লেখাগুলি আমাকেই বলে ৩৩রাহুল পুরকায়স্থআমারও ক্ষতের মাঝে পলি পড়ে আছেতুমি তাকে শিল্প রূপে চালাও বাজারে বাজারে বায়স ওড়ে, ঠোঁটে ওড়ে পাণ্ডুলিপিখানিকী কী লিপি লেখা আছেতুমি কল্পনা কর, আরভূতগ্রস্ত শামুকেরা মাথার উপরে দেখিগড়াগড়ি যায়আনন্দস্বরূপ এই বেঁচে থাকাযেন সাইকেল, দৃষ্টি-আবছায়েতারা বৃক্ষে মিশে গেলকেতলিতে জল ফোটে, বাষ্প, বাষ্প, বাষ্পেভরে যায় কবিতার খাতাকে তুমি আমাকে নাচাও, নাচাও প্রিয় বাজারে রটাও আজও বসন্ত-বারতা।
পৃথিবীতে প্রতিটি যুগেই কবিতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে। অথচ এই অপ্রয়োজনীয়তাই সবচেয়ে জরুরি সত্য হয়ে উঠে যখন একজন কবি উচ্চারণ করেন—
আমারও ক্ষতের মাঝে পলি পড়ে আছে।
এই একটি পংক্তিতেই রাহুল পুরকায়স্থ বুঝিয়ে দেন—কবিতা কেবল বাহ্য রূপ নয়, তা ক্ষতের আবরণও নয়, বরং জমে থাকা পলির মতো, ধীরে ধীরে তৈরি করে এক নতুন ভাষা, নতুন অনুভব, এমনকি নতুন রাজনৈতিক বোধ। ‘লেখাগুলি আমাকেই বলে’ কাব্যভুক্ত ৩৩ নম্বর কবিতাটি রাহুলের কবি-চেতনাকে গভীরভাবে চিনে নেওয়ার এক অনুপম রচনাচিহ্ন।
এই কবিতায় শিল্প, পণ্য, বাজার ও কবিতার শরীর—এই চারটি সত্তা পরস্পরকে ধাক্কা দিতে দিতে চলে। কবি বলেন—
তুমি তাকে শিল্প রূপে চালাও বাজারেবাজারে বায়স ওড়ে, ঠোঁটে ওড়ে পাণ্ডুলিপিখানি
শিল্পের পণ্যায়ন নিয়ে তার এ উক্তি সংক্ষিপ্ত অথচ তীক্ষ্ণ। এখানে শিল্প একটি স্বাধীন সৃষ্টি নয়—তাকে চালানো হচ্ছে, অর্থাৎ চালকের হাতে সে অসহায়। যে শিল্প একদিন মানুষের মুক্তি বা প্রতিরোধের ভাষা ছিল, সে এখন বাজারের ঠোঁটে লিপস্টিক হয়ে ওঠে, ‘পাণ্ডুলিপিখানি’ হয়ে ওঠে উচ্চারণযোগ্য স্লোগান। এই ‘ওড়ে’র ব্যবহার—একদিকে বায়সের মতো ধূর্ত, অন্যদিকে ঠোঁটের মতো চটুল—দ্বিবাচনিকতার দারুণ উদাহরণ।
এই কবিতার ‘তুমি’ আসলে কে? প্রেমিকা? পাঠক? রাষ্ট্র? শিল্প-নির্মাণের নিয়ন্ত্রক? না কি আমাদেরই ভেতরের সেই অংশ, যা কখনো নিজেকে শিল্পীর বাইরে মনে করে এবং কবিকে চালিয়ে নেয় বাজারে? এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে কবি দেখতে পান ভূতগ্রস্ত শামুকের গড়াগড়ি—
তুমি কল্পনা কর, আরভূতগ্রস্ত শামুকেরা মাথার উপরে দেখিগড়াগড়ি যায়
এই চিত্রকল্প নিছক Surrealist বা অবচেতনা-নির্ভর নয়। এটি এক রাজনৈতিক উপমা। ‘ভূতগ্রস্ত শামুক’—যারা ধীরে চলে, যারা আত্মরক্ষায় খোলসে ঢুকে পড়ে, তারা আজ উল্টে গেছে, গড়াগড়ি খাচ্ছে মানুষের মাথার উপর। তাদের ‘ভূতগ্রস্ততা’ আসলে আমাদেরই আতঙ্ক, যা আমরা দীর্ঘকাল এড়িয়ে চলি। শিল্পের ক্ষয়, বাজারে রটনা, ভাষার সাম্রাজ্যবাদের ফলে যে সাংস্কৃতিক ভূত জন্মেছে—তারা আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমাদের চিন্তা-চেতনার উপরেই রাখছে প্রভাব!
