.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

মৃতদেহ আগলে রাখিঃ মাসুমুল আলমের লেখার পাঠ | অভিজিৎ বসু


অনেকে গল্প লেখেন অথবা গল্প লেখার চেষ্টা করেন। গল্পের ভেতর দিয়ে জীবনের সুতোর টান অনেকে দেখেন। আবার অনেকে মোমের আত্মার মতো নরকে গিলোটিন আঁকেন। রাত্রির এ এক দীর্ঘ পথ। এ এক দীর্ঘ  জার্নি। তবে মাসুমুল আলমের গল্প পড়লে বোঝা যায় তিনি যত্ন-আত্তি করে লেখেন। আলাদা রকম এক যত্ন। নিজস্ব  এক গভীরতার গভীর সে উপলব্ধি বোধ। হয়তো কখনো কোনো একদিন  বাতিল হবে হয়তো সবকিছু। আবার সেটা হয়তো না হয়ে আবার ফিরে যাবে নরকের পাপের আশ্রয়ে। ডুবন্ত অনুভবের বলি রেখা, নিয়তি আর মগ্নতাকে বছরের  পরে বছর ধরে লালন করতে থাকবে। ডান চোখ স্পর্শ  করবে হয়তো সবুজ গভীরতার ধ্যান। চাকরির দাসত্বে কলোনিয়াল ধারণার প্যার্টান দাঁড়িয়ে  যায়। গল্প এভাবে লিখতে হবে, ওটাকে ক্যালকুলাসীয় রুলস মেনে চলতে হবে। এ রকম নিয়মের বেড়াজালে যারা আটকে ফেলেন লেখকের লেখাগুলো, তারা ঠিকমতো সাহিত্যটা বুঝতে পারেন না। প্যার্টান নিজেই তৈরি  করা যায়। সাহিত্যটাতো সিন্ডিকেটিয় সম্পত্তি না। মুনাফাখোর পু্ঁজিবাদী করপোরেট জগতে ক্যারিয়ার ধান্ধায় আমাদের  সাইকোপ্যাথরা ঘুরপাক খান নিজস্ব বৃত্তের ভেতর। তবে লেখক হতে হলে চাপ নেবার জন্য হার্টের শক্তি বাড়ান। চতুর, নির্দয়, তোষামোদকারিদের চিনতে শিখুন। মদ,বিয়ার আর গভীর রাতের বেহালার সুরে নগ্নতার নীল এক আরাধনা। রেডিক্যাল মগজের রক এন রোলের বিবর্ণ নেশাগ্রস্ত যন্ত্রণা ঠাস বুননে সরল অথবা জটিল  রাজনৈতিক মোটিফের ফুকোর দর্শন পাঠ। হয়তো কিছুই  জানিনা অথবা যা ছোট তার ক্ষুদ্র এক অংশ জানি তার হয়তো সবটা বলতে পারবো না। এ এক আশ্রয়। গরাদ, ম্যাডনেন্স এথিকস, মেটাফিজিক্স, মরালিটির অ্যাবসুলেট অনেস্টির আকরহীন কাঠামো। প্রায়ই সন্ধেয় এমনটা হয়, মঞ্জুশ্রীর মনে পড়ে যায়। মাসুমুল আলমের গল্প "অগস্ত্য অথবা মায়ের-দেয়া নাম"। চোখ গেঁথে  যায় মাসুমুলের লেখায়। মাসুমুল আলমের লেখা ভেতরে ভেতরে অনুভব  করায়। নতুন করে অনেক লেখা পড়লাম। বিষন্ন এক মানুষের সাগর দর্শনের মতো ডানায় ইতি উতি। সাইকেলের ঘটাং শব্দে চুপচাপ ভেঙে পানি চাহনি। লোকেরা বলে ইচ্ছাকৃত রতি দেখা শহর। যাপিত জীবন টেনে দেয় একটা সীমা। আর একটা হাসি মায়াময় হয়ে ছড়িয়ে যায় বিশুদ্ধ প্রণয়ের জালে। আকন্ঠ জীবন, অচিন পাখির মতো আলোয় বাঁধা শৈশবে প্রসারিত প্রেমিকদের নতজানু শরীর। আর মাসুমুলের লেখা তীর্থের কাকের মতো বসে থাকা নোনতা স্বাদ নেবার জন্য হয়তো। ডানে বামে টল টলয়মান সময়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। বিমূর্ত সেই শূন্যের জন্মের হলফ। আর সেই শূন্য দেখা যায় ফুসফুসের স্নানঘর থেকে।

০২.
ফিলিস্তিনি লেখক ঘাসান কানাফানির উপন্যাস ‘মেন ইন দ্য সান’ এটি অনুবাদ করেছেন মাসুমুল আলম। দুর্দান্ত অনুবাদ। মনে আছে আমার, বইটা পড়া শুরু করার পর একটানে শেষ করে উঠেছিলাম। আর বইটার ঘোর আমাকে এখনও আছন্ন  করে রাখে। একটা বোধ অতিক্রম  করে অন্ধকার গভীর রাতের দিকে নিরবিচ্ছিন্ন এক যাত্রা। 

এটা তোমার নিজের বুকের আওয়াজ। যখন তুমি মাটির উপর বুক পেতে শোও, তখনই তুমি তা শুনতে পারো। 'স্ত্রীর ভেজা চুলের গন্ধ  শিরা উপশিরায় তরঙ্গ তোলে। ধুকপুক  শব্দ। আর দূরে তীব্র  আলোকছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে  এবং সেই শ্বেত আলোকদ্যুতির মধ্যে অনেক উঁচুতে কালো একটা পাখি ঘুরপাক খাচ্ছে। একাকী  এবং লক্ষহীন সেই যাত্রা।

একটা ভালো লেখা অনুবাদ করতে হলে তাকে ধারণ করতে হয়। সেই সময়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থান আর মাঝে মাঝে মৃত্যু, রাত, দারিদ্র্যের বছর, শাত্ আল-আরবের অবিশ্রান্ত গর্জন আর তখন পর্যন্ত কালো একটা পাখি লক্ষহীনভাবে চক্রাকারে উড়ে চলেছে। বস্তা ভর্তি দিনারের প্রতি  তীব্র টান। কুয়েতে গাছের কোনো দেখা নেই। বিরাট পরিকল্পনা করে এগুতে থাকে সবাই কিন্তু  মৃত্যু.. সেটা ঘুরে ফিরে আসে। ঠোঁটে কান্নার লবণাক্ত প্রবাহ। কেঁপে কেঁপে অশ্রুর ধারা বড় হতে থাকে। নৈঃশব্দের পরতে সেটা এক কষ্টকর ভ্রমণের আলগা করা গলিত জীবনের সূক্ষ মূর্ত এক সময়কে ধরার চেষ্টা।

আবু কায়েস... একটা নাম। আবু কায়েস তার দুই সন্তান ও স্ত্রী রেখে বন্ধুর পরামর্শে নতুন এক সচ্ছল জীবনের আশা নিয়ে কুয়েতে পাড়ি দিতে চায়। তার স্বপ্ন- সন্তানেরা স্কুলে পড়াশোনা করতে পারবে। বয়সের কারণেই হোক কিংবা চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যই হোক, স্বভাবে বেশ নরম ও কিছুটা ভীতু স্বভাবের আবু কায়েস। 

ভেজা বালির ওপর কান্নার সত্তা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল আর তার নিচে পৃথিবীটা শিহরিত হতে থাকলো সেই সঙ্গে মাটির গন্ধ তার নাসারন্ধ্রকে তীব্র জাগিয়ে তুললো আর বন্যার মতো সমগ্র শিরা উপশিরায় এক ঝটকায় ছড়িয়ে পড়লো।

রাস্তা! রাস্তায় নিজেকে খুঁজে পাবে! কুয়েত, তেল, দিনার ঝা চকচকে জীবনের প্রতি তীব্র এক আর্কষণের টান। সূর্য তার মাথার উপর আগুনের হলকা ঢেলে দিচ্ছিলো অবিরত। আর যতই হলুদ রঙ ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো মনে হলো তামাম দুনিয়ায় সে তখন একদম একা। একদম একা। আর পাথরের উপর বসে সোজা কালো রাস্তার শেষ অবধি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকালো। তালগোল পাকানো বুনো ইদুর তখন রাস্তা পেরিয়ে গ্যালো। তার ক্ষুদে চোখ জোড়া চলন্ত গাড়ির হেড ল্যাম্পে মিশে গিয়ে তীব্র দীপ্যমান। কাঁটাতারের সামনে দাঁড়িয়ে দ্যাখো, দ্যাখো শেয়ালের চাহনি তবে ইঁদুর থেকে সাবধান। আশা ভরসার সুতোয় জীবন টলয়মান। মোটা লোকটা মারওয়ানকে ওজনদার একটা থাপ্পড় দিল আর বাজগাঁই আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। "যা ভাগ আর গিয়ে বেশ্যার দালালদের বল যে, আমি তোকে মেরেছি, পুলিশের  কাছে গিয়ে বলবি আমার নামে।" হতাশার পর্দার আবরণ ভেদ করতে সক্ষম হয় না। মগজ ক্ষয় করে লাভ নেই। ভ্যাপসা গরমে আকাশটা তখনও পর্যন্ত নীল। লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আর আবুল খাইজুরান তার পদক্ষেপ এতো বিশাল যে মারওয়ান তাকে প্রায় হারিয়ে ফেলে। চওড়া হাসি। আর নীতিবোধ বদলে যেতে থাকে কান্নার বাঁকে পাঁচ মিনিট আটকে থাকা ট্যাঙ্কের মধ্যে। লবনের কণার মতো গলে যাওয়ার জন্য স্থানু হয়ে বসে দেখা। নিয়তি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। উইন্ডস্ক্রিনের উপর প্রখর সূর্যরশ্মি আবর্তিত হলে উন্মাদের মতো আলোকবিন্দু চোখ বরাবর ঝুলে রয়েছে। উম্মাদের মতো তীব্র কঙ্কালের আর্তনাদ। আবুল খাইজুরানের শার্ট ঘামের পুরোটা শুষে নিলে ঘোলাটে একটা ছবির মতো মুখটা আবছা দ্যাখাচ্ছে। সূর্যকে মনে হচ্ছে অভিশপ্ত এক নায়কের মতো। স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্খার তীব্র যাপিত জীবনের রেখায় মৃত্যু এসে হানা দেবে কেউ কল্পনা করতে পারিনি। চাকা গুলো থেকে তীব্র আওয়াজ তুলছে হিসহিস। উঠে আসছে প্রাগৈতিহাসিক একটা চরিত্র থেকে। গতিজনিত ঘর্ষণের অমোঘ এক খেলায় রাস্তার আবরণ উঠে যাচ্ছে। 

বোর্হেস এর গল্প নরক ১,৩২ এর কয়েকটা লাইন-
দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে একটা চিতাবাঘ ভোরের আলো ফোটার সময় থেকে বিকেলের শেষ অস্তরাগ পর্যন্ত দেখেছিল কিছু কাঠের তক্তা, কয়েকটা সোজা উঠে যাওয়া লোহার গারদ, বদলে যাওয়া পুরুষ আর নারী একটা দেয়াল আর সম্ভবত শুকনো পাতায় ভরা একটা পাথুরে গর্ত। সে জানতো না, জানা সম্ভবও ছিল না যে ও ঘুরে মরছে ভালোবাসার জন্য, নিষ্ঠুরতার জন্য,হরিণের গন্ধমাখা বাতাসের জন্য...

'মেন ইন দ্য সান' শেষের  সমাধির অংশের দিকে দেখতে পাই আমরা। নিয়তি অমোঘ এক খেলায় সবাইকে হারিয়ে দেয় এক ঝটকায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো,আবুল খাইজুরান ঘুমন্ত শহর থেকে তার লরিটা চালিয়ে নিয়ে গ্যালো, বিবর্ণ আলো। তিনটা কবর, তিনটা সমাধি। ব্যাখাতীত বিছিন্ন দৃশ্য। চারপাশের বাতাস ও স্থির হয়ে আছে।
শেষের কয়েকটা লাইন... ক্যানো তোমরা কিছু বললে না? ক্যানো? ক্যানো তোমরা কিছু বললে না? ক্যানো তোমরা ট্যাঙ্কের চারপাশে ফেটে পড়লে না? ক্যানো? ক্যানো? ক্যানো?
তবে ক্যানোর কোনো জবাব নেই? আমার কাছেও এই প্রশ্নের উত্তর আপতত নেই।

প্রদীপ চৌধুরীর একটা কবিতার মতো হয়তো। কবিতার নাম 'যুদ্ধ'.. 

একটি মৃত গ্রহ থেকে যুদ্ধের সংকেত
ভেসে আসছে এখানে
এখানে এক ডিভিসন সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে নিঃশ্চল..
....
এখানে ইউকেলিপটাসের গন্ধে পুনরায়
জেগে ওঠে মহামারীগ্রস্ত এলাকা

ত্রিদিব মিত্রের 'হত্যাকান্ড' কবিতার মতো, 
মৃত্যু কেবলই প্রতারণা করছে আমার সঙ্গে..

০৩.
মোমের তাপে ও শোকে অনুভূতি গলে গলে যায়। রাত্রির দীর্ঘপথ অনুসরণ করে স্তব্ধতার ধারাবিবরণী। 

বাসুদেব  দাশগুপ্ত'র গল্পঃ রন্ধনশালার শুরুটা এমন
বনের ধারে ভেড়ার বাচ্চাটাকে একা একা অসহায়ভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখে তখুনি আমি সেটাকে খপ করে ধরে ফেললুম। ভেড়ার বাচ্চাটা ওর ধূসর দুটো চোখ তুলে আমার দিকে করুণভাবে তাকাল, আমি বাঁহাতে ওর পশমি নরমগরম শরীরটাকে ভালো করে পাকড়ে ধরে ডান হাতে ওর ঘাড়টা মুচড়ে দিলাম ওকে একটা আওয়াজ করবার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়েই, আমার মোচনের সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘাড়ের কাছের ছোট ছোট কচি হাড়গুলো ভেঙে যাবার শব্দ শুনতে পাই মুট মুট মুড়মুড় মুড়, আর সেই সাথে খানিকটা রক্ত ছিটকে এসে লাগে আমার মুখে, ঠোঁটে নাকের ডগায়, ঘাড়ের কাছের হলদে লোম গুলো লাল হয়ে ওঠে মুহূর্তের মধ্যেই... 

মাসুমুল আলমের গল্প আমাদের একটা জার্নিতে টেনে নিয়ে যায়। 'স্টাচু অব লির্বাটি' গল্পের মতো সময়ের দীর্ঘ অনতিক্রমণের পর মজা নদের আটকে থাকা গলদ তার সমগ্র চৈতন্যজুড়ে বিরাজ করে। স্টাচু টু বিষয় কন্টিন্যুড। রওশন রোজিনা অথবা মাঝখানে হয়তো দুএকবার যাওয়ায় তাদের দু'জনের জায়গায় পৃথিবীর বীজক্ষেতে তৃতীয় আরেকজন চলে এসেছে। নাগরিক জীবনের ব্যতিব্যস্ত টানে প্রকৃতির রাঙানো ঝকমকে আলো শরীরে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে। শাহবাগ আন্দোলন শ্বাস ফেলার মতো করে উদ্বেগ ছুঁয়ে যায় না অথবা ছুঁয়ে গেলে বুকে হাফ ধরে। জাস্ট আগলি। জাস্ট ভেরি ভেরি আগলি... শেষের দিকে রাতে রওশনের ভালোই ঘুম হয়। এটা একটা ত্বকের সেন্সর আঘাতের মতো...

কতো কিছু ফিরে আসছে
এই ধরো লাশের
                    কান্না
চোখের ভেতর থেকে যায়
              আধখানা চাঁদ
কতো কিছু ফিরে আসছে
এই ধরো পোড়া হাড়ের
                    গন্ধ 
চোখের ভেতর থেকে যায় তবু
            নিকোটিনের পান্ডুলিপি

০৪.
অনাথবন্ধু, পালাও গল্পে নিত্রার আচমকা হাসি তোৎলা করে। পলেস্তারহীন দাঁত বের করা সিঁড়িটা ধাপে ধাপে মার্কেটের দোতলায় গিয়ে উঠেছে, সেখানে সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আইসক্রিমের মোড়ক খুলতে শুরু করে। দেয়ালচিত্র -গ্রাফিত্তি সূর্যবন্দি খাঁচা হাতে নিয়ে পলায়নপর বিধ্বস্ত একজন মানুষ। 
    অনাথ
      তুই
        পালিয়ে
          যা
        সময় এখন পক্ষে  না

ডার্টি ফাকার। কুকুরের ঘ্রাণ শক্তি। আর পাগলাটে মজায় হি হি হেসে ওঠে। আচমকা হাসি তোৎলা করে। ন এসে রিপ্লাই দিল। দুঃখিত।
আলোর জন্য হয়তোবা জেগে থাকি।

ঔপন্যাসিক হুয়ান রুলফোর উপন্যাসে উপস্থাপন করা হয়েছে 'কমলা' নামে একটি গ্রামের। গ্রামটি মৃতদের গ্রাম। এ গ্রামে মৃতদের কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের পূর্ব নির্দেশ মতো এখানে তার বাবাকে খুঁজতে আসে। এ গ্রামে মানুষ আছে, কিন্তু তাঁরা যেন স্বাভাবিক নয়। সব কিছু বিবৃত হচ্ছে এমনভাবে, যেন স্মৃতির ভিন্ন এক স্তর, অন্য এক জগৎ। মানুষের কণ্ঠস্বর ও বাতাসের শব্দ শুনে মনে হয় হুয়ানের এটা যেন জীবিত গ্রাম। সে জানতে পারে তার বাবা হুয়ান পারমার আগেই মারা গেছেন। এখানে আসার আগে হুয়ান মায়ের কাছে জেনেছিলো এখানে সে মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে। মা তাকে কথা দিয়েছিলেন।

এখানে হুয়ান এক বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এই বৃদ্ধা হুয়ানকে দেখেই চিনতে পারে, সে সব কিছু হুয়ানের মায়ের কাছে  তাঁর মৃত্যুর আগেই জানতে পারে। অথচ হুয়ানের গ্রাম এখান থেকে অনেক দূর। কাহিনীর বিস্তার এভাবেই চলতে থাকে। ত্রিকাল এখানে মিলে মিশে একাকার। মৃতদের গ্রাম অনবদ্য কৌশলে জীবিতের  গ্রামের মত হয়ে যায়, স্থানিক দূরত্ব মিটে যায় অদ্ভুত এক মিশেলে। কোনটা বাস্তব, কোনটা অলীক বুঝতে পারা যায়না। এ হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে যেন 'ম্যাজিক রিয়ালিটি'  বা 'যাদু বাস্তবতা'। হয়তো এটাই মাসুমুল আলমের লেখার খেলার টোন।

০৫.
তিমি গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে ফিল্ম ফেস্ট, বুসান, মৃণাল সেনের আমার ভুবন, নন্দিতা দাশের মান্টো, আসগর ফরহাদি, শান্তিরঞ্জন বন্দোপাধ্যায়। চোখের সামনে ভেসে থাকা নাম মার্কেজ। সুবিমল-কমল কুমার -ইলিয়াস ঋত্বিক এসে যায় অবলীলায়। প্রাগৈতিহাসিক এর ভ্যাগান্বেষী ভিখু, বার্গম্যানের সাইলেন্স, দাশ গুপ্তের উত্তরা,তারেক শাহরিয়ার, তারেক মাসুদ, মাধুরী ক্ষিত, জ্যা লুক গদার, কুন্ডেরা এতো এতো নামকককঝক। পেটার বিকসেল কিন্তু আমি কে? আমার আইডেন্টিটি কি? নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্ট এসে যায় হয়তো সামনে।

০৬.
নাম পুরুষ ও অন্যান্য  বইয়ের একটা গল্প  'ভৈঁরো'
ভোর;
মানে তখনও সে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠত। ভোর; মানে তখনও সিগারেটের ধোঁয়া, টেরিকাটা কয়েকটি মানুষের মাথা কিংবা নদীর জল মচকা ফুলের মতো লাল নয়। খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে কুয়াশায় ঝাপসা হলুদ আলোর ভেতর হেঁটে যাচ্ছে এক দল মানুষ। ভোর... ভোরের হুড়মুড়িয়ে আসা বৃষ্টিতে ভিজে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে ফের কাক ভেজা হয়ে ঘরে ফিরে আসা... বৃষ্টিতে ভিজে চৌরাস্তার মোড়ে দর-দালানের নিচে বসে থাকা... ভোরের বৃষ্টিতে বিষণ্ণ হন্তারকের হাত থেকে খসে পড়ে ছুরি। অসাধারণ লাইন।

সুবিমল মিশ্র'র গল্পঃ হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধী মূর্তি 

হারান মাঝির বিধবা বউটার আর কোনো উপায় ছিল না, গলায় দড়ি দিয়ে মরল, বাইশ বছরী আঁটো মড়া এখন তরতর করে খালের ঘোলা জলে ভেসে যাছে। দুটো কাক অনেকক্ষণ ধরে ডেকে আসছিল এখন দেড় বছরের কালো রোগা পেটের পিলে বিশ্রীভাবে উঁচু হয়ে থাকা ছেলেটা কঁকিয়ে এখন হাঁফিয়ে উঠেছে, ধুঁকছে, শ্যাওড়া বেড়ার ধারে একটা গরু ঘাস চিবোচ্ছে... 

মাসুমুল লেখায় অজিত দত্তের কবিতা, উৎপল বসুর কবিতা, উদয়ন ঘোষ ইস্তেহার উড়িয়ে দেয়। দৃশ্যে নিমজ্জিত হতে থাকে শরীর ক্ষীণতোয়া মৃত ভৈরবের বিশীর্ণ বাঁক, অল্প পানি, কেরোসিন রঙ পানির নিচে হালকা স্রোতের মতো সঞ্চরণশীল শ্যাওলা। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা আসে। দ্রুতগামী একটা ট্রেনের আলোকিত জানালার মতো সরে সরে যায়।
ঝিমলির বলার মতো করে,বুঝলে বেলফুল হলে ঠিক নিতাম। এরই মধ্যে কোনো কোনো দৃশ্য কিংবা স্মৃতি ফ্রেমবন্দি হয়ে তার খুব কাছে এসে সহসা 'স্থির' এবং নিঃশব্দ একটা ঢেউয়ের মতো অচিরেই মিলিয়ে যায়।
তখনও হয়তো দূরের কোনো গ্রামে কিংবা শহরে আগুন জ্বলছে।

দেবী রায়ের কবিতা 'ঝর্ণার কাছে মৃতদেহ' তার কয়েকটা লাইন এরকম
ঝর্ণার কাছে মৃতদেহ!
খরস্রোত রামগতি নদীর  ওপর
ভেসে যায় কতো না মৃতদেহ। 
...
ঝর্ণার কাছে মৃতদেহ
নাকি, ঐ কিশোর সেও
ঝর্ণার কোলে,পরম নিশ্চিন্তে ঘুমায়

জীবনের টেক্সট নিয়ে বিনির্মিত হয় সময়। সিজোফ্রেনিয়া রোগিদের মতো দাসত্ব ব্যবহার করে আলো নিয়ে খেলে কেউ কেউ। গণিতের মেট্রিক্সের মতো করে থার্ডলিটারেচারের পাঠ। দোকানের জানালায় পজিট্রনের ভেতর ডুবে যেতে যেতে ঘুমের চোখে চোখ রাখে থরোথরো রাত। মাসুমুলের শব্দগুলো আমাকে টেনে নিয়ে যায় 'ভোর... ভোরের হুড়মুড়িয়ে আসা বৃষ্টিতে ভিজে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে ফের কাক ভেজা হয়ে ঘরে ফিরে আসা... বৃষ্টিতে ভিজে চৌরাস্তার মোড়ে দর-দালানের নিচে বসে থাকা... ভোরের বৃষ্টিতে বিষণ্ণ হন্তারকের হাত থেকে খসে পড়ে ছুরি।'

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,25,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: মৃতদেহ আগলে রাখিঃ মাসুমুল আলমের লেখার পাঠ | অভিজিৎ বসু
মৃতদেহ আগলে রাখিঃ মাসুমুল আলমের লেখার পাঠ | অভিজিৎ বসু
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjxknd1C0Up8GtYrhzeSBt5OyKjK-5gzCmUDrYb_QDkB3WQ4D1uv0Pw5d-moZf3vsO0csWSZ-3KkZS8Njm5twDqXxiXsJh2O3KQz2Y7R4WS3kJUuSDr8EXLNGktvkmZ9rjAGT6sQaKYcOc/s320/%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25AD%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%259C%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%258E-%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581-%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjxknd1C0Up8GtYrhzeSBt5OyKjK-5gzCmUDrYb_QDkB3WQ4D1uv0Pw5d-moZf3vsO0csWSZ-3KkZS8Njm5twDqXxiXsJh2O3KQz2Y7R4WS3kJUuSDr8EXLNGktvkmZ9rjAGT6sQaKYcOc/s72-c/%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25AD%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%259C%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%258E-%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581-%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2021/01/Abhijit-Basu.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2021/01/Abhijit-Basu.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy