শম্ভূমিকা
পারমার্থিক ও ব্যবহারিক সত্তা দ্বারা অনলস নিরীক্ষাপ্রবণতা উদযাপন করতে করতেই কবি শম্ভু রক্ষিত রহস্যভাষার অঞ্জলি নিয়ে হাজির হয়েছেন মহাপৃথিবীর সামনে। বিচিত্র অনুসন্ধান করতে করতে সহজ শান্ত এক বিশুদ্ধ উজ্জ্বলতার ভিতর দিয়ে প্রবহমান তাঁর একক যাত্রা। শব্দের নতুন ব্যবহার, প্রয়োগের বিচ্ছুরণ যেন জাগতিক অসম্ভবতা, শব্দ ও সত্তার সীমা অতিক্রমের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যুক্তির নতুন আকাশে পৌঁছে দেয়; যেখানে পাঠকের কল্পনা ডানা মেলে উড়বার ফুসরত পায়—দু’দণ্ড শ্বাস নিতে পারে ধুলোবালিহীন আন্দোলনে। এ জগত, কবিনির্মিত—যার মহারাজা তিনি নিজেই; একাকী সিংহাসনে বসে লিখেন নিজের কবিতাখানি। যেখানে বাস্তব এবং কল্পনা নতুন আকার পায়। তাঁর কবিতাচর্চার সূত্রপাত ষাটের দশকে। প্রথম থেকেই তিনি বিশিষ্ট, তাঁর বোধে; বাক্ভঙ্গির অনন্যসাধারণ স্বকীয়তায়। কবিতায় সংস্কৃতি, গ্রীক, ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, উর্দু, হিন্দি প্রভৃতি বহুভাষাপ্রবাহ লক্ষ্যনীয় হলেও ভাষিক স্তরের ঊর্ধ্বে এক ব্যঞ্জনাময় গূঢ় চৈতন্যপ্রবাহই তাঁর নিজস্বতার দ্যোতক। ভিন্ন আঙ্গিকের গদ্যমুখী রচনা আর অন্যতর দৃশ্যকল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে সমসাময়িক সাহিত্য থেকে নিজেকে ভিন্ন করে তুলেছিলেন। যার গোপন প্রকরণ তিনি প্রচলিত আঙ্গিক ভেঙে স্বচ্ছন্দে নির্মাণ করেছেন বহুমাত্রিক ধ্বনিপ্রবাহ ও নিজস্ব ঘরানার অর্থবোধক শব্দ দিয়ে। তাঁর দেখা ও অভিজ্ঞতা যেন ভিন্ন জগতের। জীবন ও গণিতের অক্ষর ও চিহ্নমণ্ডলীকে পরপর স্থাপন করে তিনি যে মহাজাগতিক কবিতাবলয় নির্মাণ করেন, তার শব্দচয়ন, বাক্য-পংক্তি গঠন, প্রতীক নির্বাচন ও যুক্তির বিহঙ্গ এতটাই নতুন, যা প্রায়শই অনাবিষ্কৃত প্রত্ননিদর্শনের মতো আমাদের সমুখে হাজির হয়। কবিতার কল্পচিত্র, অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষা খানিক অপরিচিত অথবা যুক্তি অতিরেক হলেও রহস্যভাষায় নির্মিত তাঁর অতীন্দ্রিয় কাব্যচিত্রকুশলতা পাঠককে বারবার চমকিত করতে বাধ্য।
শম্ভু রক্ষিতের অধিকাংশ কবিতাই ‘আমি’ উত্তমপুরুষে লেখা। এই ‘আমি’ কখনো বর্ণনাতীত এক পুরুষ যে ত্রিকালজ্ঞ, ইতিহাসবিদ, ভাষাতাত্ত্বিক, সন্ন্যাসপ্রতীপ আবার কখনো চাষাভূষোর বেশে সজ্জিত এক ব্যক্তি— যে, মহামানব, দেবতা, যক্ষ, গন্ধর্ব অথবা স্বয়ং ঈশ্বরও হতে পারেন কিন্তু অনুমান করি তিনি আমাদের পরিচিত কোনো সাধারণ মানুষ না।
এ জগৎ ও তার অন্তরালবর্তী শক্তির প্রতি চিরন্তন বিষ্ময় বারবার ফুটে উঠেছে শম্ভু রক্ষিতের কবিতায়। তিনি প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠাকে একই সাথে উৎকর্ঢু করতে পেরেছেন বলেই কবিতা তাঁর যাপনের সাথে একাত্ম হয়ে রূপ নিয়েছে দীর্ঘপদযাত্রায়। ১৯৭৪ সালে ‘উত্তর দক্ষিণ’ নামে একটি সম্মেলক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সময়ে মুখপাত্রে তিনি লিখেছিলেন, “আমি ‘নেহাৎ কবিতা’ নির্মাণ করি না এই কারণে যে, আমি জানি, আমার যা বিশ্বাস, যা হঠাৎ হঠাৎ করি, তার মধ্যে বেঁচে থাকার একটা মুক্তি আছে।”
কবি শম্ভু রক্ষিত ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট হাওড়ার কদমতলায় (১১, ঠাকুরদাস দত্ত বাই লেন) মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নন্দলাল রক্ষিত ছিলেন ব্যবসায়ী, হাওড়ার দাশনগরে তাঁর একটি লোহার সিন্দুকের কারখানা ছিল। মা রাধারানী দেবী ছিলেন গৃহবধূ।
শব্দে শুধু নয়, জীবনচর্চায়ও তিনি বরাবরই প্রচলিত ধারার বাইরে। ৪৫ বছর ছিলেন মামার বাড়ি হাওড়ার ঠাকুর দাস দত্ত লেনে। ইচ্ছে হলে ব্যাগ মাথায় দিয়ে শুয়ে যেতেন কলেজ স্কোয়ারের পুকুরপাড়ে। কফি হাউসের চেয়ারে পা তুলে বসতেন একমাত্র মহাপৃথিবীর কবি শম্ভু রক্ষিত। জীবনের শেষ ৩০ বছর কাটিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবেড়িয়া গ্রামের বাড়িতে; ছোট্ট উঠোন ও একটি পুকুর নিয়ে যে বাড়ির নাম ‘নন্দায়ন’। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সুতাহাটার পূর্ব শ্রীকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বৃত্তি পরীক্ষা পাশ করে হাওড়ার কদমতলায় চলে আসেন। মাধ্যমিক পড়েন ব্যাটরা মধুসূদন পালচৌধুরী স্কুল থেকে। প্রথাগত শিক্ষায় অনাগ্রহী কবি হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ করেননি। কবিতা এবং পত্রিকা প্রকাশই ছিল তাঁর সর্বক্ষণের যাপন। লেখালেখির শুরু হাতে-লেখা স্কুলপত্রিকায়। প্রথম সম্পাদিত পত্রিকা ‘মা’। পরবর্তীতে হাংরি জেনারেশন নিয়ে ‘ব্লুজ’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন কলকাতা থেকে। অক্ষয়কুমার রমনলাল দেশাই সম্পাদিত ‘Violation of Democratic Rites’-এর তৃতীয় খন্ডে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “১৯৭৬ সালে পুলিশ শম্ভু রক্ষিতের উপর হাজতে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিলো আর তারপর বিনা বিচারে তাঁকে আট মাস আটক রাখা হয়েছিলো, ১৯৬৪ সালে শুরু হওয়া মামলার জেরে ‘ব্লুজ’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।” এ প্রসঙ্গে তিনি শ্যামল রক্ষিতকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “১৯৭৫-এর ২৬ জুন জরুরি অবস্থা জারি হয়। সেন্সরসিপ চালু হয় দেশে। এরপর আমরা ঠিক করি, সেন্সরসিপ অগ্রাহ্য করব। এই সময় কলকাতা থেকে কয়েকজন কবি-লেখক-সাংবাদিক ‘কলকাতা’ নামের একটি পত্রিকার বিশেষ ‘রাজনীতি সংখ্যা’ প্রকাশ করে। এর সম্পাদনা ও প্রকাশনায় আমার নাম জড়িয়ে যায়। সংখ্যাটি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। আমাকে ধরবার জন্য উঠে পড়ে লাগে। আমি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হই। ...কিন্তু স্পেশাল ব্রাঞ্চের হাতে তৎসত্ত্বেও ধরা পড়ি ১৯৭৬-এর ১৯ সেপ্টেম্বর। ‘রাজনীতি’ উদ্দেশ্যপূর্ণ রচনা। আসলে আমার সেদিনের ঐ লেখার মধ্যে ছিল জরুরি অবস্থার কিছু বিবরণ যা মাত্র কিছু পংক্তিতে আমি বিবৃত করেছিলাম।”
জরুরি অবস্থার সময় কবি সাত মাস জেল খেটেছেন। সে সময়ে কবির পাশে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য বাংলা তথা দেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পীরা ছবি এঁকে প্রদর্শনী করেছিলেন। চিত্রপ্রদর্শনীর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রবীন মন্ডল ও কবি কালীকৃষ্ণ গুহ। কারাবাস সম্পর্কে শম্ভু রক্ষিত বলেছেন, “দেখুন জেল খুব ভালো জায়গা। এই জেলখানাতে খুব সহজে যাওয়া যায় না। আপনার টাকাপয়সা থাকলে আপনি পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারবেন, কিন্তু আপনি ইচ্ছেমতো জেলখানায় যেতে পারবেন না। আমার তো জেলখানা খুব ভালো লেগেছে। আমার মনে হয় প্রত্যেক কবি যদি একবার করে জেলখানায় ঘুরে আসতে পারতেন তো খুব ভালো হত।”
ছয় ও সাত-এর দশকের কবিদের মধ্যে অন্যরকম কবিতা ও যাপনের কথা ভেবেছিলেন শম্ভু রক্ষিত। মাত্র তেইশ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য ‘সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ’ (১৯৭১); এরপর দ্বিতীয় কাব্য ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ (১৯৭৩), অভিনব কাব্যভাষার নিজস্ব স্বাক্ষরযুক্ত এ গ্রন্থ তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে অনন্য কবি হিসাবে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় কবিতাবই ‘রাজনীতি’ (১৯৭৬), ‘পাঠক, অক্ষরগুলি’ (১৯৮২), ‘সঙ্গহীন যাত্রা’ (যৌথ, ১৯৯১), ‘আমার বংশধররা’ (১৯৯৭), ‘আমি কেরর না অসুর’ (২০০৪), ‘ঝাড়বেলুনে জোট’ (২০১৩)। এছাড়া ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর গল্পের বই ‘শুকনো রোদ কিংবা তপ্তদিন অথবা নীরস আকাশ প্রভৃতি’ এবং ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘অস্ত্র নিরস্ত্র’ (১৯৮০)।
শম্ভু রক্ষিতের বইপত্র প্রসঙ্গে ‘মহাপৃথিবীর বাউল ও তীর্থঙ্কর’ প্রবন্ধে সুনীল মাজি লিখেন, “শম্ভু রক্ষিত বাংলা সাহিত্যে প্রথম কাব্যগ্রন্থ আনেন এক জিজ্ঞাসার বিস্ময়কে সম্বল করে, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধ্বনিময় আর্তি ছিল তার সম্পদ। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রাজনীতি’ ছিল ক্ষমতার তথা কংকালের কোলাহল ও অহংকার। আর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থে তিনি রেখায় রেখায় চেনাতে চাইলেন ধমনীর স্রোত। এই অক্ষরই মূলস্রোত। এই অক্ষররাই বিবেকানন্দ, কবির বাবা, সোনার দাসী তথা কবির সহধর্মিনী-যার শরীরে কবির বেদনা মাখানো গন্ধ থাকে। এই অক্ষররাই কবির প্রেম, হৃদিকথা, সম্মোহন, চিন্তন, মড়িঘর এবং জিদ বা সংকল্পের মতো অনেক ইত্যাদি প্রভৃতি।”
আজীবন এক নির্বাসিত কবিতাযাপন করেছেন এই কবি। স্পর্ধার সঙ্গে মিশেছিল তাঁর কাব্যভাবনার নিমগ্ন অভিযাত্রা। ২০২০ সালের ২৯ মে শুক্রবার সকাল আটটার দিকে থেমে যায শম্ভুযাত্রা। ঐদিন বিকেলে সুতাহাটার চাঁপি শ্মশানে সম্পন্ন হয় তাঁর শেষকৃত্য। যেমনটা কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, “তার কবিতা সমকালের পাঠকরা সেভাবে অনুধাবন করতে না পারলেও আগামী দিনের পাঠকরা সঠিক মূল্যায়ন করবে।” কবিপ্রয়াণের পর গোটা বাংলা কবিতাঞ্চলেই যেন এ ভবিষ্যদ্বাণী ক্রমশ অকাট্য হয়ে উঠছে।
প্রায় চার বছরের শ্রমলব্ধ এ কাজ- ‘শম্ভু রক্ষিত: পাঠ ও বিবেচনা’। যারা তাকে নিকট থেকে দেখেছেন তারা যেমন লিখলেন, আবার তেমনই যারা কখনো সাক্ষাৎ পাননি তাঁর- তারাও লিখলেন! যেদিকে বাড়িয়েছি হাত করতল ঢেকেছে মাধুকরী! বাঙলাদেশ ও ভারতের অনেক লেখক, সম্পাদক অকপটে লেখা দিয়ে, লেখা প্রকাশের অনুমতি দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। সকলের প্রতি আমার ঋণের শেষ নেই। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, কবিভ্রাতা শ্যামল রক্ষিতের কথা, যিনি লেখা পাঠিয়েই শুধু নয়, মূল্যবান দিকনির্দেশনা দিয়ে পাশে থেকেছেন। এছাড়া কয়েকটি পত্রিকার কাছে রইলো লেখা প্রকাশের ঋণ- তিতীর্ষু, চার নম্বর প্লাটফর্ম, দুনিয়াদারি, যুগন্ধর, সেই সন্দীপন... কৃতজ্ঞতার সাথে উল্লেখ্য, শম্ভু রক্ষিতের কবিতা ও কবিতাংশ গ্রহণ করা হয়েছে দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কবিতা সমগ্র’ (প্রথম মুদ্রণ: মার্চ ২০২২, দি সী বুক এজেন্সী, কলকাতা) গ্রন্থ থেকে। এছাড়া কবির অন্যান্য রচনা (গল্প, প্রবন্ধ) সংগ্রহ করে পাঠিয়েছেন শ্যামল রক্ষিত।
রাজীব দত্ত দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকে সহযোগিতা করেছেন। ঘাসফুলের কর্ণধার মাহ্দী ভাই- উনি তো বরাবরের মতোই সকল নিয়ে বসে আছেন আমাকে নির্ভার করতে-! অনেকগুলো লেখা টেক্সটে কনভার্ট করে দিয়েছেন এক আড়ালপ্রিয়জন! শুধু কি তাই, আরো কত কাজ থাকে অন্তরালে, যার কোন একটিতে ব্যাত্যয় ঘটলে সম্পূর্ণ যজ্ঞই ব্যাহত হয়, সেইসব যারা সম্পন্ন করেছেন, সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
বইটিকে সমৃদ্ধ করতে- বিস্তৃত পরিসরে শম্ভু রক্ষিতকে উপস্থাপন-পর্যালোচনা করতে আমাদের সাধ্যমতো প্রচেষ্টার পরেও অসম্পূর্ণতা থেকে গেল হয়তো! বানান থেকে শুরু করে আরো আনুষঙ্গিক বিষয়ে হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কিছু ত্রুটি রয়ে গেল। দ্বিতীয় সংস্করণে তা কাটিয়ে ওঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। পাঠক মহোদয় যদি অনুগ্রহ করে আমার এসব, এত বড় কাজে হাত দেয়ার ধৃষ্টতা মার্জনা করেন, বাধিত হবো।
সাম্য রাইয়ান
সম্পাদক, বিন্দু
বইটি কিনতে [এখানে ক্লিক করুন]
মন্তব্য