...পলাতক আর্তুর র্যাঁবো ছাড়া অপর কোনো কবির অনুপস্থিতি ও নীরবতা তাঁর ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষে দিনে দিনে এমন বাঙ্ময় ও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে দেখা যায়নি।
–সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, মিনিবুক ‘নরখাদক’-এর পেছন-মলাটের লেখা
কথাশিল্পী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের এই বাক্যসমুচ্চয়ের মধ্য দিয়ে সমসময়ে উৎপলকুমার বসুর (১৯৩৭—৩ অক্টোবর ২০১৫) অস্তিত্ব কতোটা বলবান ছিলো তা-ই ফুটে উঠেছে। উৎপলকুমার বসু সম্বন্ধে আধুনিক পাঠক, সচেতনভাবে যাঁরা সাহিত্য পড়েন তাঁদের কাছে নতুন করে কিছু বলার নেই।
বাংলা সাহিত্যে ’৬০, ’৭০ ও ’৮০-র দশকে যে সাহিত্য আন্দোলনগুলো হয়েছিল—তার মধ্যে অন্যতম হলো—
১. হাংরি জেনারেশন [১৯৬২তে ‘হাংরি জেনারেশন’ পত্রিকা প্রকাশ]
২. শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন [১৯৬৬তে ‘এই দশক’ পত্রিকার মাধ্যমে]
৩. নিমসাহিত্য [১৯৭০-এ ‘নিমসাহিত্য’ পত্রিকার মাধ্যমে]
৪. গল্পতন্ত্র ও চাকর সাহিত্য বিরোধী আন্দোলন [১৯৭০-এ ‘গল্প’ পত্রিকার মাধ্যমে]
৫. ঘটনা প্রধান গদ্য [১৯৭০-এ ‘এবং নৈকট্য’ পত্রিকার মাধ্যমে]
৬. নতুন নিয়ম [১৯৭৮-এ ‘নতুন নিয়ম’ পত্রিকার মাধ্যমে]
৭. ছাঁচ ভেঙে ফ্যালো [১৯৭৩-এর জুলাই মাসে অমল চন্দ্রর প্রবন্ধ ও ১৯৭৯-এ ‘ছাঁচ ভেঙে ফ্যালো’ নামে পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে]
৮. সমন্বয়ধর্মী গল্প [১৯৭৯-এ ‘সমন্বয়ধর্মী গল্প’ পত্রিকার মাধ্যমে]
৯. গাণিতিক গল্প [১৯৮০তে ‘ছয়’ নামক পত্রিকার মাধ্যমে]
১০. থার্ড লিটারেচার [১৯৮৩তে ‘কবিপত্র’ পত্রিকায় এই সম্পর্কিত ইশতেহার প্রকাশ]
(সূত্র: সন্দীপ দত্ত, ১৯৯৩, বাংলা গল্প-কবিতা আন্দোলনের তিন দশক)
এর মধ্যে উৎপলকুমার বসু যুক্ত ছিলেন প্রথম সাহিত্য আন্দোলন, হাংরি জেনারেশনের সাথে। যা এক নতুন অভিঘাত, নতুন অভিজ্ঞতা। এই সাহিত্যদর্শন অনুযায়ী মনে করা হয়, সমকালীন নীতিবোধ, চিন্তাকাঠামো, সমাজবৈশিষ্ট্য, সাহিত্যপদ্ধতি সবকিছু ব্যর্থ হয়ে গেছে। থিকথিকে কাদা উপচে পড়ে চারদিক পুঁতিগন্ধময় করে ফেলেছে। এই বাস্তবতার প্রকাশ প্রচলিত সাহিত্য আর ধারণ করতে সক্ষম নয়; প্রচলিত ভাবনাজগতে সমাজচিন্তার বাস্তব রূপ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। তাই দরকার নতুন ভাষা, নতুন ভঙ্গি, নতুন আঙ্গিক।
বেঁচে থাকতেই উৎপলকুমার হয়ে উঠেছিলেন বাংলা কবিতা জগতের অনিবার্য নাম। তাঁর কবিতা পাঠকের কাছে এক বিস্ময় আর রহস্যের আধার হিসেবে আবির্ভূত হয়। কেননা তিনি সকলের মতো লেখেন না, তাঁর রয়েছে এক ‘ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা’। যার সমুখে দাঁড়ালে মনে হয়, এর সকল শব্দই বুঝি অমোঘ- বিকল্পহীন! উৎপলের কবিতা রহস্যময়; ভাষা অপরিচিত, ভঙ্গি নতুন, তবে শব্দগুলো চেনা। তাঁর কবিতা কি দুর্বোধ্য? দুর্জ্ঞেয়? অভেদ্য? যুক্তি বিবর্জিত? অর্থহীন? আর নবধারাজলের স্বপ্নে পাওয়া আঙুলটি কি স্যুররিয়ো-লিজমের?
