.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

মলয় রায়চৌধুরীর গল্প ‘ভিনিয়েট’

লিটলম্যাগ বিন্দুর জানুয়ারি ২০২২ সংখ্যার প্রচ্ছদ
হোগলা আর মৌমাছির জোড়ামুকুট, রাজড়ার বিকল্প বাস্তবের বিদঘুটে নীল জলে চোখ-নাক ভাসিয়ে একাকীত্বের একলষেঁড়ে আনন্দে ভুগছিলেন সোবেক সিংহ। সেবক নয়, সোবেক, সোবেক। আর একাকীত্ব এই জন্যে যে, বাদবাকি আশেপাশে পাড়া প্রতিবেশি, এলাকাবাসী, জ্ঞানীগুণী, গাইয়ে-বাজিয়ে, হাগিয়ে-পাদিয়ে ইত্যাদি নাগর/নাঙবাদি-প্রতিবাদী সবাই ইনকিউবেটারের তাপ খেয়ে বড় হয়েছে।

নিয়ন্ত্রিত তাপ, কেননা ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কম হলে বা ৩৪ ডিগ্রির বেশি হলে জাতক জন্মায় মেয়ে হয়ে। সোবেক জন্মেছেন ওইম মাঝামাঝি তাপে। তবে, ইনকিউবেটারে নয়; প্রকৃতিতে। গায়ের রঙ ব্রোঞ্জ। পিঠে কালো ফুটকি। ময়লাটে ফিকে বেগুনি তলপেট । দু’পাশে হলদেটে সবুজ। চোখ সবুজ। ওনার নাক চোখ কান মাথায়, তাই ওইটুকু ভাসিয়ে লুকিয়ে থাকেন জলে। দুঘন্টা নিঃশ্বাস বন্ধ করে জলের তলায় থাকতে ওস্তাদ উনি।

নদী খাল বিলে জীবন কাটাতে হয় বলে মাছ-মাংস ছাড়া সোবেকবাবুর রোচে না। পৃথিবীতে ওনার পরিবারই সবচেয়ে প্রাচীন। ২০ কোটি বছরের। ডায়নোসরসারও তখন আসেনি। অনেক হৃদয়বান লোক, কেননা তিনকামরার হৃদয় ওনার। রোমের লোকেরা বলত ওনার লিঙ্গ নাকি মাছেরা খেয়ে ফেলেছে। আর বিজ্ঞানীরা বলে যে ওনার চোখের জলই ওনার আই ড্রপ।

আগেকার কালের গ্রিসের লোকেরা সোবেকবাবুর পূর্বপুরুষকে নিয়ে নানা গল্প ফেঁদেছিল। সেই পূর্বপুরুষ ছিলেন মর্গের দারোয়ান। মেয়েদের শবের সঙ্গে শুতেন বলে সরকার তার ২৮ টুকরো করে ভাসিয়ে দিয়েছিল জলে। লিঙ্গের টুকরোটা মাছেরা খেয়ে ফেলেছিল। হিন্দুরা কেউ-কেউ তাঁকে মর্গেশ্বর নামে পুজো করে, মর্গের গেটে কাঁচা মন্দির বানিয়ে। মিশরের পিরামিডের গুহার দেওয়ালে তো সেই ভদ্দরলোকের রঙিন পাথরখোদাই আছে; মাথায় ডোরাকাটা কাপড়, থুতনিতে ছাগলদাড়ি। আসলে তিনি ছিলেন বহুবিদ্যাবিশারদ, তাই বদনাম।

সোবেকবাবু তো একবিদ্যাবিশারদও নন; ওনার অভিজ্ঞতা ব্যাপক, এই যা। গল্প করতে ভালোবাসেন, গল্প বলতেও। কাজের বউটা রোজ ওনার কাছে গল্প শুনতে চায়। তার নাম কাদু, কাদম্বরী ঘরামি।

কাদুর জন্যে হাঁ-পিত্যাশ করে বসে আছেন সোবেকবাবু। হ্যাঁ, হা-পিত্যেশ নয়, হাঁ-পিত্যেশ। সত্যিই সোবেকবাবু হাঁ করে উপুড় হয়ে শুয়ে। বিরাট হাঁ-মুখ খুলে। বত্রিশ পাটি নয়, চৌষট্টিপাটি দাঁত বের করে।

কাদুর গায়ের রঙ ময়লা। ছোট-ছোট পা। ছোট্ট নাক। মুখে পাউডার মাখতে ভালোবাসে। গায়ে নস্যি রঙের আলোয়ান। লোকে তাই কাদুকে কাদাখেঁচা বলে খেপায়। অনেকে আদর করে বলে ও বেটি স্বর্ণছাতার।

সোবেকবাবুর সঙ্গে কাদুর সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা হয়, যখন কিনা সত্তর পেরিয়েছেন সোবেকবাবু, আর কাদু তো এখনও কচি।

কেউ মন্তব্য করলে সোবেকবাবু বলেন, হ্যাঁ, আছে তো সম্পর্ক, সিমবিঅটিক সম্পর্ক, মিথোজীবী সম্পর্ক, নারী-পুরুষের অযৌন সম্পর্ক।

উৎকর্ণ হতে হয় না সোবেকবাবুকে। ওনার শোনার ক্ষমতা প্রখর। বলতে গেলে ওটাই ওনার প্রধান ইন্দ্রিয়। দূর থেকেই সোবেকবাবু কাদুর আওয়াজ পাচ্ছিলেন।

বাবু যে উদ্বিগ্ন নন তা কন্ঠস্বরে টের পেয়ে কাদু বলল, বাচ্চা দুটোকে ওদের বাবার সঙ্গে পাঠিয়ে তারপর এলুম। তুমি তো জানো এদের বাপ কীরকম কুঁড়ে। সব কাজ আমাকে করতে হয়, ঘরের কাজ, বাইরের কাজ, সব। আজকে হাতে সময় নিয়ে এসেছি তোমার কাছ থেকে বেশ বড় একখানা জম্পেশ গপপো শুনবো বলে।

আর কত গল্প বলব রে, গল্পের ভাঁড়ার ভোঁ ভাঁ, বললেন সোবেকবাবু, ওনার দুচোখে জল।

ওরকম নকল চোখের জল ফেলো না তো; এই জন্যেই লোকে প্রবাদ তৈরি করেছে। সত্তর বছর বয়সে দুনিয়ের কত কিছু দেখলে। কত সরকার এলো-গেলো, কত লাশ পড়ল, কত মেয়ে পাচার হল, কত লোক না খেয়ে মরল এই সত্তর বছরে। তোমার গল্প আবার ফুরোয় নাকি ? একনাগাড়ে বলল কাদু। বেশি-বেশি কথা বলা ওর স্বভাব।

—সত্যিই গল্প ফুরিয়ে গেছে রে।

—তাহলে তোমার জীবনের ঘটনা বলো।

—গল্পের বদলে বরং তোকে ভিনিয়েট বলি।

—সে আবার কী? ইনিয়ে-বিনিয়ে?

—ভিনিয়েট জানিস না ? এর আগে বলেছি তো তোকে । ভি-নি-এ-ট ।

—আমাকে নয়। আমার আগে যাকে রেখেছিলে তাকে বলে থাকবে। আমি ওসব ইংরিজি-টিংরিজি জানি না।

—তা হবে হয়তো। ভিনিয়েট জুড়ে-জুড়েই তো পুরো একখানা উপন্যাস লিখে ছিলেন জেমস জয়েস।

—তিনি কিনি ? কলকাতার ? চৌরঙ্গির ?

—সতেরো বছর ধরে ভিনিয়েট জুড়ে-জুড়ে ফিনেগান্স ওয়েক বইটা লিখেছিলেন উনি। বিদেশি।

—তা ভিনিয়েট জিনিসটা গল্প নয় তো কী ? এলুম শুনতে গল্প আর তুমি দিচ্ছ জ্ঞান।

—তুই কোনো লোককে দেখলি, কিংবা তোর মাথায় কোনো ভাবনা এলো, কংবা কোনো অবস্হা নিয়ে মর্মভেদী প্রভাব তোর খারাপ বা ভাল লাগল, সেগুলোকে বলে ভিনিয়েট। ছাপ।

—অমন তো আমার রোজই হয়। তুমি কোনো একটা বলো বাছাই করে।

—তা তুই আমার কাজটা আগে করে দিবি তো ? কাজ সেরে তারপর শোন।

—তুমি ওই খবরটা পেয়েছ ? পতিতপাবন সরকার মশায়ের খবর ? পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে কাল সন্ধ্যাবেলা। আমি বাসায় ফেরার সময় খবরটা পেলুম।

—না শুনিনি তো। পতিতপাবনকে তো দেখেছি। কাঁধে ঝোলা। খদ্দরেরব ধুতির ওপর গেরুয়ে পাঞ্জাবি। সমাজ সেবক।

—সমাজ কেবক না ছাই। তোমার উচিত ওটাকেও ধরে গতি করা।

—কী করেছে লোকটা ? ভালো লোক বলেই তো জানতুম।

—লোকটা অনাথ আশ্রম চালাত জান তো ? পেট ভরে খেতে দিত না বাচ্চাগুলোকে। পেট ভরে খাওয়াত বটে। পেট পুরে তাড়ি খাওয়াত। খিদেতে বাচ্চাগুলো খেয়েও নিত। খেয়ে আর হুঁশ থাকত না। তখন লোকটা তাদের ইয়ে করত।

—বিলস কী ? পায়ুধর্ষণ ?

—শুধু পায়ু কেন ! ওখানে তো পনের বছর অব্দি মেয়েরাও থাকে।

—ধরা পড়ল কেমন করে ? কেউ পালিয়ে গিয়ে চাউর করল ?

—না গো। একটা মেয়ের পেট খসাতে নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়েছিল। কমজোর মেয়ে, মরে গেল ডাক্তারের টেবিলে। ব্যাস, ডাক্তারও জেলে, পতিতপাবনবাবুও জেলে।

—আমি তো শুধু জন্তু-জানোয়ারের মাংস খাই। পেলে এগুলোকে সাবড়ে দেবো। নে, তুই নিজের কাজ কর।

—সুন্দরবনের খাঁড়ির কুমির সোবেক সিংহ মুখ খুলে ধরলেন। চৌষট্টি শাঙ্খব দাঁতের ফাঁকে-ফাঁকে মাংস। মুখের ভেতর কয়েকটা টুপটুপে জোঁকও রয়েছে। জোঁকগুলোকে খুঁটে বের করার কাজে জলচর পাখি কাদু ঘরামি রোজ আসে।

জোঁক বেছে-বেছে খেতে-খেতে কাদু বলল, তোমাকে তাহলে আরেকটা ভিনিয়েট শোনাই। এটা সাত্যকি মন্ডলের বিষয়ে।

—হ্যাঁ হ্যাঁ, ভদ্দরলোকে গোসাবায় যেতে দেখেছি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কোনো একটা লোকাল কমিটির মেম্বার। পয়সাওলা লোক। মুখ খোলা রেখেই বললেন সোবেক সিংহ, যাঁর প্রতি ইঞ্চি কামড়ের চাপ ৫০০০ পাউন্ড। হাঙর কিংবা রটউইলার কুকুরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

—উনি গোলমাল করেননি, গোলমালে পড়েছেন।

—ডলারের গোলমালে ?

—না না । তবে তহবিলে ডলার জমাও একটা কারণ।

—কেন ? ডলার যদি বেআইনি না হবে তো দুশ্চিন্তা কিসের ?

—বেয়াইয়ের দুশ্চিন্তা।

—ও । যৌতুক দেয়নি পরিমাণ মতন।

—পাঁচ লাখ টাকা, কুড়ি ভরি সোনা আর কলকাতায় চারকাঠার ওপর ছতলা বাড়ি লিখে দিয়েছেন জামাইকে।

—তাহলে ?

—বেয়াই বলেছে, সাত্যকিবাবু যে এন জি ও চালান, যার জন্যে উনি বছর-বছর অঢেল সরকারি খয়রাত পান আর আমেরিকা ইউরোপ থেকে মাসে-মাসে কুড়ি-তিরিশ হাজার ডালার বা ইউরো পান, সেই এন জি ওটা জামাইয়ের ছোট ভাইয়ের নামে করে দিতে। ছেলেটা বেকার, উচ্চমাধ্যমিকে তিনচারবার ফেল।

ভিনিয়েট
মলয় রায়চৌধুরী


মন্তব্য

BLOGGER: 3
  1. গতানুগতিক গল্প পাঠে অভ্যস্ত আমাদের এইরকম অন্যরকম গল্প পড়তে গিয়ে একবারে হয় না, আবারও পড়তে হয়, আবারও, কেননা, গল্পের শুরু আর শেষ টা যে খোলা..

    উত্তরমুছুন
  2. হায়, হায় কী পড়লাম আমি৷

    উত্তরমুছুন
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,151,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: মলয় রায়চৌধুরীর গল্প ‘ভিনিয়েট’
মলয় রায়চৌধুরীর গল্প ‘ভিনিয়েট’
মেয়েদের শবের সঙ্গে শুতেন বলে সরকার তার ২৮ টুকরো করে ভাসিয়ে দিয়েছিল জলে। লিঙ্গের টুকরোটা মাছেরা খেয়ে ফেলেছিল। হিন্দুরা কেউ-কেউ তাঁকে মর্গেশ্বর নামে পুজ
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEint-L6TP2wN5Jaij4fIqIYFlcmycUeU2hHKV39ybl5WZkdQyvCN0-LzktECj1lGh9SOpD_lr60XFjMt6nH7DYYJqtKVx4b_bWBBkDJzR51W35ZBldtN_0WqaXcLvrR7F8ExniTENdk4_2Au6zexNG_RTG1brPleq3r7lcUJ4ptnpPE5U0FsZtHahxN=w320-h180
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEint-L6TP2wN5Jaij4fIqIYFlcmycUeU2hHKV39ybl5WZkdQyvCN0-LzktECj1lGh9SOpD_lr60XFjMt6nH7DYYJqtKVx4b_bWBBkDJzR51W35ZBldtN_0WqaXcLvrR7F8ExniTENdk4_2Au6zexNG_RTG1brPleq3r7lcUJ4ptnpPE5U0FsZtHahxN=s72-w320-c-h180
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2022/01/short-story-by-Malay-Roychoudhury.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2022/01/short-story-by-Malay-Roychoudhury.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy