.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

মাসুমুল আলম- এর গল্প নিয়ে অল্প কিছু কথা | আহমেদ নকীব

আহমেদ নকীব

অনেক দিন লেগে গেলো মাসুমুল আলম- এর গল্প ছাপাতে। ততোদিনে প্রতিশিল্পে তার অনেকগুলো গল্প ছাপা হয়ে গেছে। গাণ্ডীবে প্রকাশিত মাসুমুলের গল্প নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়েই কথা গুলো বলছি। তবে গাণ্ডীবে এবং শিরদাঁড়ায় তার গল্প ছাপা হওয়ার অনেক আগেই প্রতিশিল্পের বদৌলতেই মাসুমুলের গল্প পড়া ছিলো। আর প্রথম পড়াতেই অন্যদের চেয়ে তার গল্পের জগত আলাদা লেগেছিলো আমার কাছে।

আমার নিজের লেখার মাধ্যম যেহেতু কবিতা, কবিতা পড়ার ব্যাপারেই ঝোঁক বেশি। তাই কবিদের সাথেই আমার কথা-বার্তা একটু বেশি হয়। আর এখন পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক  কথা-সাহিত্যিকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। আর এই কম সংখ্যকদের একজন হচ্ছেন মাসুমুল আলম।

মাসুমুলের সাথে আমার যোগাযোগের শুরুটা হয়েছিলো তার লেখা গল্প, আলোচনা ও অনুবাদ গাণ্ডীব আর শিরদাঁড়ায় ছাপাতে গিয়ে। আর মুখোমুখি হয়ে  যতটুকু কথাবার্তা হয়েছে তার চেয়ে টেলিফোনেই কথা'র পরিমান বেশি। মাসুমুলের সাথে কখনোই আমার কোনো দীর্ঘ আড্ডা কিংবা সাহিত্য-বিষয়ক আলোচনার সুযোগ ঘটেনি। এর একটাই কারণ  দুজনেই আমরা কিছুটা অন্তর্মুখী চরিত্রের। তবে বহু-বছর লেগে গেলো এই সৌহার্দ্য তৈরি হতে। এর পুরোকৃতিত্বই আমি মাসুমুল আলমকে দেবো, তার কারণটা হচ্ছে, গল্প ছাড়াও অন্যান্য মাধ্যম, বিশেষ করে এখনকার কবিতা নিয়ে তার যে পর্যবেক্ষণ তা রীতিমতো বিস্ময় জাগার মতো। কথা-সাহিত্যিক হয়েও কবিদের চেয়েও তিনি এগিয়ে আছেন কবিতা নিয়ে খোলামেলাভাবে আলোচনা করার ক্ষেত্রে আর তা লিখেও তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি তার অগ্রজ, সমসাময়িক ও তরুণতর কথা-সাহিত্যিকদের নিয়ে তার বিদগ্ধ আলোচনা সাহিত্য ও পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। মাসুমুলের নিজস্ব মাধ্যম কথাসাহিত্য ছাড়াও, প্রবন্ধ, অনুবাদ অন্যান্য বিষয়ে যে অথরিটি তিনি অর্জন করেছেন সত্যিকার অর্থেই তা বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছে।