এরপর কবি বলেন—
আনন্দস্বরূপ এই বেঁচে থাকাযেন সাইকেল, দৃষ্টি-আবছায়ে
মানুষ ভিন্ন আবহে অভিন্ন আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে যেন এক রূপকথার ধোঁয়াটে গ্রামে, চারপাশে কুয়াশা, কিন্তু তার গন্তব্য নেই। ‘আনন্দ’ নিছকই আশাবাদ নয়, বরং বেঁচে থাকার একটি অনিবার্য খেলা, যেখানে দৃষ্টি সবসময় স্পষ্ট নয়। বরং কুয়াশা, বিভ্রম, গতি—এইসব নিয়েই জীবনের যাত্রা।
তবে এই দৃষ্টি-আবছায়ে সত্তারও তো এক জৈব অস্তিত্ব আছে। সেই অস্তিত্বই হয়তো—
তারা বৃক্ষে মিশে গেলকেতলিতে জল ফোটে, বাষ্প, বাষ্প, বাষ্পেভরে যায় কবিতার খাতা
‘তারা’ কারা? যে ভূতগ্রস্ত শামুকেরা, না কি সেই শোষিত মানুষেরা, যাদের দেহ-মন একসময় গাছ হয়ে যায়? বা সেই অদৃশ্য পাঠকেরা, যাদের স্পন্দনেই কবিতার কেতলি চাপে? এই উপমাটি অসাধারণ। কবিতা এখানে কেতলি, তাতে ফুটে উঠছে জল, তার থেকে ওঠা বাষ্প—যা দিয়ে ‘কবিতার খাতা’ ভরে যায়। অথচ বাষ্প ধরতে পারি না, বাষ্পের কোনও রং নেই, গন্ধ নেই—আছে শুধু ক্ষণস্থায়ী উপস্থিতি। অর্থাৎ কবিতা একটি অভাবের ভাষা, যা পূর্ণ হয়ে ওঠে অনুপস্থিতির মধ্য দিয়ে।
শেষে কবি এক তীব্র আত্মসমর্পণ আর প্রতিবাদ একসঙ্গে উচ্চারণ করেন—
কে তুমি আমাকে নাচাও, নাচাও প্রিয়বাজারে রটাও আজও বসন্ত-বারতা।
এই ‘নাচানো’ একধরনের শোষণ—কবি জানেন, তার ভাষা, তার ব্যথা, তার ক্ষত—সবই বাজার উপভোগ করে। বসন্ত একসময় ছিল প্রেম ও পুণর্জন্মের ঋতু—কিন্তু এখানে বসন্ত কেবল ‘বারতা’, মানে প্রচারপত্র, মানে বিজ্ঞাপন। বসন্তের যৌবনকে পণ্য করে ফেলা হয়েছে। এইরকম ভাষা-রাজনীতির মুখে কবি আত্মজিজ্ঞাসায় ভেঙে পড়েন—‘কে তুমি’—এই প্রশ্নটি একদিকে ব্যক্তি-জিজ্ঞাসা, আবার অন্যদিকে সমষ্টিগত আত্মসন্ধান।
রাহুল পুরকায়স্থ মূলত আত্মানুসন্ধানী কবি। তাঁর কবিতা আত্মবীক্ষণ, প্রাত্যহিকতা এবং রাজনৈতিক বোধের মিশ্রণে তৈরি। তিনি কখনোই সরাসরি শ্লোগান বা বক্তব্যে যান না; বরং চিত্রকল্পের মধ্যে দিয়ে নির্মাণ করেন প্রতিরোধের কাব্য। এই কবিতাটিও সেই শৈলীর নিখুঁত উদাহরণ।
আমরা যেন এই কবিতার ভেতর দিয়ে হাঁটি—পলি পড়া ক্ষত থেকে বাজারের ঠোঁটে চেপে ধরা পাণ্ডুলিপি পর্যন্ত, এবং শেষে বসন্তের বারতা হয়ে ওঠা প্রচারণার মুখে দাঁড়িয়ে নিজের দৃষ্টিকে খুঁজি, স্পষ্ট করতে চাই সেই আবছায়া।
এই কবিতাটি শুধুমাত্র এক সামাজিক সমালোচনা নয়, এটি এক আত্মপ্রতিকৃতি—যেখানে কবি নিজেই শিল্প ও শিল্প-চালিতের দ্বন্দ্বে আটকে যান। তাই তো কবিতার খাতা কেবল ‘ভরে যায়’—তার মধ্যে বাস করে বাষ্প, এবং সেই বাষ্পের মধ্যে আমরা খুঁজি কবির মুখ, আমাদেরও।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— “যে কাঁদে সে পায়, যে পায় সে কাঁদে”। রাহুলের কবিতা যেন সেই কাঁদা-পাওয়ার অনন্তচক্র—যেন সাইকেল।
রাহুল পুরকায়স্থ’র কবিতালোচনা
বাজারে রটিত বসন্ত ও ভূতগ্রস্ত শামুকেরা
সাম্য রাইয়ান
বাজারে রটিত বসন্ত ও ভূতগ্রস্ত শামুকেরা
সাম্য রাইয়ান
খুব ভালো লাগলো দাদা
উত্তরমুছুনএতো সুন্দর আলোচনা, প্রতিটি জীবনের বাঁকে, আমাদের আশাতীত জীবনের আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি, আর জীবন বিক্ষণ এর উপলব্ধি কবিদের কোথাও যেন তাড়না হয়েই থাকে।
খুব ভালো লেখা দাদা।
উত্তরমুছুনসত্যিই যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা।মুগ্ধ হলাম।