মন মানে না বৃষ্টি হলো এত
সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পারে
আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের অধিকারে।
(নবধারাজলে ১; উৎপলকুমার বসু)
তাঁর কবিতা পাঠের পর অর্থোদ্ধারের তাড়না কাজ করে না, বরং ভালো লাগা থাকে পুরোটাজুড়ে। এর কারণ তাঁর কবিতার ফর্ম। অর্থ উদ্ধার করতে না পারলেও এর আঙ্গিকগত অবেদনের কাছে পাঠক জিম্মি! এ প্রসঙ্গে উৎপল নিজেই বলেছেন, “আমি ফর্মকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। সেটা হয়তো এই কারণে যে লেখায় আমি কনটেন্টের দিক থেকে আসিনি, এসেছি ফর্মের দিক থেকে। যতোক্ষণ পর্যন্ত না আমি একটা লেখাকে ভিসুয়ালাইজ করতে পারি যে পাতায় কেমন দেখাবে, ছাপায় কেমন দেখাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার নিজের পক্ষে লেখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।”
তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি হারিয়েছ বাদামপাহাড়ে।
আমার ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা আমি হারিয়েছি বাদামপাহাড়ে।
(পুরী সিরিজ-এর শেষ কবিতা; উৎপলকুমার বসু)
আঙ্গিক বা লেখার স্টাইল/ফর্ম প্রসঙ্গে ব্রেশট বেশ চমৎকারভাবেই বলে গিয়েছেন, পরিষ্কারভাবে: “ঘটনাবিন্যাসের ভেতর দিয়ে চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণই গল্প বলার পদ্ধতি কীনা তা সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। ...যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ ছাড়াই যদি বালজাক বা টলস্টয়ের আঙ্গিক গ্রহণ করি, তাতে হয়তো আমরা আমাদের পাঠকদের এবং জনগণকে ক্লান্তই করে তুলবো— ওই লেখকেরা যা প্রায়শই করে গেছেন। বাস্তববাদ শুধুমাত্র রূপনীতির প্রশ্ন নয়। ওইসব বাস্তববাদী লেখকদের অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই আর বাস্তববাদী থাকতে পারি না।”
আর এই ব্যাপারে অর্থাৎ আঙ্গিক প্রসঙ্গে চরম কথা বোধহয় গোদারেরই। যা কথাসাহিত্যিক সুবিমল মিশ্র প্রায়শই তার রচনায় ও বিবৃতিতে উদ্ধৃত করেন। গোদারের ভাবনায় আঙ্গিকটাই কখনো কখনো বিষয় হয়ে যেতে পারে, কিংবা বিষয়টাই আঙ্গিক! ঘটনাবস্তু তিনি ত্যাগ করেননি, কিন্তু ঘটনাবস্তুই তাঁর একমাত্র বিষয় ছিলো না।
আপাত অর্থহীন, প্রকৃতপ্রস্তাবে রহস্যময় পঙ্ক্তি কী অমোঘ শক্তিতে টানতে পারে পাঠককে তা উৎপল পাঠকমাত্রই জানেন। এ প্রসঙ্গে কবি মৃদুল দাশগুপ্ত লিখেছেন, “পঞ্চাশ দশকের কৃত্তিবাস পত্রিকা ঘিরে যে তরুণ কবিদের উত্থান, তাঁদের তরুণতম উৎপলকুমার ব্যতিক্রমী কাব্যভাষায় তীর্যক অথচ মাধুর্যে পরিপূর্ণ নাগরিকতায় সবুজ-ধূসর উভয় প্রান্তরে সূর্যাস্তের রঙ মিশিয়ে নিজেকে আলাদা চিহ্নিত করেছিলেন তাঁর সূচনা পর্বেই। শক্তি-সুনীল-অলোকরঞ্জন-বিনয়, ৫০ দশকের বিবিধ বর্ণ বিচ্ছুরিত হীরক-স্রোতধারাটিকে এক কথায় উৎপল একটু ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের বাংলা কাব্য ভাষায় আধুনিকতার পর্বে যুক্তি-শৃঙ্খল ছিন্ন করার ওই সূচনা। নচেৎ ‘তুমি জানু, তুমিই জানালা’ অর্থহীন এই কাব্যপংক্তিও কেনো এত মোহময় হবে? অনেক কাল ধরেই আমার মনে হয়েছে উত্তর আধুনিকতার সূত্রপাতও ঘটিয়েছেন উৎপল।”
‘প্রিয় পাঠ’ লেখায় উৎপল বলেন, কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে পড়া সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ তাঁকে প্রাপ্তমনস্ক করে তুলেছিল— “ছিলুম হিউম্যানিস্ট। হয়ে গেলুম এগজিস্টিয়েন-শিয়ালিস্ট।” তাঁর কবিতা জীবন দুটো পর্যায়ে ভাগ করা যায়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি কৃত্তিবাস পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটলে তিনি তাতে যোগদান করেন এবং তাঁর কবিতায় একটা বড় বাঁক লক্ষ্য করা যায়। এই আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৬৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয় এবং যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপনার কাজ থেকে বরখাস্ত হন। হয়তো এর সূত্র ধরেই ১৯৬৫ সালে কবি কলকাতা তথা ভারত ছেড়ে সুদূর লণ্ডনে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে যাবার আগে কবির দুটি কাব্য প্রকাশিত হয়েছিল; ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ (১৯৬১) ও ‘পুরী সিরিজ’ (১৯৬৪)। ১৯৭৮ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি কবিতা থেকে দূরে থাকলেও কলকাতায় ফিরে এসে আবার লিখতে শুরু করেন। এসময় প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় কাব্য ‘আবার পুরী সিরিজ’ (১৯৭৮)। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে তাঁর কবিতার বই প্রকাশিত হতে থাকে। এই সময়ের কবিতার বইগুলো হলো, লোচনদাস কারিগর (১৯৮২), খণ্ডবৈচিত্রের দিন (১৯৮৬), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯১), সলমা-জরির কাজ (১৯৯৫), পদ্যসংগ্রহ (১৯৯৬), কবিতাসংগ্রহ (১৯৯৬), সুখ-দুঃখের সাথী (২০০৬), কহবতীর নাচ (১৯৯৭), নাইট স্কুল (১৯৯৯), টুসু আমার চিন্তামণি (২০০০) প্রভৃতি। যেহেতু লন্ডনে বাস করার সময় তিনি কবিতা লেখেননি, তাই লন্ডন পর্বের আগে ও পরে—এই দুই পর্যায়ে তাঁর কবিতা ভাগ করা যেতে পারে।
উৎপলকুমার বসুর কবিতার পরিসর অত্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর কবিতা যেন সমাজ, সংস্কার, কাঁটাতার, জাগতিক সবকিছু ছাড়িয়ে ছুঁয়ে নেয় প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে আদিম-চিরায়ত সেতু! ১৯৫০-র দশকের কবিতার বৈশিষ্ট্য পেরিয়ে তিনি নিজের মতো করে এক বিকেন্দ্রীক কবিতার ভাষা নির্মাণ করেছেন। ফলে একদম আলাদা করে তাকে চিনে নিতে আমাদের অসুবিধে হয় না। তিনি প্রচলিত ট্র্যাডিশনকে ভেঙে নিজের মতো করে গতি দিয়েছেন; কাব্যভাষা হয়ে উঠেছে ম্যাজিক্যাল। কবিতার প্রয়োজনে তিনি ভাষাকে যেমন শাসন করেছেন তেমনই অতিকথন ঝেড়ে ভাষার পরিমিত ব্যবহার করেছেন। অতিব্যবহারের আড়ষ্টতা কাটিয়ে যেসব প্রচল শব্দ তিনি অসামান্য দক্ষতায় কবিতার শরীরে প্রোথিত করেছেন তা এক ম্যাজিক্যাল ফর্মেরই নির্দেশক। অঞ্জন আচার্য যথার্থই লিখেছিলেন, “নিজের কবিতার ভাষাকে ক্রমাগত ভাংচুর করতে করতে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন এমন এক ম্যাজিক-উপত্যকায়, যেখানে পৌঁছতে পিঠে এক ব্যাগ অতি-প্রাকৃতিক মন্তাজ ও মাথায় এক আকাশ নক্ষত্র প্রয়োজন।”
কৌরব প্রকাশনী থেকে থেকে ১৯৯৪-এ প্রকাশিত হয় উৎপলকুমার বসুর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ধূসর আতাগাছ’। এরপর তাঁর পাঁচটি গল্প নিয়ে “এটি উৎপলকুমার বসুর আরেকটি ছৌ, আরেক হোলি হ্যায়” ব্লার্ব, কমলকুমার মজুমদারের স্কেচ সম্বলিত প্রচ্ছদে প্রতিবিম্ব প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘উৎপলকুমার বসুর গল্প’। সংখ্যার দিক থেকে তিনি গল্প লিখেছেন অল্প ক’টি। তারমধ্যেই তিনি স্বকীয়তার প্রমাণ দিয়েছেন, দেখিয়েছেন তার গল্পের ধার। ‘সরলতা মিরর হাউজ’ শিরোনামে এক পাতার গল্প যেমন তিনি লিখেছেন, তেমনই লিখেছেন ‘রত্মাকর দেখেছিল’ -এর মতো দীর্ঘ গল্প।
উৎপলের সবথেকে বিধ্বংসী গল্প ‘নরখাদক’। একে তিনি গদ্য বলেছিলেন। ১৯৪৭ সালের শেষদিকে রাজপুর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে একজন মানুষের কাঁচা মাংস খাবার ঘটনা দিয়ে এ গল্প শুরু হয়। শেষে যা গড়ায় ধল ভূমগড়ের এক গ্রামীন কবরখানায়। প্রতিবেদনের ঢঙে রেখা এ গল্পে মানুষের মৃত্যুত্তোর মিশরীয় সমাজে মৃতদেহ সংরক্ষণের রোমহর্ষক বিবরণ ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে ‘নরখাদক’ চরিত্রটি। জ্যান্ত মুরগির ছাল-মাংস-অন্ত্র-পিত্ত-চর্বি-রক্ত-হাড় খাওয়ার নৃশংস বর্ণনার সমান্তরালে গল্পের পরবর্তী অংশে এক অর্ধভুক্ত জন্তুর লাল ছালছাড়ানো দেহের উপর বসে সেই মাংস খাওয়ার দৃশ্য বর্ণনা করে নরখাদকের করুণ জীবনকে জাজ্বল্য করেছেন উৎপলকুমার বসু। সামান্য উদ্ধৃত করি:
“আমরা জলার পাশে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ এবং লক্ষ্য করলাম দূরে একদল শকুন-কাকের সমারোহ। বলাবাহুল্য ঐখানে কোনো প্রাণীর মৃতদেহ পড়ে ছিল, চাষিরা মরা জন্তু-জানোয়ার ফেলে যায় ঐদিকে। আমরা একটু এগিয়ে গেলাম এবং আমাদের দেখে কয়েকটা পাখি উড়ে গেল, কয়েকটি বা সরে গেল দূরে। এবং আমরা স্পষ্ট দেখলাম এক অর্ধভুক্ত জন্তুর লাল ছালছাড়ানো দেহের উপর নিচু হয়ে বসে একটি মানুষ, একটি কালো রোগা লোমশ মানুষ, মাংস খাচ্ছেন একমনে। তিনি আমাদের লক্ষ্য করেননি প্রথমে কিন্তু দু-একটি কাক শকুন উড়ে যেতেই তিনি আমাদের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন এবং লক্ষ্য করেছিলাম তার দুটি কাতর, শান্ত, শাদা চোখ।”
অতঃপর গল্প চলে যায় প্রাচীন মিশরে। মিশরে মাটির নিচে আবিষ্কার হওয়া মৃতদের লোকালয় এবং সেইখানে পাওয়া মানুষ, কুকুর, বাঘ, বেড়াল, পাখি, কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদের সহস্র সহস্র মমি তৈরির গা ছমছমে বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “মিসরে আবিষ্কৃত হয়েছে মৃতদেহ লোকালয়ের মাটির নীচে। ... এ বিষয়ে দীর্ঘ বর্ণনা লিখে গেছেন হেরোডোটাস খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে। তিনি দেখে গেছেন সৎকার নিয়ে কলহ করছে পুরোহিত এবং দরিদ্র গ্রামবাসীরা। তিনি দেখছেন সৎকার-আলয়ে দীর্ঘদিন মৃতদেহগুলি ঝুলিয়ে রাখা হয়- যেমন মাংসের দোকানে ঝোলে মাংস। সেইখানে তরুণেরা শিক্ষানবিশী করে। তারা মৃতদেহ সংরক্ষণের পদ্ধতি শেখে, শেখে মন্ত্র-উচ্চারণ, তিনি দেখেছেন মৃতদের ব্যবহারের জন্য মন্দির, বাগান ও খেলার মাঠ তৈরি হতে। তিনি ঐ বিষ্ময়কর লোকালয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘নেকরোপলিস’ যা মৃতের শহর ও সভ্যতা।”
উৎপলকুমার বসুর ‘জয়মল্লার প্রসন্ন’, ‘বাবুরাম প্রচারশিল্প’, ‘সরলতা মিরর হাউস’, ‘ধূসর আতাগাছ’, ‘বড়দিন’, ‘ঘড়ি’, ‘নরখাদক’, ‘টোকিও লন্ড্রি’, ‘একদিন’, ‘শীতের সকালে’, ‘রত্নাকর দেখেছিল’ গল্পগুলোর পাঠ এমত ধারণাকেই পোক্ত করে যে, বর্তমান সময়ে গল্প ও কবিতার ফারাক ফুরিয়েছে। এ প্রসঙ্গে কবি পিয়াস মজিদের অনুভূতি পাঠ করা যাক, “উৎপলের গল্প পড়তে গিয়ে ভীষণভাবে মনে পড়ে হোর্হে লুই বোর্হেসের কথা যিনি মনে করতেন সময়ের রূপান্তরণে শিল্পমাধ্যমের সংজ্ঞাগত ভিন্নার্থক অস্তিত্ব অর্থহীন হতে বাধ্য। তখন গল্পই হয়ে যাবে কবিতা, কবিতাই হয়ে যাবে গল্প, উপন্যাস হয়ে যাবে নাটক।”
এ প্রসঙ্গে উৎপলের বক্তব্যও একই রকম। তাঁর গল্প নিয়ে যখন তুমুল সমালোচনা হচ্ছে। সেইসময় তাঁর চিন্তা তিনি লিখেছেন চিঠিতে। অসমাপ্ত এই চিঠি উৎপলের মৃত্যুর পর কবিপুত্র পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে উদ্ধার করেন। ‘প্রতিবিম্ব’ সম্পাদক প্রশান্ত মাজীকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, “অনেকদিন আগে, তা প্রায় বছর চল্লিশ হল বিলেতে এক শীতের রাতে বসে ‘নরখাদক’ গদ্যটি লিখেছিলুম। কোনো উচ্চাশা ছিল না। এটি না-গল্প, না-প্রবন্ধ, না-সাহিত্য। কিছু যে তথ্য পরিবশন করব- তেমনও প্রচেষ্টা ছিল না এই লেখায়। আমি মিথকেন্দ্রিক এক বোঝাপড়ার সম্মুখীন হয়েছিলুম। স্বভাবদোষে আমি সত্যের চেয়ে মিথ্যাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি।... মিথ মিথ্যা। কিন্তু কালজয়ী।”
উৎপলকুমার বসু স্যাটায়ার ভালোবাসতেন। এ তাঁর রচনা পড়লেই সুস্পষ্ট হয়। বিষয় যেমনই হোক, তাকে ঠিক ঠিক রূপান্তর করেন তিনি নিজ ভাষায়- ভঙ্গিমায়। বিষাদ পাথরেও তিনি প্রস্ফুটিত করেন হাস্যরঙ্গফুল। তাঁর স্যাটায়ার উঠে আসে জীবনের গভীর থেকে; জীবনের হল-কোলাহল, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, কাম-যৌনতা আর আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অনুষঙ্গের ভেতর থেকে। ফলে তা কেবলই স্যাটায়ার থাকে না- হয়ে ওঠে তারও অধিক। হোক সে ফিকশন কিংবা ননফিকশন। বরং তার ননফিকশনাল গদ্যে বাড়তি যুক্ততা ঘটে যুক্তির। ফলে তাঁর গদ্য হয়ে ওঠে যুক্তি ও স্যাটায়ারের সমাবেশ। পাশাপাশি ধ্রুপদিয়ানার ছাপ তো রয়েছেই। যা তার গদ্যকে করেছে সাবলীল ও মাধূর্যময়। ধ্রুপদী বাংলা সাহিত্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহের কথা তিনি তাঁর একাধিক রচনা ও সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন।
তাঁর আগ্রহ বৈচিত্রময়। বহু বিচিত্র প্রসঙ্গে এই আগ্রহের সন্ধান মেলে তার বিবিধ রচনায়। শুধু কবিতাই নয়, তিনি লিখেছেন ভারতের আভ্যন্তরীন ও বহির্বিশ্বের রাজনীতি ও সমাজনীতির প্রসঙ্গে, নিয়মিত। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানে মানুষ ঠিক কোন উপলব্ধিতে দাঁড়িয়ে, এই অস্থির সময়কালের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক কোন অবস্থান খুঁজে নেবে মানুষ তারও অন্ততদন্তে মগ্ন হতে দেখা যায় তাকে। অধুনালুপ্ত ‘টেলিভিশন’ পত্রিকায় এবং মাঝেমধ্যে ‘আজকাল’ দৈনিকের পাতায় ‘ধৃতিমান সেন’ ছদ্মনামে সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক নামচা লিখতেন তিনি। পরবর্তীতে ২০২১-এর এপ্রিলে সপ্তর্ষি থেকে প্রকাশিত হয় ‘ধৃতিমান সেনের ডায়েরি’। এ বই এক আদত্ত রাজনৈতিক কথামালা। আট ও নয়ের দশকের সময়কে কেন্দ্র করে বয়ে চলা রাজনীতি ও সমাজনীতির পালাবদলের ইতিহাস বলে এ বই। এছাড়াও নান্দীমুখ প্রকাশিত গদ্যসংগ্রহের ‘সমালোচনা সাহিত্য’ অংশ উল্টিয়ে দেখা যায় কত বিচিত্র বইয়ের দিকে ছিল তাঁর বিচরণ ব্যাপ্ত। ভবতোষ দত্ত, পরিমল গোস্বামী, অজয় হোম, জীবনানন্দ দাশ, সিগমুণ্ড ফ্রয়েড, হিরণ মিত্র, বিদ্যাসাগর, বিষ্ণু দে, উইলিয়ম রাদিচি, কমলকুমার মজুমদার, ফাল্গুনী রায়... এরকম আরো অনেক লেখকের বই নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি তিনি মনে করতেন, ‘বটতলাপ্রতিম লেখাকে ‘আগাছা’ বলে উপেক্ষার সুযোগ নেই বরং এরা অতিসাধারণ মানুষের কথা শৈল্পিক প্রসাধন-ছাড়া যে প্রাণদায়িনী ভঙ্গিতে সংকলন করে থাকে, সাহিত্যের ক্যানভাসে কোনো না কোনোভাবে এর মূল্য রচিত হয় বটে।’ আমাদের চারপাশে এরকম অনেক টেক্সট্ নানারূপে প্রকাশিত হয়, সে হোক কাগজে ছেপে, হাতে লিখে, প্রচারপত্ররূপে কিংবা দেয়ালে গ্রাফিত্তিরূপে, আমরা হয়তো সেসবকে গুরুত্ব দিই না, অবহেলায় উড়িয়ে দিই, অথবা আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। কিন্তু উৎপলের কাছে এসব অকল্পনীয় মর্যাদায় আসন পায়, যত্নআত্তিও পায়। আর তাই তিনি ক্যানভাসারের হাতে বিক্রি করা ফুলবালা রায়ের আড়াই টাকা মূল্যের ভূতের পাল্লায়, ভূতের জলসাঘর, জাহাজে আজব খুন-এর মতো বই নিয়েও কলম ধরেছেন। তিনি যেবার ঢাকায় এলেন, জহির হাসান রচিত সেই প্রতিবেদনের একটি ঘটনার দিকে নজর দেয়া যাক, “নিউমার্কেটের ওভারব্রিজের কাছে আমাদের রিক্সা পৌঁছালে একজন বোরকা পরিহিতা মাঝ বয়সী মহিলা আমাদের রিক্সায় একটা হ্যান্ডবিল (বোধহয় কোনো হারবালের বিজ্ঞাপন হবে) ছুড়ে দেয়। বাতাসে ভাসমান হ্যাণ্ডবিলখানা উৎপলদা অতি আগ্রহে কী যেন কী উড়ন্ত ধন মনে ভাবি খপ করি ধরলেন। ধরিই সুন্দর করি ভাঁজ করলেন। তারপর কাঁধের ব্যাগের ভেতর পুরি রাখলেন।” তারপর বললেন, “এগুলো আমি সংগ্রহ করি। আমার বাসায় একটা বড় খাতা আছে সেখানে গাম দিয়ে পেস্ট করি। যুগে যুগে প্রডাক্টের নানা রকমের বিজ্ঞাপন দেয় ছোট পুঁজির লোকেরা। এইখানে অনেক মজার মজার জিনিস পাওয়া যায়। দেখবা আজ থেকে দশ বছর আগের একটা হ্যান্ডবিলের ভাষার সাথে আরেকটা ভাষার মিল নাই। একটা বিবর্তন চোখে ধরা পড়ে। আমি অবসরে পেস্ট করা বহুদিন আগের এইসব হ্যান্ডবিলগুলো পড়ি।” এ যেন চারপাশের নানা তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়াবলীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম।
শূন্য বোতলের কাছে চুপ করে বসে থাকি।
মনে হয় এখানে-ওখানে বেড়াল ডাকছে।
জালিম লোশন লেখা হ্যান্ডবিলখানি কিছুটা পড়েছি।
সকালের কাগজ আসেনি।
বাড়ির মেয়েরা শয্যাতুলুনি ব’লে দু-শ টাকা আদায়
করেছে। নতুন জামাই খুশি মনে হাসছে দেখছি।
সূর্য কেতুর ঘরে। মীন সরে গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে।
(মীনযুদ্ধ/উৎপলকুমার বসু)
ব্যক্তিত্ব মূল্যায়নেও ব্রতী হয়েছিলেন উৎপলকুমার বসু। বঙ্কিমচন্দ্র, মহাত্মা গান্ধী, কমলকুমার মজুমদার, সমর সেন, সমরেস বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পিকাসোকন্যা পালোমা পিকাসো, এডওয়ার্ড জন টমসনের মতো ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লিখেছেন তিনি। চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে তাঁর লেখায় উঠে এসেছে কমেডির সমাজতত্ত্ব। ‘জ্ঞানদীপ্তি কাকে বলে’ শিরোনামে ক্যাথরিন পোর্টারের ইংরেজি তর্জমা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন উৎপল। এর মধ্য দিয়ে তাঁর দার্শনিক আগ্রহের পরিচয় আমরা পাই। এবং আমাদের পরিচয় ঘটে তাঁর অনুবাদক সত্তার সাথেও। তার অনুবাদে আমরা পাই সাফো-র কবিতা, কমলা দাসের কবিতা এবং মালয়ালম কবি আয়াপ্পা পানিকার এর কবিতা।
নবীন-প্রবীণ কবিদের নতুনতর কণ্ঠস্বরকে উর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা তিনি নানাভাবে করেছিলেন। কখনো প্রবন্ধ লিখে আবার কখনো লিটলম্যাগে জায়গা দিয়ে। এমনই কবিতাকেন্দ্রিত এক লিটলম্যাগের নাম ‘দরগারোড’। আলোক সরকার, কালীকৃষ্ণ গুহ, প্রকাশ কর্মকার এবং ভূমেন্দ্র গুহের সঙ্গে যুক্তভাবে উৎপলকুমার বসু এক সময় সম্পাদনা করেছেন কবিতা ও কবিতার বিষয়ক ভাবনার এই কাগজটি। অসংখ্য কবি সৃষ্টির অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছিলেন, “কলকাতার অনেকে ঠাট্টা করে বলে যে, আমি নিজে এত কবি সৃষ্টি করেছি, যদি অভিযোগ করা হয়, বাংলায় এত কবি কেনো, তাহলে নাকি আমাকেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তবে এটা খুব গৌরবের কথা, কবিতা যিনি লিখবেন তিনি এত বেশি স্বাধীনতাকামী, সত্যি কথা বলতে কি, যারা ফিল্ম করেন, ছবি আঁকেন, তাঁদেরও একটি পিছুটান আছে। আমাকে ভাবতে হবে আমার ছবি বিক্রি হবে কিনা, আমার ফিল্ম কে দেখবে এসব আর কী। কিন্তু কবিরা এদিকটায় একদম ঢুকতে চায় না।”
প্রয়াণের পর গোটা বাংলা কবিতাঞ্চলেই যেন আরো উজ্জ্বল-বিশিষ্ট হয়ে উঠছেন কবি উৎপলকুমার বসু। এর প্রভাব দেখা যায় উত্তর প্রজন্মের কবি-সাহিত্যিকদের রচনায়।
নির্বিচার অনুকরণে অনুপ্রাণিত করতে নয়, বরং তাঁর নবীনতার দর্শনকে আত্মস্থ করে আত্মপ্রকরণ আবিষ্কারের কাক্সক্ষা থেকেই ২০১৫ এ প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করি বিন্দুর উৎপলকুমার বসু সংখ্যা প্রকাশের। তখনো বিন্দুর ওয়েবসাইট চালু হয়নি। সংখ্যার পরিকল্পনা করতে থাকি। এর মধ্যে আমাদের হতবিহ্বল করে উৎপল প্রয়াত হলেন ২০১৫-র অক্টোবরে। সংখ্যা প্রকাশের যে আয়োজন, তার সামান্যই অগ্রগতি হয়েছিলো তখন। পরের বছর সেপ্টেম্বরে মাত্র ছয়জন লেখকের গদ্য নিয়ে প্রকাশ করলাম বিন্দুর ক্রোড়পত্র— ‘স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল’। পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা প্রকাশের ভাবনা মাথায় রয়েই নিয়েই কেটে গেল আরও চারটি বছর। এর মধ্যে বিন্দুর নানারকম কাজ হচ্ছে। কিন্তু উৎপল সংখ্যা আর প্রকাশ হচ্ছে না। লেখকগণ খোঁজ নিচ্ছেন—তাগাদা দিচ্ছেন— সংখ্যাটি প্রকাশের জন্য। কিন্তু আয়োজন তো শেষ হচ্ছে না! যতোটা চাইছি—ততোটা হচ্ছে না! উৎপলকে আরও পড়ছি— জানছি—অনুভব করছি—নবরূপে তাকে আবিষ্কার করছি—বছর গড়িয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ২০১৯ এর মার্চে বিন্দুর ওয়েবসাইট www.bindumag.com-এর যাত্রা শুরু হলো। পরিকল্পনায় খানিকটা পরিবর্তন এনে পরের বছর ঘোষণা দিলাম অনলাইনে উৎপলকুমার বসু সংখ্যা প্রকাশ করবো। ঘোষণা দেয়ার পর আরো সাড়া পেলাম বাঙলাদেশ ও ভারতের লেখকদের থেকে। যুক্ত হলো আরো নতুন প্রবন্ধ ও একটি কবিতা। সেইসব লেখাপত্র নিয়ে ২০২০ এর অক্টোবরে অনলাইনে প্রকাশিত হলো বিশেষ সংখ্যাটি। প্রকাশের পরই তা পাঠকমহলে সমাদৃত হলো এবং প্রস্তাব আসতে লাগলো– সংখ্যাটি প্রিন্ট করার। কিন্তু অনলাইন সংস্করণে যে কলেবর দাঁড়িয়েছে- তা মুদ্রণের ব্যায়ভার বহন করা বিন্দুর পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে বুঝতে পারলাম। পাশে দাঁড়াল ঘাসফুল প্রকাশনার মাহাদী আনাম। কলেবরের কথা চিন্তা করে আমি প্রথমে লেখা সংগ্রহের পরিধি বৃদ্ধি করিনি। কিন্তু মাহাদী ভাই বিপুল উৎসাহ নিয়ে বইটা প্রকাশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ায় নতুন উদ্যমে আবার শুরু হলো কাজ। নতুন করে লেখা সংগ্রহ করতে লাগলাম। নতুন লেখার পাশাপাশি পুরনো, গুরুত্বপূর্ণ লেখা, সাক্ষাৎকার স-ব খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। কোথায় কে কবে কী লিখেছেন, এধার-ওধার করতে লাগলাম স-ব। নীলাঞ্জন হাজরা দিলেন উৎপলের একটি সাক্ষাৎকার এবং উৎপল প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষের সাক্ষাৎকার। আরো তিনটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের অনুমতি দিলেন জহির হাসান, ওবায়েদ আকাশ ও অতনু সিংহ। এছাড়াও উৎপলের একটি অগ্রন্থিত প্রবন্ধ দিলেন সেলিম মণ্ডল। তন্ময় ভট্টাচার্য দিলেন হাংরি কথাসাহিত্যিক সুবিমল বসাকের বক্তব্যের ভিডিও। জহির হাসানের সৌজন্যে পেলাম উৎপলকুমার বসুর ঢাকা সফরের প্রতিবেদন। ১৯ মার্চ ২০১৩-এ ভারতের সাহিত্য আকাদেমি কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ‘meet the author: Utpal Kumar Basu’ হয়তো অধরাই রয়ে যেত যদি না রাজেশ দে এর সন্ধান দিতেন। অতিদ্রুত এটিকে বাঙলায় রূপান্তর করে দিয়েছেন সুশান্ত বর্মণ। আর উৎপল প্রসঙ্গে বিন্দুর যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সূচনালগ্ন থেকেই প্রচ্ছদ-স্কেচ- এই সকল ব্যাপারে রাজীব দত্ত অকুণ্ঠ সহযোগিতা করেছেন। এছাড়াও রাশেদুন্নবী সবুজ, মাহফুজুর রহমান লিংকন, শামীম সৈকত, মাসুমুল আলম, উদয়ন রাজীবসহ আরো অনেকেই দ্বিধাহীন সহযোগিতা করেছেন। বাঙলাদেশ ও ভারতের অনেক লেখক, সম্পাদক অকপটে লেখা দিয়ে, লেখা প্রকাশের অনুমতি দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। সকলের প্রতি আমার ঋণের শেষ নেই।
এ বইয়ে উৎপলের সঙ্গীসাথী, তরুণ বন্ধু, যারা নিকট থেকে দেখেছেন তাকে তাঁরা যেমন লিখলেন আবার তেমনই যাঁরা কখনো সাক্ষাৎ পাননি তাঁর- তারাও লিখলেন! যেদিকেই বাড়িয়েছি হাত করতল ঢেকেছে মাধুকরী!
এই সকল কিছু বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে বলেই আমার ধারণা। এই বইতে আরো যতোটা- ব্যাপক-বিস্তুত পরিসরে উৎপলকুমার বসুকে উপস্থাপন-পর্যালোচনা করা যেত, সম্পাদক হিসেবে হয়ত আমি তা পারিনি, কিছু ক্ষেত্রে ঠিকমতো গুছিয়েও উঠতে পারিনি হয়তো, অসম্পূর্ণতা থেকে গেল তবু—বেশ বুঝতে পারছি।
উল্লেখ্য যে, রচনাসমূহের শব্দবিধি ও বানান লেখকগণের নিজস্ব হওয়ায় বইয়ে একই শব্দের ভিন্ন বানান চোখে পড়বে। আর সূচি তৈরির ক্ষেত্রে বিন্দুর রীতি অনুযায়ী, জন্মসাল কিংবা খ্যাতির বিবেচনা না করে বিষয় অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছে।
বইটির বানান থেকে শুরু করে আরো আনুষঙ্গিক বিষয়ে হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কিছু ত্রুটি রয়ে গেল। দ্বিতীয় সংস্করণে তা কাটিয়ে ওঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা জারি থাকবে। পাঠক মহোদয় যদি অনুগ্রহ করে আমার এসব, এত বড় কাজে হাত দেয়ার ধৃষ্টতা মার্জনা করে বইটি সাদরে গ্রহণ করেন, বাধিত হবো।
সাম্য রাইয়ান
কুড়িগ্রাম, ফেব্রুয়ারি ২০২২
মন্তব্য