কথা-সাহিত্যের লোক আমাদের এখানে ঐতিহাসিকভাবেই কম। আমি সব-সময়ই একটা কথা বলি, কথা-সাহিত্যের জন্য যে শ্রম ও মেধা'র প্রয়োজন হয়, একজন ভাস্কর যেভাবে ধ্যানস্ত হয়ে তার শিল্প-কর্ম সৃষ্টি করেন, এতে তার যে শারীরিক এবং মানসিক শক্তি লাগে, একজন কথা-সাহিত্যিকের সেই ব্যাপারটা থাকা দরকার। সেই শ্রমসাধ্য কাজের জন্য লোকের অভাব সবসময়ই থেকে গেছে।  তাই পত্রিকায় কবিতা ছাপাতে গিয়ে কবিদের যতো দ্রুত একসাথে করা যেতো, গদ্যের লোক খুঁজে পেতে এখন পর্যন্ত যে-রকম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়, গাণ্ডীব আর শিরদাঁড়া'র লেখা জোগাড় করতে গিয়ে গদ্য কিংবা কথা-সাহিত্যের লোক পাওয়াটা খুব কষ্টসাধ্য ছিলো। মাসুমুল সে-ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন। যশোর থেকে প্রকাশিত প্রতিশিল্পে প্রতিটা সংখ্যাতেই তার গল্প ছাপা হচ্ছিলো। ঢাকা-শহর কেন্দ্রিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে শুধু অনিন্দ্য, দুয়েন্দে এবং দ্রষ্টব্যে তার গল্প প্রকাশিত হলো। লিটল ম্যাগাজিন কেন্দ্রিক সাহিত্য আন্দোলনে যেহেতু সার্বক্ষণিক যুক্ত থেকেছি, সেজন্য গাণ্ডীব- এর জন্য লেখা-পত্র জোগাড়ের একটা গুরু-দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত ছিলো। সবসময়ই ভাবতাম মাসুমুল-এর গল্প ছাপাতে পারলে খুব ভালো হয়। সেই গল্প ছাপতে ছাপতে তাও ১৫বছর লেগে গেলো। পাশাপাশি শিরদাঁড়াতেও তার গল্প, অনুবাদ ও আলোচনা ছাপা হলো।

মাসুমুল আলম- এর ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’ গল্পটি যখন গাণ্ডীবে (২০১০) প্রকাশিত হয়, এর আগে ১৫-১৬ বছরে তার অনেকগুলো গল্প প্রকাশিত হয়ে গেছে। প্রায়-ই মনে হতো গল্পকার হিসেবে মাসুমুলের যে সামর্থ্য আর ক্ষমতা সেই তুলনায় তিনি সেভাবে প্রচারিত ও আলোচিত নন।

আমরা যারা পাড় লিটল ম্যাগাজিন- এর লেখক এবং লিটল ম্যাগাজিনের  সাহিত্য আন্দোলনের  মধ্য দিয়ে সাহিত্যের একটা মানদণ্ড তৈরিতে সমর্থ হয়েছিলাম, তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এই মিলটা খুঁজে পাওয়া যায় যে, সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু দিতে সাহিত্য-মহল নিরব থেকেছে। প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের হাউজগুলো’র সাথে যেহেতু কোনো যোগসাজশ ছিলো না আর প্রতিষ্ঠিত প্রচার মাধ্যমগুলোকে বিরোধিতা করে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন আবর্তিত হয়েছে তাই এই নিরবতা স্বাভাবিকই ছিলো। মাসুমুল আলম- এর ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় হয়নি। একেতো তিনি শুধু লিটল ম্যাগাজিনেই লিখে গেছেন আর ব্যক্তিগতভাবে মাসুমুল- কে যেভাবে আর যতটুকু জানি, তিনি যেহেতু সাহিত্যের দলাদলির ভিড়ে গা ভাসিয়ে দেননি, তাই ২৫ বছর ধরে বাংলা ছোট-গল্পে যে বাক-বদল হয়েছে, মাসুমুল আলম এই বাক-বদলের অংশিদার হওয়া সত্বেও কিছুটা অনালোচিতই থেকে গেলেন।

মাসুমুলকে নিয়ে এই লেখার ভেতর দিয়ে আমি এই ইংগিতটা দিতে চাই, যার যা প্রাপ্য তাকে সেটা বুঝিয়ে দেয়াটা অন্যান্য সহ-লেখক এবং সহ-যাত্রীদের দায়িত্বে'র মধ্যেই পড়ে।

মাসুমুল আলম- এর গল্প আমাকে যে কারণে নাড়া দিয়েছে তার প্রথম কারণটি হচ্ছে, বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী তিনি তার গল্পে নানা ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে নিয়ে এসেছেন। দ্বিতীয়ত, বেশ সাহসী ভঙ্গীতে যৌনতাকে বিভিন্ন মাত্রায় এমনভাবে তিনি তার গল্পে প্রয়োগ করেছেন তা কখনো নান্দনিকরূপে এসেছে আবার কখনো ঘটনা-পরম্পরায় সরাসরিও যুক্ত হয়েছে। আর তৃতীয় কারণটি হচ্ছে,  সব মিলিয়ে তিনি নিজস্ব ভঙ্গীর এক তীর্যক ভাষার জন্ম দিয়েছেন তার গল্পগুলোতে। এখানেই অন্যান্য গল্পকারদের চেয়ে তিনি স্বতন্ত্র।

মাসুমুল আলমের তিনটি গল্প নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমি মনস্থির করেছি। বিশেষ করে, স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা (শিরদাঁড়া ২০১০),  এপ্রিলের এক সন্ধ্যা ( প্রতিশিল্প ২০১০) এবং ওয়ান্ডারল্যান্ড (গাণ্ডীব  ২০১০)। পরবর্তীতে  এই গল্পগুলো ‘উলুখড়’ থেকে প্রকাশিত  ‘নামপুরুষ ও অন্যান্য’  গল্প-গ্রন্থে  অন্তর্ভূক্ত হয়। এটি ছিলো মাসুমুলের প্রথম গল্পের বই। তো এই তিনটি গল্প আলোচনার জন্য বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তার এই গল্পগুলো গাণ্ডীব ও শিরদাঁড়ায়  প্রকাশের সাথে আমি জড়িত ছিলাম (শুধু এপ্রিলের এক সন্ধ্যা, প্রতিশিল্প ২০১০ বাদে)। তাই এই গল্পগুলো লিখে মাসুমুল যে ধরণের আনন্দ পেয়েছিলেন, মনে হচ্ছিলো এর  সৃষ্টির অংশীদার যেনো আমিও ছিলাম। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, বিষয়, প্রেক্ষাপট, বলার ধরণ আর ভাষা প্রয়োগ আলাদা হওয়া সত্বেও একটা ব্যাপার কিন্তু চোরা-স্রোতের মতো তার এই গল্পগুলোতে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে আর তা হচ্ছে সেই তিনটি বিশেষ চরিত্র, সামাজিক ও রাজনৈতিক মনস্কতা, যৌনতার সাহসী প্রয়োগ ও তীর্যক ভঙ্গীতে বলার টেকনিক মাসুমুল তার এই গল্পগুলোর মানস-জগতে নিয়ে এসেছেন। এখানেই মাসুমুলের বিশিষ্টতা। 

যদি একটু গভীরভাবে মাসুমুল- এর এই তিনটি গল্প নিয়ে আলোকপাত করি, প্রথম দিকে, বিশেষ করে ৯০’র শুরুর দিকটায় মাসুমুল গল্পে যতটুকু ভাংচুর করতেন, তা আস্তে আস্তে কিছুটা সংহত হয়ে এসেছে এই গল্পগুলোতে। প্রথম দিকটায় তার গল্পের মধ্যে স্ট্রাকচার নিয়ে যে নিরীক্ষাপ্রবণ একটা জগত খুঁজে পাওয়া যেতো ধীরে ধীরে তাতে সমাজ, সংসার, দেশ, রাজনীতি, বহির্বিশ্ব সবকিছু ডাল-পালা মেললো। তাই যতদিন গড়ালো মাসুমুলের গল্প তার বিষয়ের সাথে সাথে ভাষা-বৈচিত্রও তৈরি করলো। আর এক্ষেত্রে মাসুমুল অনেক বেশী সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, সেটা হচ্ছে সমসাময়িক ঘটনাবলীকে তার গল্পে স্থান দিয়ে। যেহেতু বর্তমান আর চলমান ঘটনা নিয়ে গল্প লিখতে গেলে একটা চাপ তৈরি হয়, এই ব্যাপারটি অত্যন্ত নিপুণতার সাথে ডিল করতে পেরেছেন তিনি।

স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা গল্পে রিমি নামে যে মেয়েটি গল্পের মূল চরিত্র, তাকে কেন্দ্র ক'রে গল্পের গতি'র  হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটছে। যে-কোনো জেলা শহরেই এই ঘটনাগুলো ঘটতে দেখা যায়। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক জগতে যা ঘটে। রিমিও সে-রকম একটা কমন ক্যারেকটার। আর তাই এই ক্ষেত্রে মাসুমুলের গল্পে প্রবেশ করতে  পাঠক-কুলকে  খুব একটা বেগ পেতে হয়না। এখনকার কবিতায় আমরা যেভাবে সমসাময়িক ঘটনা আর দৈনন্দিন ব্যাপারগুলো ডিল করছি, মাসুমুলও এই ব্যাপারে তার পারঙ্গমতা দেখাতে সমর্থ্য হচ্ছেন। আমি মনে করি যারা গল্পে বা উপন্যাসে একটা ক্ল্যাসিক্যাল ভাবধারা নিয়ে কাজ করছেন তাদের সাথে মাসুমুলের পার্থক্য এখানেই। মাসুমুল সেই সাহসটা ইতোমধ্যেই অর্জন করতে পেরেছেন খুব সাবলীলভাবে।

স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা গল্পে খুব সাধারণ একটা ঘটনা আর উইটের মধ্য দিয়ে মাসুমুল এই গল্পে সামরিক শাসনের ইতি ঘটালেন, গল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সিরিয়াস ব্যাপারটা বোঝা যাবেনা। প্রথমেই মাসুমুল একটু তীর্যক ভঙ্গীতে গল্পটা শুরু করার কিছু পরেই জানিয়ে দিচ্ছেন,
তার  সুললিত কণ্ঠে বিমোহিত শহরের অগ্রগামী চেতনার কতিপয় শিল্পী দ্বিতীয় কোনো মিতালি মুখার্জীকে খুঁজে পায়। ক্রমান্বয়ে সে, মানে রিমি সাংগঠনিক সাংস্কৃতিক চর্চা থেকে ক্রমশ দূরে সরে গিয়ে ইদানীং তার একক বিরল প্রতিভায় গুণমুগ্ধ  শিল্পীদের আড্ডাস্থল ফুটপাথের টি-স্টল কিংবা কোনো ময়দানের মধ্যে আলোকদায়ী নক্ষত্র হয়ে বসে থাকে।

এখানে যে জিনিসটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে রিমির প্রণয় প্রার্থীরা যারা একাধারে শিল্প-সংস্কৃতির সাথে জড়িত আবার  কিছুটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও আছে, আর একটা পর্যায়ে যখন দেশে সামরিক  শাসন জারি  হয়, একইভাবে সেই দলটি সামরিক শাসনেরও বিরোধী, যেটা মধ্যবিত্তের কমন চরিত্রের মধ্যে পড়ে, সব করতে চাওয়ার যে প্রবণতা, এই ব্যাপারটিকে মাসুমুল তার গল্পে দুর্দান্তভাবে উপস্থাপন করেছেন। আর্মি অফিসারের সাথে রিমির ২য় বিয়ে হওয়ার পর আশুলিয়ায় বোটে ঘুরতে গিয়ে যে দুর্ঘটনায় আর্মি অফিসারের সলিল সমাধি হওয়া আর আন্দোলনের মাধ্যমে সামরিক শাসনের অবসান দুটো ব্যাপার একই জায়গায় এসে মিলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে একটা আবহ তৈরি করলেন মাসুমুল। আর রিমি সাঁতার না জেনেও খুব অলৌকিকভাবে  বেঁচে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আবার সেই প্রণয় প্রার্থীদের দল একইভাবে রিমিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে এর একটা অবস্থা টের পাওয়া যায় এই গল্পের মধ্যে।  তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে পরিবর্তন যা হচ্ছে তা সাময়িক। এখানে কিছুটা হলেও গল্পকার হিসেবে মাসুমুল যে শ্রেণীর সমালোচনা করছেন তা যে উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

এপ্রিলের এক সন্ধ্যা গল্পটি উনি উত্তম পুরুষে লিখেছেন। প্রথম যে গল্পটি নিয়ে আলোচনা করলাম, তা থেকে বিষয়-বস্তু, ভাষা, স্থান-কাল পাত্র সম্পূর্ণই আলাদা। কিন্তু এতোকিছু আলাদা হওয়া সত্বেও একটা জায়গায় মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সেই তীর্যকভাবে বলার যে মুন্সিয়ানা মাসুমুল দেখিয়েছেন তা সত্যিই অপূর্ব। এখানে অন্য একটি চিরন্তন সামাজিক ক্রাইসিস নিয়ে আসেন। যেখানে উত্তম পুরুষে বর্ণিত ছেলেটির মা মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এই মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন  তিনি নিয়ে এসেছেন ঠিকই কিন্তু  সে-সময়ের রাজনৈতিক  বাস্তবতা এমনভাবে  জুড়ে দেন তাতে এই গল্পটিতে কোনো ছন্দ পতন ঘটেনি। আর বিশেষভাবে আমি যে দিকটির দিকে মাসুমুলের এই তিনটি গল্পে প্রধান হিসেবে দেখতে চাচ্ছিলাম, তা হচ্ছে সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। একটা জায়গায় এসে গল্পে গতি এখানে এসে থেমেছে: 

বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দেখি, বকুল-বিথী কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়ে যাচ্ছে গান গাইতে গাইতে। পৌর চেয়ারম্যানের ইচিং বিচিংঝাপিয়ে ঝিনা-খেলা দুই কন্যা। বকুল বড়, তার আয়ত চোখে আমাদের মেটে পুকুরের ঠাণ্ডা জল। বকুল-বিথীর কি খিদে পায়? বড়লোকদের ক্ষুৎপিপাসা না-কি কম? হতেও পারে। বকুল-বিথীর আব্বা এখন জেলে। সেবার আমাদের শহর আর আমাদের দেশের বড় বড় লোক, অনেক মেজ মেজ আর সেজ সেজ লোক, আতিপাতি নেতা-শ্রেণির অনেক লোক জেলখানায় যায়। জেলখানা ভরে ওঠে। ভিআইপি বন্দিরা সেখানে  'ডিভিশন' পায়; ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন... এইসব?

তো যে ব্যাপারটি আমি মাসুমুলের গল্পের প্রধান এবং স্বকীয় চরিত্র বলতে চাচ্ছি, যেমন বকুল আর বিথী এই দুই বোনের মধ্যে উওম পুরুষে লেখা ছেলেটির বয়সে বড় হলেও তার যে বকুলের প্রতি একটা দুর্বলতা ছেলেমেয়ে সম্পর্কিত  একটা মনো-দৈহিক আবহ তৈরির মধ্য দিয়ে হঠাৎ করেই এই গল্পের মধ্যে তখনকার সময়ের রাজনৈতিক ও সামরিক তন্ত্রের  টানাপোড়েন- এর ব্যাপারটি মাসুমুল যেভাবে হ্যান্ডেল করছেন এটিকে আমি বেশি ফোকাস করতে চাই। আগের প্যারাটিতে যেখানে ভিআইপি বন্দিদের দিয়ে জেলখানা ভরে উঠেছে বলে শেষ হলো, তারপরেই  একটা ডাকের শব্দ শোনা যায়  'ব-কু-ল'। এখানে এই যে উত্তম পুরুষে বর্ণিত ছেলেটির বকুলের প্রতি যে মনো-দৈহিক আকর্ষণ পাশাপাশি গল্পে ছেলে আর মেয়ে চরিত্রটির মধ্যে শ্রেণিগত ব্যবধান  বর্ণিত এইভাবে 'আমি ডাকি। বকুল-বিথী দাঁড়ায় এক মুহূর্ত। তারপর ছড়া কাটতে-কাটতে ফের দৌড়: 'আমরা ভাই গরিব মানুষ ফড়িঙ ধরে খাই/ফড়িঙের ল্যাজ ধরে মক্কা শরীফ যাই।'  তখন আমি খুবইছোট, শোনা কথা, এর আগে একবার, মানে এরশাদের সময় বকুল-বীথির আব্বাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আর্মিরা। তারপর অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে বহুদিন পর্যন্ত পৌর চেয়ারম্যান চারপেয়ে জন্তুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতেন।" এর ভাষ্যের মধ্য দিয়ে যেটা প্রকটিত হলো শ্রেণি বৈষম্যের জন্য শেষ পর্যন্ত প্রেমটা অর্থহীন অবস্থায় গিয়ে উপনীত  হলো মানব সমাজের এই চিরায়ত দশাটি মাসুমুল তার নিজস্ব এপ্রোচে গল্পে নিয়ে আসতে পেরেছেন।

তবে ওয়ান্ডারল্যান্ড গল্পটি আগের দুটো গল্প থেকে একেবারেই আলদা কিন্তু সেই রাজনৈতিক বাস্তবতা অনেকটা প্রতীকী স্টাইলে জমাট বেঁধেছে। এইগল্পটিতে আগের দুটো গল্পের চিরায়ত গল্প-বলার ঢংটি একদম ভেঙেচুরে দেয়া হয়েছে। ভাষা ব্যবহারের স্টাইলটাও একদম আলাদা। চরিত্রদের ঘনঘটা ছাড়াই গল্পটি শেষ হয়েছে। যেখানে পুরো ভূ-খণ্ডটিই ওয়ানতানামো (গুয়ানতানামো) কারাগারের মতোই রুদ্ধ। গল্পটি পড়তে পড়তে মনে হতে পারে ঠিক কোন ভূ-খণ্ড নিয়ে বলা হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছেনা, কিন্তু ৭১'র কথা যখন এই গল্পের প্রেক্ষাপটে উঠে আসলো তখন বুঝতে আর বাকি থাকলো না এটা আমাদেরই ভূ-খণ্ডটির কথাই বলা হচ্ছে। তাই ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষ্যের ভেতর দিয়ে গল্পটি বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজনীতি যেভাবে একটা দেশ নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক সেভাবেই অনেকটা ল্যাটিন আমেরিকান স্টাইলেই আমাদের এখানে ক্যু-হত্যা-গুম অহরহই ঘটছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক উত্থান পতনের ইতিহাস যে বৈশ্বিক রাজনীতি'র স্বীকার তা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হয়ে যায়, যখন ওয়ান্ডারল্যান্ড গল্পে এই অংশে আমরা থামি:
রাতে আমি আর পিতৃব্য এক খাটে ঘুমাতে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি: আব্বার সংগে আপনার দ্যাখা হয়েছিল? না, পিতৃব্য কেবল এটুকু বলে চুপ করে থাকেন। তারপর আমার একমাত্র পিতার সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা তার ভাঙা-ফ্যাসফেসে গলায় যা-যা বলেন তার জন্য রাত আরো ঘন আর আতংক বিস্তারী হয়ে ওঠে; কাকে উনি বলেন এসব? যখন সেখানে কোনো সাংঘাতিক গল্পের সন্ধান মেলেনা তখন তার উচ্চারণে কোনটা ঘটনা বা গল্প কিংবা রটনা -- তা-ও কি গল্প (?) – আমি গুলিয়ে ফেলি এবং নিঃশব্দ থাকি।

গল্পের এই জায়গাটিতে এসে একটা টানটান অবস্থা তৈরি হচ্ছে। যে-রকম বাস্তবেও ঘটছে, পুরো বিশ্বজুড়ে এমনকি আমাদের এই ভূখণ্ডেও। সবকিছু জেনে-বুঝেও আমদের মুখ বন্ধ রাখতে হয়। মেনে নিতে হয় অর্ধ-সত্যকে। আর এই দম-বন্ধ দশার এক-পর্যায়ে স্বপ্নের বর্ণনার ভেতর দিয়ে সার্কাসের সেই মোটা মেয়েটিকে ঘিরে যৌন-অবদমনের একটা পট তুলে এনেছেন এভাবে,

দ্যাখো সার্কাসের সেই মেয়ে... মোটা মেয়েলোকটা... সমস্ত উত্তেজনার তিলতিল সঞ্চয়ে যে উত্তুঙ্গতায় আমি পৌঁছেছিলাম ঘুম ভাঙার পর কুকুরের একটানা রোদন শীতের রাতকে তার আনুষঙ্গিক বাস্তবতা নিয়ে আরো বেশি প্রগাঢ় করে তুললে আমার ওটা নিমিষে গুটিয়ে যায়; অথচ আমার পিতার সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা ওটা- তে হাত দিলে পর প্রথমে আমি বড় অসহায়, তদুপরি তিনি তাঁর উত্তেজনা আমাতে বিদ্ধ করতে চাইলে, সেই মুহূর্তে, আমার প্রচণ্ড ক্রোধ সঞ্চার হয় এবং পিতৃব্যকে প্রচণ্ড লাত্থি দিই। অনবধানতাবশত লাথিটা তাঁর অকুস্থলে গিয়ে পড়ে ঘন অন্ধকারে তীক্ষ্ণ একটা কোঁৎ ধ্বনি জেগে ওঠে। সেই আর্ত ধ্বনি সঞ্চারে আরো কেউ জেগে ওঠে :কে? কে সে? সে বা তিনি। না, আমার অভিন্ন সত্তা, আমার বয়োসন্ধি, আমার বা আমাদের পিতা, পিতামহ আর এক 'মিথ্যা' ওয়ানতানামো; আমাদের আজব ভূখণ্ড।

গল্পে একটা এ্যালিগোরিক্যাল আবহ সৃষ্টি করে মাসুমুল বাস্তবিক যে জগতকে সামনে নিয়ে এসেছেন, যে প্রশ্ন রেখে গল্পের সমাপ্তি টানছেন, যাকে তিনি ওয়ানতানামো (গুয়ানতানামো) কারাগারের মতো এক আজব ভূখণ্ড বলছেন, আর সেই অসহায় অবস্থায়  পিতৃব্যকে লাথি মারার ভেতর দিয়ে  শেষমেশ  কোনো প্রতিরোধের চিহ্ন কি রেখে যেতে চেয়েছেন? 

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,25,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: মাসুমুল আলম- এর গল্প নিয়ে অল্প কিছু কথা | আহমেদ নকীব
মাসুমুল আলম- এর গল্প নিয়ে অল্প কিছু কথা | আহমেদ নকীব
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjqL1hC_ZC6wsG0tU2kFO6xt9_RhvjwqhcKJWvnlVdiX7YQ2mcZ2vLXcey3WDp7Z0yuucn7Pj4FATDwOZD6MQQS75kr_FQtjH9XcQVkQyWHz4ujyYT9b2kV77sVaqjZmddPYmxC9rq85PE/w382-h191/%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B9%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25A6-%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%25AC-%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjqL1hC_ZC6wsG0tU2kFO6xt9_RhvjwqhcKJWvnlVdiX7YQ2mcZ2vLXcey3WDp7Z0yuucn7Pj4FATDwOZD6MQQS75kr_FQtjH9XcQVkQyWHz4ujyYT9b2kV77sVaqjZmddPYmxC9rq85PE/s72-w382-c-h191/%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B9%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25A6-%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%25AC-%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2021/01/Ahmed-Nakib.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2021/01/Ahmed-Nakib.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy