.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সন্দীপ দত্ত সংখ্যা : মীরা মুখোপাধ্যায়

সময়টা উনিশশো পঁচানব্বই ছিয়ানব্বই হবে আমি তখন অল্পস্বল্প লেখার চেষ্টা করি মাত্র, লেখা হয় কিনা বুঝি না তবে ভালো লাগে লিখতে। এই সূত্রে চেনাশোনা হয় অনেক গুণী মানুষজনের সাথে। তখন কিন্তু  পরিবেশটা বেশ সুন্দর ছিলো। যাঁরা পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়েছেন তাঁরাও আমার মতো কাঁচা লিখিয়েকে হ্যাক থু করতেন না। লেখা শুনতেন, উপদেশ দিতেন, পত্রিকার ঠিকানা দিতেন লেখা পাঠানোর জন্যে। এমনই এক সময়ে একটি কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে আমার সাথে দেখা হয়েছিলো সন্দীপদার। লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্তের। জায়গাটা নদিয়া জেলার একটি মফস্বল, উপস্থিত ছিলেন আমাদের জেলার চেনাশোনা কয়েকজন কবি সাহিত্যিক। কলকাতা থেকে এসেছিলেন সন্দীপদা। আমি তো অবাক উনি অতো দূর থেকে এসেছেন জেনে কিন্তুু ওনাকে যারা চিনতেন তারা বললেন উনি এমনই। লিটল ম্যাগাজিনের জন্যে উনি বহু দূর পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারেন। মোটাসোটা ফর্সা মানুষটি, আস্তে আস্তে কথা বলেন, কিন্তু বলার চেয়ে শোনেন বেশি।

সেই দিন পরিচয় হয়েছিল এক অক্লান্ত কর্মীর সঙ্গে যাঁর বিশাল হৃদয়ের ছোঁয়া আমরা অনেকেই পেয়েছি বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। কবিতা পড়া শুরু  হলো, সন্দীপদা মন দিয়ে শুনলেন সবার লেখা তারপর আলোচনা করলেন লিটল ম্যাগাজিনের একটি সংহত সুন্দর সংগ্রহশালার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যা তিনি নিজের চেষ্টায় শুরু করেছেন তাঁর টেমার লেনের বাড়িতে।আমি তখনও এসব কিছুই জানতাম না। শুধুমাত্র   অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম ওনাকে আর শুনছিলাম ওনার কথাগুলো। তারপর সন্ধের ট্রেনে কলকাতা ফিরে গেলেন সন্দীপদা।

এরপর হঠাৎ একদিন একটি পোস্টকার্ড এলো আমার নামে টেমার লেনের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরীর ঠিকানা থেকে। লেখক সন্দীপদা স্বয়ং।
উনি এক বিকেলে (তারিখ আজ আর মনে নেই) আমাকে ওঁর লাইব্রেরীতে কবিতা পড়তে যেতে আমন্ত্রণ করেছেন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। কলকাতা যাওয়া আমার কাছে তখন লন্ডন যাওয়ার সামিল। আমি একা একা কোথাও যেতে পারি না নিজের আশপাশের জায়গাগুলো ছাড়া। সঙ্গে যাওয়ার কেউ নেই।বাবা অসুস্থ মানুষ।
অবশেষে একজন সম্পাদককে বললাম আমার অসহায় অবস্থার কথা। সে রাজি হলো। সে নদিয়া জেলার চাকদহ থেকে বিরোধীপক্ষ বলে একটি লিটল ম্যাগাজিন করে, আমি তার কাগজে লিখি।
  
তো গেলাম আমরা সেই লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী নামের তীর্থে সেদিন ধূসর রঙের এক বিকেলে। কলকাতায় তখন তুমুল কলরবের মধ্যে দিয়ে অফিস কাছারি ছুটি হচ্ছে, সূর্য অস্তমিতপ্রায়।

আমাদের পিছন পিছনই এলেন এক সাধারণ চেহারার যুবক, গল্প পড়বেন। সন্দীপদা ওকেও ডেকেছেন। নামটা মনে আছে আজও অমৃত সাহা।
আর কেউ আমন্ত্রিত ছিলেন কিনা আজ আর মনে নেই।মনে থাকার কথাও না। আজ থেকে প্রায় সাতাশ আটাশ বছর আগের কথা। যুবকটিও বেশ মুখচোরা, আমার সাথে আলাপও হয়েছিল।আমাদের লেখা শুনতে বেশ কয়েকজন মানুষ লাইব্রেরীতে উপস্থিত ছিলেন, আরও কয়েকজন এসেছিলেন ম্যাগাজিন দেওয়া নেওয়া করতে, নোট নিতে এইসব আরকি।

আমাদের পাঠের মধ্যে মধ্যেই চলছিলো সন্দীপদার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী নিয়ে কথাবার্তা। দেখেছিলাম সবাই কেমন শ্রদ্ধার সাথে ওনার কথাগুলো শুনছে। পাঠের মাঝামাঝি জায়গায় এসে সন্দীপদা চা বিস্কুট আনালেন, চা খাওয়ার বিরতির পর আবার শুরু  হলো পড়া। মনে আছে প্রায় রাত আটটা নাগাদ আমাদের পাঠ শেষ হলে আমরা দৌড়ে গিয়ে ট্রেন ধরেছিলাম। চলে আসার সময় মানে যখন আমরা রওনা দিচ্ছি  দরজায় দাঁড়িয়ে সন্দীপদা আমার সঙ্গে আসা ছেলেটিকে বারবার বলেছিলেন আমাকে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দেবার কথা। একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করতাম সন্দীপদা কথাবার্তা বেশ বলতেন সকলের সাথেই, তাদের সমস্যার কথাও শুনতেন এবং সাধ্যমত সাহায্যও করতেন তবে সর্বদাই তিনি একটি অভিভাবকসুলভ ভাব বজায় রাখতেন যেজন্য আমরা সবাই তাঁকে সমীহ করতাম আগাগোড়া।

তারপর সময় গড়িয়েছে তার নিজস্ব নিয়মে।
আমি মফস্বলে থাকা এক মুখলুকানো মানুষ, সভা সমিতিতে যেতে পারিনি কোনদিন সেভাবে তবু দু চারটে অনুষ্ঠানে সন্দীপদার সাথে দেখা হয়েছে অনেক দিন পরপর। দেখা হলে উনি খোঁজ খবর নিয়েছেন।বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা পাঠাতে বলেছেন। বেশি কথা বলতেন না, কিন্তু যেটুকু  বলতেন তাই ঢের।

আর একটা সময় ওঁর সাথে দেখা হতো আমাদের, সেটা কলকাতা বইমেলায়। ভীষণ ভীষণ ব্যস্ত তখন উনি। মনে হতো যেই নাইবার খাবার অবসর নেই। সেই ‘লিটল ম্যাগাজিন পড়ুন ও পড়ান’ লেখা কাগজের টুপিটি মাথায় দিয়ে ছুটে বেড়াতেন এ মাথা থেকে ও মাথা। মনে হতো যেন লিটল ম্যাগাজিনকে পাদপ্রদীপের আলোয় এনে দাঁড় করানোর কাজটুকু তাঁর পবিত্র কর্তব্য। মোটা মানুষ ছোটাছুটিতে ঘেমে নেয়ে একশা তবু কিন্তু  একফাঁকে জিজ্ঞেস করতেন আমাদের এদিককার দু চারজন সম্পাদকের কথা, তারা কোন টেবিলে পত্রিকা দিয়েছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনও বলতে শুনেছি খুব অনামা সম্পাদকদের যে সন্দীপদা তাদের বারবার বলেছেন  পত্রিকাটি প্রতিবার প্রকাশিত হলেই ডাকে বা হাতে হাতে যেন তারা ওঁর লাইব্রেরীতে দিয়ে যায়। কদিন আগেই একজন সম্পাদক (ওঁর চলে যাওয়ার পরপরই)
গর্ব করে বলেছিলেন যে তার পত্রিকাটি লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরীতে আছে। 

লিটল ম্যাগাজিনের জন্যে আগে তো আলাদা করে কোন মেলা হতো না, কলকাতা বইমেলার মধ্যেই খানিকটা জায়গা নিয়ে টেবিল সাজিয়ে বসতেন সারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা সম্পাদকরা তাদের পত্র পত্রিকার সম্ভার সহ। ঐ সময় আমরা, যাদের দু চারটে লেখা বেরিয়েছে তারা গিয়ে পত্রিকা সংগ্রহ করে আনতাম।

১৯৯৯ সালে প্রথম লিটল ম্যাগাজিন মেলা শুরু হলো, ছোট পত্রিকার সম্পাদকদের এ এক বিপুল জয়। আর এর পিছনেও সন্দীপদার চেষ্টা ছিলো আপ্রাণ তা বলাইবাহুল্য। বিস্ময়কর এই যে আমা হেন অভাজনকে চিঠি পাঠিয়ে এই মেলায় এক সন্ধ্যায় কবিতা পড়ার ডাক দিয়েছিলেন কমিটি।
ভাবলেও ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগে। তা এই আমি নামের গেঁয়ো কবি সেখানে গিয়ে কবিতা পড়ে এসেছিলাম সে সন্ধ্যায়।

তারপর অনেক বছর কেটে গেছে, আমি নিতান্তই ব্যক্তিগত হতাশার জন্যে  সরে এসেছিলাম লেখার জগত থেকে। তা প্রায় বছর কুড়ি এভাবে একটা কোকুনের মধ্যে গুটিয়ে রেখেছিলাম নিজেকে। দুহাজার সালে করোনার মধ্যে হঠাৎ করেই লিখতে ইচ্ছে হলো। কারন অবশ্যই এই স্মার্টফোন।মেলে লেখা পাঠানোর সুবিধা পেয়ে
আবার লিখতে শুরু করলাম। এই পথ ধরেই আমার সাথে পরিচয় হয় কবি অংশুমান করের।
তিনি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটি বিকেলে আমাকে জীবনানন্দ সভাঘরে কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ জানান ওনাদের গদ্যপদ্যপ্রবন্ধের অনুষ্ঠানে। ইতিমধ্যে আমার লেখা দু একটি পত্রিকা  মূলত ওয়েবম্যাগে বেরুতে শুরু করেছে।
আমারও বেশ ভালো লাগছিলো এই প্রত্যাবর্তন, নিজের স্বপ্নের সাথে কথা বলতে কার না ভালো লাগে! 

অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রথমেই যেটা মনে হলো তা হচ্ছে একটা মনখারাপ, কাউকে চিনি না। আমি যেন সেই রিপ ভ্যান উইংকেলের মতো বহু বছর পর ঘুম ভেঙে এক অচেনা পৃথিবীতে এসে পড়েছি, আমাকেও কেউ চেনে না। যাই হোক তারপর একসময় অনুষ্ঠান শুরু হলে দেখলাম সামনের চেয়ারে বসে সন্দীপদা! সেই বহু যুগ আগের একজন স্নেহময় চেনা মানুষ। খুব ইচ্ছে করছিলো ছুটে গিয়ে প্রণাম করি, কথা বলি। কিন্তু অনুষ্ঠানের মধ্যে তা হয় না,ফলে বসে রইলাম কিন্তু মনটা পড়ে রইলো সন্দীপদার কাছে। পত্রিকা প্রকাশ, কবিতা পাঠ এসবের মধ্যেই লক্ষ্য করলাম সন্দীপদা কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ছেন মাঝে মাঝে। শুনেছিলাম আগেই  উনি খুব অসুস্থ। কিন্তু  এমন মানুষ, লিটল ম্যাগাজিনের জন্য  উনি সব বাধা ঠেলে চলে আসতে পারেন সবসময়। এরমধ্যেই এক ফাঁকে সন্দীপদাকে প্রণাম করে বলেছিলাম আমায় চিনতে পারেন সন্দীপদা? খুব ক্লান্ত, অবসন্ন দুটো চোখ তুলে সন্দীপদা বলেছিলেন ‘আমি কাউকে ভুলি না, লিখতে শুরু  করেছ দেখে ভালো লাগছে।’

এটুকুই। তারপর উনি বলতে উঠেছিলেন মঞ্চে। সব অবসাদ, অসুস্থতা দুহাতে সরিয়ে দীর্ঘসময় ধরে বলেছিলেন ওঁর যা বিষয়, সেই লিটল ম্যাগাজিনের রক্ষনাবেক্ষণ নিয়ে।

তারপরের দুঃখজনক খবর তো সবাই জানেন কিছুদিন ভীষণ অসুস্থতা ভোগ করে ১৫ই মার্চ, এই বছরেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত। আমরা, যারা তাঁর স্নেহ পেয়েছি তারা হারালাম এক সত্যিকারের অভিভাবককে। যিনি অখ্যাত লিখিয়েদেরও লিখতে বলতেন, সুযোগ করে দিতেন অকাতরে।

সন্দীপ দত্ত: ‘পত্রপুটে আনিয়া দিল পুষ্পমালিকা…’
মীরা মুখোপাধ্যায়


মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সন্দীপ দত্ত সংখ্যা : মীরা মুখোপাধ্যায়
সন্দীপ দত্ত সংখ্যা : মীরা মুখোপাধ্যায়
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEh_PKFj_-aWLNrhDQEuPPNnOZgEHC_8ERwfEyHQKNWOaHssEuAt0vC0zXI5oNFdFDiJDjTir8VYMiJKEpFPO-npECzxKZuyip_Yet1ibdk8cudCQLtlUeJFJi8gU3hvS5MwQ95-dsxTfehCO4cXtJLveCrfyEfH3RqTwKunFB-RfwfHKfi44fq2nalaESY/s16000/sandip-datta-bindu-littlemag-cover.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEh_PKFj_-aWLNrhDQEuPPNnOZgEHC_8ERwfEyHQKNWOaHssEuAt0vC0zXI5oNFdFDiJDjTir8VYMiJKEpFPO-npECzxKZuyip_Yet1ibdk8cudCQLtlUeJFJi8gU3hvS5MwQ95-dsxTfehCO4cXtJLveCrfyEfH3RqTwKunFB-RfwfHKfi44fq2nalaESY/s72-c/sandip-datta-bindu-littlemag-cover.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/12/mira-mukharjee-article-about-sandip-datta.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/12/mira-mukharjee-article-about-sandip-datta.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy