমায় বটতলার পানুর মত করে হাতে গুঁজে দিয়ে বলে 'পট্টভির পরাজয় আমার পরাজয়'। আমি বুঝলাম - এ খুব কড়া জিনিস। ওর দাদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। মলয়ের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ ছিল।

আপনি কি এখনো নিজেকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনে করেন?

উৎপল বসু:
ওসব ভাবনা। লিখতে হলে লিখি- লেখা ছাড়াও আমার প্রচুর কাজ। আমি তো ট্যাক্সি ড্রাইভারি থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকমীদের রেড ইউনিয়ন অবধি করেছি। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেরিয়েছি, পড়িয়েছি। তবে এখন কবিতার নাম করে যা সব হচ্ছে - উরিবাবা! আমার 'নধরাজলে' কবিতাটাকে বিজ্ঞাপনের ভাষায় বদলে দিল - প্যানপ্যানানি প্রেমের একটা অডিও ভিসুয়্যাল... কিছু একটা... নব্বই দশকের একটা ছেলে এটা করেছে। করুক। আমার যায় আসে না। তবে এখনও অনেকে আছেন যাঁরা অন্যকিছু করার কথা ভাবছেন। সেটাই আসল। যদি কেউ দলবদ্ধ হয়ে কিছু একটা ভাবনা চিন্তা করে লেখালিখি করে...

আপনার সব বইতো প্রায় চটি; বিশেষ করে ‘টুসু আমার চিন্তামণি’, ‘সলমা -জরির কাজ’...

উৎপল বসু:
হ্যাঁ এটা এক প্রকার বানিজ্যিক প্রকাশনা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ। প্রচুর টাকা না থাকলে বা দাদা বাবাদের ধুতির কোঁচ ধরে না ঘুরলে নাকি কবিতার বই বেরোয় না। আমি বলি দ্যাখ শালা...

তাহলে আনন্দ পুরষ্কার নিলেন কেন?

উৎপল বসু:
আরে আমি তো ভাবিনি আনন্দবাজার আনন্দ করে আমাকে পুরষ্কার দেবে। খবরটা পাওয়ার পর আমার ঘুম ছুটে যায় পুরষ্কার নেব কি না ভাবতে গিয়ে। Rejection এর কথা ভাবি, তারপর হঠাৎ কেউ একজন আমাকে ফোনে বলে - উৎপল বাবু, আপনি এসব করবেন না - করলে, আনন্দবাজার আপনার পিছনে গুন্ডা লেলিয়ে দেবে।

আর গদ্য?

উৎপল বসু:
আমার গদ্যও কবিতার মত। আমি কমল চক্রবর্তীর গদ্যের খুব ভক্ত। কমলই আমার ধূসর আতাগাছ বইটা কৌরব থেকে প্রকাশ করেছিল। তবে বাংলা গদ্য পদ্যর থেকে আমি এখন, অনেকদিনই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবছি। যদিও আমার স্মৃতি, আমার উচ্চারণ সবেতেই বাংলা। কিন্তু তার ফর্মটা আলাদা, সিনট্যাক্স আলাদা, ডিকসান। আমার এখনও উত্তর বাংলার প্রতি টান। 

ছোপ ছোপ নীল এসে হানা দেয়। আমি ভাবি উৎপলকুমার বসু কি চোখ জুড়ে সবুজ বন্ধ কি দেখছেন?
যদি স্পষ্ট মনে পড়ে আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল মোটামুটি স্বার্থপর, আজ তাকে নিখিলগন্ডুষ বলে মনে হয় আজ তাকে লিখনভঙ্গিমা বলে মনে হয় যদিও কয়েকশ ক্রোশ দূর দিয়ে সিংভূমে দু’হাত তিন হাত মাটি খুঁড়ে ফেলে একই সঙ্গে মদ ও কঙ্কাল নিষ্কাশিত হচ্ছে আজ- মৃতের লাস্য তাই
‘পুরী সিরিজ’ কবিতার ১ কবিতার লাইন
জলের সীমানা ছেড়ে একে একে শূন্যে উঠে যায়।
আমারো চতুর্দিকে গারদের স্তব্ধ  ছায়া পড়েছে এমন।

‘সালমা জরির কাজ’ ১৪ নম্বর কবিতার লাইন
শ্বাসকষ্ট  উঠলেই  বুঝতে  পারি ফুলডুঙরি পাহাড় আর বেশি  দূরে নয়
নইলে এমন হাঁপাচ্ছি কেন? কেন ওষুধে সারে না?

অগ্রস্থিত কবিতার ২০ নম্বর কবিতার লাইন
সেই সুর
স্তব্ধতায়
ছাই ঝরে চতুর্দিকে
আমি থেকে থেকে
চমকিয়ে উঠি
আকাশ ফাটানো শব্দে
বারুদ ও বাতাবিলেবুর সুবাতাসে।

‘অগ্রস্থিত কবিতার’ ৩০ নম্বর কবিতার লাইন
দুপুর  যায় -সময়মতো বলে
আমিও মানি। খিদে পেয়েছে তোমার
পাখিটি গায় চমৎকার গীত,
গাছের নিচে আগুন ধূ ধূ জ্বলে

উৎপলকুমার বসুর কবিতা ‘স্তম্ভের লাইন’
কোনে দিন,কোনো খানে তুমি তাকে মুক্তি দিয়েছিলে,
এখন কপাল তার ভরে গেছে চন্দনে, চুমোয়

শ্মশানের ধারে বসে থাকি। উষ্ণ মাংসের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় পোড়া এক ঘ্রাণে অবিরাম  ছুটে চলেছে কান্নার বোল। শেষ বিকেলের লাল সূর্য মাঠের আলোয় প্রতিফলনের পরে অর্ধদগ্ধ হিজিবিজি পান্ডুলিপিতে হানা দিচ্ছে। পাতলা একটা যন্ত্রণার নেমে আসে। শিউরে উঠি। কেউ আমাকে নিয়ে চলে আরো সামনে। আগুনের কাছাকাছি। পবিত্র হাসি আর পাপবোধ নারীর স্তন চুষে চুষে টানার মতো দেবতারা ভুলে যায় পথ।

উৎপলকুমার বসুর লাইন,
এই নদী অশ্রু  নদী তবে।

হলুদ খামের ভেতর গেঁথে থাকে পুরনো প্রেম,পুরনো স্মৃতি, পুরনো পঙক্তি। ব্যর্থতার সাথে বসবাস আমার। ঝিনুকের মতো ক্ষুধার উদ্রেক হলে গভীরতর জল ঘুমন্ত কাঠের মলাটের এসে থেমে যায়। জীবন তারপরও কেমন যেন চলে।হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা চোখ। মাছি উড়ে গেলে বিমূর্ত ভাবনার আফ্রোদিতির নেশা ধরে যায়। নেশা-

১৯৮২ তে প্রকাশিত ‘লোচনদাস কারিগড়’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটির নাম
সই লুডো খেলা। শব্দের কী ক্ষমতা?
মূক তুমি তাকিয়ে রয়েছ ঠান্ডা ভাতের থালার দিকে
কী দেখছ তুমি জানো আধ-হাতা ডাল

সাপের মতো আতশবাজির নীল সীমানায় শূন্যে উঠে যাওয়ার মতো।স্তব্ধ রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠে  আবার নিভে যেতে বিলীন  হয়ে যাওয়ার মতো তাকিয়ে থাকি পুড়ে যাওয়া চোখের  ভেতর।

মাঝামাঝি বসেন ঈশ্বর
গৃহতম এই ভাঙ্গা ঘর
ঝাঁপ - ফেলা রাত্রির দোকান
গণিকার নিষ্প্রদীপ স্নান
   
কৃত্তিবাস- এর সঙ্গে থেকেও উৎপলকুমার বসু এঁদের আদর্শকে ভালবেসে যোগদান করেন। যদিও পরবর্তীকালে মামলায় জড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। আর ঘোষণটা ছিল অনেকটা এরকম, I feel that their literary movement degenerated into depravity and I have disassociated myself from hungry generation.'

উৎপল কুমার বসুর চিঠি
শিরোনাম : হয়তো সে এখনো জলবুনো
লেখাটা প্রকাশিত  হয়েছিল কৌরব ৩৮,সেপ্টেম্বর ১৯৮৩

আসলে আমায় একটা পােষা হাঙর আছে। তাকে নিয়েই স্বদেশ-বিদেশ।
কিন্তু সে আমার হয়ে লড়াই করতে চায় না। হয়ত সে ততটা পােষা নয়।এখনো জলবুনো।
যখন কেউ এসে বলে আপনার ঐ লেখাটা পড়লুম-ভালাে লাগল, তখন
আমি নড়েচড়ে বসি। আতঙ্ক ও ঘৃণায়। আমি এমন লেখা লিখতে চাই।
বার্থ লেখা, যা কেউ বুঝতে পারে না। তেমন লেখা এখনাে লিখে উঠতে
পারিনি। এটা আমায় অক্ষমতা।
তবু, লিখি। ছাপাও হয়। ও সব কিছু নয়। পড়বেন না। আমার
কোন লেখা পড়বেন তা সময় মতাে বলে দেব। অন্তত যা লক্ষ্যের কাছাকাছি
তেমন লেখা চিনিয়ে দেব। সময় হােক।
    
উৎপলকুমার বসু

কলকাতা-১৯
২৯.৭.৮৩।

হেঁটে হেঁটে সূর্যকে ছু্ঁয়ে দেখতে চাই। তার জন্য হাঁটতে হবে। আর এর কোনো শেষ নেই। শাদা ফুলেদের বুকে জ্বর নামে। দুলে দুলে ওঠে নোনামাটি। ঝলসানো পাখির স্বাদে ছিন্ন থাকে মাইয়ার চোখ। সে চোখে রাত নামে। বিড়ি আর আগুনের খোঁজে দেহের উপর শীতল সাপের চলার মতো ভিজে ভিজে যায় ইথার তরঙ্গ। মরে যেতে যেতে ঈশ্বর আর আগুনে পুড়ে যাওয়া হাড়ের বিশ্লেষণে নারী শরীরের ঘাম উবে যেতে যেতে থাকে। মাতালেরা বিন্যাস করে কবিতার ফর্ম। উন্মাদেরা কেটে কুটে শরীরে দেখায় গদ্যের শূন্যে ঝুলে থাকা। শরীরে তখন আধুলি ধূ ধূ জ্বলে। কেউ তাঁর লেখার প্রশংসা করলে তিনি আঁতকে ওঠেন। মনে প্রশ্ন জাগে ক্যানো হাংরি জেনারেশন থেকে দূরে চলে এসেছিলেন তিনি? খালাসিটোলায় গেলাসের আওয়াজে ওঠে বুকের কাঁপন। কাঁপন আর থামে না। চলতে থাকে হাজার বছর ধরে... চোখের ভেতর রাত নামে খিদে পেয়েছে আমার।


মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,25,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: অভিজিৎ বসুর প্রবন্ধ: ডানা অলা মোমবাতি খুন
অভিজিৎ বসুর প্রবন্ধ: ডানা অলা মোমবাতি খুন
উৎপল বাবু, আপনি এসব করবেন না - করলে, আনন্দবাজার আপনার পিছনে গুণ্ডা লেলিয়ে দেবে৷
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgBQzSwkG6SDYYwz16ORaWtGiVOX_VlbBOxvY3xEqg5a0_spEzl7mipPye_7fhY9gwTvFaH4biBzr9pwLt0p2hnwFxilMBiaEpgSi9Iy0s2yJfnOk3kmYi2u8KKwaeTXKJNTXwkDu4IIy8/w640-h320/%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25AD%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%259C%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%258E-%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgBQzSwkG6SDYYwz16ORaWtGiVOX_VlbBOxvY3xEqg5a0_spEzl7mipPye_7fhY9gwTvFaH4biBzr9pwLt0p2hnwFxilMBiaEpgSi9Iy0s2yJfnOk3kmYi2u8KKwaeTXKJNTXwkDu4IIy8/s72-w640-c-h320/%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25AD%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%259C%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%258E-%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2020/08/blog-post_53.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2020/08/blog-post_53.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy