উনিশশো সাতচল্লিশ সালের শেষদিকে রাজপুর উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ের নাম বদলে হয় রাজপুর উচ্চ বিদ্যালয় অর্থাৎ ইংরাজি শব্দটি বাদ যায় ঐ নাম থেকে এবং সে-বছর আমাদের ইস্কুলে, মানে ঐ স্কুলে, এক নরখাদক আসেন। আমাদের ওখানে প্রায়ই সভাসমিতি কবিতাপাঠ জন্মদিন ইত্যাদি পালন করা হত এবং একদা বারীন রায় আমাদের 'আমেরিকার অভিজ্ঞতা' নামে একটা ছোট্টো চমৎকার বক্তৃতা দেন। তারপর আসেন একজন মাতাল ম্যাজিসিয়ান এবং তাঁর মুখেই প্রথম শুনি পি.সি. সরকারকে পি. সি. সোরসার বলে সম্বোধন করতে। তারপর আসে রবীন্দ্র-জয়ন্তী। তারপর দীর্ঘদিন কিছুই আসে না। তারপর শীতের সুরুতে, যখন রাজপুর হাটে প্রথম নতুন আলু উঠেছে এবং সন্ধের অন্ধকারে ধোঁয়ায়ভরা রান্নাঘরে বসে আমরা জমির প্রথম বাঁধাকপির তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করেছি, সে-বছর শীতের সুরুর দিকে আমাদের গ্রামে আসেন এক নরখাদক অর্থাৎ আমাদেরই ইস্কুল থেকে তাঁকে নিয়ে আসা হয় খেলা-দেখানোর জন্যে এবং কী কারণে জানি না আমার উপরে ভার প'ড়ে দু'দিন দু'রাত্রির জন্য তাঁর তত্ত্বাবধান করার। ভদ্রলোক ওঠেন ছেলেদের হস্টেলে, তাঁকে একটা ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়। আমিই তাঁকে নিয়ে আসি ইষ্টিশান থেকে এবং লক্ষ্য করি, ঘরে স্থিত হয়ে বসবার আগেই তিনি, বাক্স খুলে, তিলকের গীতা, মহাভারত ইত্যাদি শ্রেণীর ছ'সাতটি বই টেবিলের উপর সাজিয়ে ফ্যালেন ও আমি তাঁকে ঐ দিনই হাটে নিয়ে যাই বিকেলে এবং তাঁর হাতে একটা ছোটো খাঁচা ছিল। আমরা হাট থেকে কিনি এক মাঝারি সাইজের শাদা চমৎকার জ্যান্ত মুরগি দাম পড়ে সাড়ে তিন টাকা যেটা আমি দিই (বলাবাহুল্য, টাকাটা আমাদের হেডমাস্টার দিয়েছিলেন) এবং তারপর আমরা সিনেমা হলের পাশেই যে বিখ্যাত রেস্টুরেন্টটি ছিল সেখানে বসে নানা ধরণের চপকাটলেট খাই (ভদ্রলোকই দাম দেন)। মুরগিটি খাঁচার মধ্যে থেকে ডানা ঝাপ্টাতে থাকে এবং ভদ্রলোক বিড় বিড় ক'রে বলেন, 'চুপ কর', 'চুপ কর'। তাঁকে আমার বেশ স্বাভাবিকই লাগে এবং অন্ধকার হবার আগেই অর্থাৎ রেষ্টুরেন্টে হ্যাজাক জ্বলে উঠবার আগে আমরা হস্টেলে ফিরে আসি। ভদ্রলোক তাঁর নিজের ঘরের দিকে চলে যান আমাকে 'গুডনাইট' ব'লে এবং আমিও বাড়িতে ফিরে আসি। ভদ্রলোককে আমার বেশ শিক্ষিত এবং স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল।
পরের দিন, সোমবার, টিফিনের সময় ইস্কুলে ছুটি হয়ে যায় এবং কয়েক'শ ছেলে মাঠে জমায়েত হয় নরখাদকের খেলা দেখার জন্য। ভদ্রলোক সাদা ধুতিপাঞ্জাবি পরে, হাতে খাঁচাটি দুলিয়ে বেলা বারোটা নাগাদ এসে হাজির হন মাঠে যার কোনের দিকে একটা টিনের ছোটো ঘর ছিল। ছেলেরা তাঁকে হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানায় কিন্তু ভদ্রলোক ও'সব কিছুই লক্ষ্য করেন না। তাঁর মুখে একধরনের আতঙ্কজাত কোমলতা আমি লক্ষ্য করি যেমন লক্ষ্য করেছি হেডমাস্টারের মুখে ঠিক বেত মারার আগে। ভদ্রলোক সোজা টিনের ঘরের দিকে চলে আসেন এবং আমাকে প্রশ্ন করেন 'বাজনা এসেছে কি'। বলাবাহুল্য তার আধঘণ্টা আগে থেকেই মাঠে একদল লোক তীব্রসুরে ঢাক ঢোল করতাল বাজিয়ে চলেছে। আমি বলি 'হ্যাঁ', ব'লে ভদ্রলোকের হাত থেকে খাঁচাটি নিয়ে ঘরের কোনার দিকে রাখি। ভদ্রলোক ঝুলি থেকে নানাধরনের পেইন্ট পাউডার মেকাপ ক'রে করে মুখে মাখতে থাকে। ভদ্রলোকের পরণে তখন একটি ছোটো নীল জাঙিয়া, গা হাত-পা লোমে ভরা এবং মাথায় কর্কশ কালো চুল যা তিনি চিরুনি এবং বুরুশ দিয়ে আরো ঝাঁকিয়ে তোলেন। তারপর তিনি চোখে কালো সুর্মা এঁকে নেন আমি সামনে আয়না ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। ধীরে ধীরে তাঁর চেহারা ক্রমশই অস্বাভাবিক এবং কোমল হ'তে থাকে। আমি সমস্তটা দেখি ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে এবং অন্য অনেক ছেলেও উকিঝুঁকি মেরে দেখে যায় দরজার আড়াল থেকে। তাঁর তৈরি হতে আধঘণ্টাটাক লাগে এবং তারপর তিনি খাঁচায় মুরগিটির গায়ে জল ছিটোতে থাকেন এবং মাঠে দর্শকরা ক্রমে অধৈর্য হয়ে পড়ে। ওঁনার আদেশে মুরগিটিকে শেষবারের মতো কিছু চাল খেতে দিই এবং ভদ্রলোক আমাকে আসন্ন সময় সম্পর্কে কয়েক মিনিট ধরে নির্দেশ দেন যে ঠিক কী কী করতে হবে।
বেলা দেড়টার সময়ে খেলা সুরু হয়। ইতিমধ্যে মহকুমা হাকিম, তাঁর স্ত্রী, হেডমাষ্টার সবাই প্রথম সারির চেয়ারে বসে পড়েছেন। মাঠে ছেলেদের সংখ্যা বাড়ছে এবং মেয়ে-ইস্কুল থেকে কিছু মেয়ে এসে হাজির। বেশ গরম লাগছে সকলেরই যদিও শীতের সুরু কিন্তু উপরে প্রচণ্ড সূর্য, মাঠে একটাও গাছ নেই, তারই মধ্যে হাজারখানেক লোক সমবেত হয়েছে এই খেলা দেখার জন্য।
বাজনা একটু ঢিমিয়ে পড়ে এবং সহসা টিনের দরজা ঠেলে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হন নরখাদক। মাঠ হৈ হৈ করে ওঠে। নরখাদকের গায়ে লাল সালুর চাদর যেটা তিনি ছুঁড়ে পেলে দেন দর্শকদের দিকে। তাঁর কালো লোমশ ও নীল জাঙিয়া পরা নগ্নতা এবার সম্পূর্ণ দেখা যায়। মাথায় উন্মাদের মতন চুল, আঙুলে লাল নখ, পায়ের নখ লাল, কানে মাকড়ি, কোমরে তামাবসানো বেল্ট এবং আরক্ত চোখে তিনি দর্শকদের দিকে তাকিয়ে তীব্রস্বরে চিৎকার করে ওঠেন 'চুপ কর', চুপ কর'।
কিন্তু প্রথমে কেউই চুপ করে না, নরখাদক থমকে দাঁড়িয়ে থাকেন আমাদের সামনে, নাটুকে ভঙ্গিতে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই মাঠ স্তব্ধ হয় যায়। আমাদের ড্রিলমাষ্টার এসে একটা ছোটোখাটো বক্তৃতা দেন যার মর্ম হ'ল এই যে, এ খেলা মানুষের পক্ষে সম্ভব না। অর্থাৎ দেশের বর্তমান আইন অনুযায়ী (মানে, বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায়) মানুষের পক্ষে মানুষের মাংস খাওয়া বারণ। এমন কি আমরা কাঁচা মাংসও আর খাই না কারণ আমরা আজ সভ্য। কিন্তু দু'একটি সম্প্রদায় আজো পুরানো রীতি অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক ভাবে, জীবজন্তুর কাঁচা মাংস খেয়ে থাকে এ'কথা আমরা কাগজে বা বই-এ পড়েছি। আজ, দর্শকগণ এবং ছেলেরা, আমরা দেখতে চাই ঐ তথ্য সত্য কি না। মাঠে চটপট হাততালি পড়ে এবং আবারো বাজনা সুরু হয়।
নরখাদক তাঁর পেটে জড়িয়ে নেন একটা লম্বা শক্ত পাটের দড়ি এবং দু'পাশে দুই দল ছেলে সেই দড়ি ধ'রে টানতে থাকে। ক্রমশ নরখাদকের পেট কৃশ হয়ে আসে এবং ফুলে ওঠে তাঁর পেশী এবং চোখ। ক্রমশ তাঁর ঠোঁটের দু'পাশে ফেনা দেখা দেয়- দারুণ সূর্যের আলোয় ঝক্ ক'রে ওঠে তাঁর কড়ির মতো শাদা দাঁত। আকাশে দু'হাত তুলে দাঁড়ান তিনি এবং আমি খাঁচা থেকে মুরগিটিকে বের ক'রে বুকের কাছে ধরি, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই এবং পাশে তির তির ক'রে বাজতে থাকে ড্রাম। তারপর বাজনা একসময় থেকে যায়, মাঠ একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায় একমুহূর্তের জন্য, এবং ঠিক সেই মুহূর্তে আমি সজোরে মুরগিটিকে, সেই জীবন্ত পাখিটাকে, ছুঁড়ে দিই আকাশের দিকে। নরখাদক তাকে লুফে নেন শূন্যে-দু'টিকেই আমি একমুহূর্তের জন্য উড়ন্ত দেখি শূন্যে এবং সেইখানেই মানুষ দাঁত বসিয়ে দেয় মুরগির বুকে, নিচে রক্ত ছিটকে পড়ে চারিদিকে। আমি একই সঙ্গে মুরগির আর্তনাদ এবং নরখাদকের গর্জন শুনি। তারপর মাঠের উপর হাঁটু পেতে বসেন নরখাদক, তাঁর মাথা শরীর ঢেকে যায় লঘু শাদা পালকে, চোখ বুজে যায় রক্তে, তিনি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকেন মাংস। আমরা, এক হাজার লোক, হাততালি দিই। নরখাদক মাংস থেকে একবার-দু'বার চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকান কিন্তু খাওয়া থাকে না। মুরগির মাথাটি পড়ে থাকে মাটিতে, আমি দেখি তার লাল ফুল কাঁপছে, আমি দেখি নরখাদক মুরগির পেটের ভিতর থেকে টেনে বের করে আনছেন অস্ত্র এবং সবুজ পিত্ত এবং শাদা চাল এবং কালো হৃদয় যা তিনি সোজা মুখে পুরে দেন এবং চিবোতে থাকেন চোখ বন্ধ ক'রে, মুরগির গলাটাকে দাঁতে টেনে লম্বা ক'রে তিনি ছিঁড়ে ফ্যালেন, হাড় বেঁধে আঙুলে, নখে কেটে যায় বাহু, নিজের রক্ত এবং মুরগির রক্ত মিশে যেতে থাকে। তিনি তাই খেতে থাকেন। আঙুল দিয়ে তিনি মুরগির পেটের ভিতর থেকে বের করে আনেন বিষ্ঠা, তাই খান, এবং হেসে তাকান আমাদের দিকে যে হাসি, আজ আমার মনে হয়, কিছু বা লজ্জায় মেশা ছিল।
আমরা জামা থেকে ঝেড়ে ফেলি পালক। বাজনা বেজেই চলে। নরখাদকের কাতরতা প্রকাশ পায় ক্রমশ। তাঁকে আমি জন্তুর মতো হামাগুড়ি দিতে দেখি মাঠের উপরে। তিনি খুঁজে পান আরো মাংস, হাড় ও পালক এবং সবই মুখে পুরে দেন, চিবোতে থাকেন, আমরা বারবার হাততালি দিই, তিনি এবার আর তাড়াহুড়ো করেন না, বেশ সময় নিয়ে কুরে কুরে খান মাংস, হাড় এবং পালক এবং চর্বি, ছাল, শ্বাসনলী, উদর, রক্ত ও নখ। আমি একটু এগিয়ে এসে পড়ে থাকা মুরগির মাথাটি তুলে ধরি তাঁর মুখের কাছে এবং তিনিও জন্তুর মতো মুখ দিয়েই কেড়ে নেন ঐ মাংসের টুকরো, আমার আঙুল তাঁর দাঁতে লাগে, জিভ লাগে; এবং রক্তও লেগে থাকে সারাদিন।
পরদিন সন্ধেবেলায় আমি ঐ ভদ্রলোককে তুলে দিই ট্রেনে। হেডমাস্টার তাঁকে দেন কবিগুরুর এক কপি সঞ্চয়িতা এবং কুড়িটা টাকা। ভদ্রলোক স্টেশনে আমাকে এক ঠোঙা টফি কিনে দেন এবং ট্রেন ছাড়ার সময় আমি দেখি ঐ ভদ্রলোক হাতের মোটা বইটা উল্টেপাল্টে দেখছেন জানালার পাশে বসে।
পরের বছর, ইতিমধ্যে অনেক উত্থানপতন ঘটেছে নানাদিকে, আমরা শীতকালে জয়ন্তী পাহাড়ে যাই পাখি শিকারে। সেখানে শীতে আসে হরিতেল এবং নদীতে আসে বালিহাঁস। আমি এবং হাকিমের ছেলে রাধারঞ্জন বা রাধা এবং সে-ই সঙ্গে আনে একটা দোনলা ছোটো বন্দুক। আমি আনি টোটা, গোটা কুড়ি ত্রিশ এবং ভোরবেলা রওনা দিই, রোদ উঠলে পাখি পাওয়া যায় না কিন্তু পথে আমাদের নানাকারণে দেরি হয়ে যায়। পাহাড়তলিতে পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ বেলা হয়ে গেল। সারাদিন আমরা শালের জঙ্গলে ঘুরি, নদী পায়ে হেঁটে পার হলাম কয়েকবার কিন্তু ঘুঘু ছাড়া আর কোনো আকর্ষণীয় পাখি সেবার পাওয়া গেল না। ক্রমে বিকেল পড়ে এল। আমরা এসে পৌঁছলাম এক জলার ধারে যেখান থেকে আমাদের ফিরে আসার কথা। আমরা জলার পাশে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ এবং লক্ষ্য করলাম দূরে একদল শকুন-কাকের সমারোহ। বলাবাহুল্য ঐখানে কোনো প্রাণীর মৃতদেহ পড়ে ছিল, চাষীরা মরা জন্তু জানোয়ার ফেলে যায় ঐদিকে। আমরা একটু এগিয়ে গেলাম এবং আমাদের দেখে কয়েকটা পাখি উড়ে গেল, কয়েকটি বা সরে গেল দূরে। এবং আমরা স্পষ্ট দেখলাম এক অর্ধভুক্ত জন্তর লাল ছালছাড়ানো দেহের উপর নিচু হয়ে বসে একটি মানুষ, একটি কালো রোগা লোমশ মানুষ, মাংস খাচ্ছেন একমনে। তিনি আমাদের লক্ষ্য করেন নি প্রথমে কিন্তু দু'একটি কাক শকুন উড়ে যেতেই তিনি আমাদের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন এবং লক্ষ্য করছিলাম তাঁর দু'টি কাতর, শান্ত, শাদা চোখ। জয়ন্তী পাহাড়ে তারপর আমরা আর কখনো যাই নি।
দেখেছিলাম, রাঢ়দেশে, বর্ধমানে, চৈত্রশেষের ইশানেশ্বরের গাজন। ঐ খানেই দেখেছিলাম মৃতদেহ এবং নরমুণ্ড নিয়ে লাফাচ্ছেন খেলা করছেন শত শত সন্ন্যাসী। তাঁরা গ্রামে আসেন মাঝরাতে এবং সারা সন্ধ্যা সবাই অপেক্ষা করে, মেলায় জ্বলে আলো, ঘোরে ঘুর্ণী, আমরা কিনে খাই পাঁপড় এবং কাপড়ে জড়িয়ে নিই মাটির পুতুল কিন্তু সন্ন্যাসীরা আসেন রাত দুটোয়, বহু দূর থেকে তাঁদের মশালের আলো দেখা যায়, দেখা যায় ধুলো উড়ছে বাতাসে, জ্বলছে কপূর। সন্ন্যাসীরা একমাস ধরে শ্মশানে পাহারা দেন মৃতদেহগুলি, মণ্ডলদের পয়সা দিয়ে তাঁরা কিনে নেন শ্মশানগুলি এবং ঐ সময় প্রত্যেক বছরই বেশ কিছু লোক মারা যায় ঐ অঞ্চলে মড়কে বা খাদ্যাভাবে বা দারিদ্র্যে। তাঁরা সদ্যোমৃতের মাথা কেটে নেন এবং মাটির তলায় পুঁতে রাখেন কিছুদিন। তাঁরা হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসেন কাটা মাথা, ছিঁড়ে-ফেলা হাত, রক্তমাখা ধড়-তেলে ডোবানো, সিঁদুরে মাখানো।
তাদের চোখ জ্বল্ জ্বল্ করে ঘন তমসায় এবং আমি এক অভাবিত সৌন্দর্যের জন্ম হতে দেখি ঐ রলরোলে কেননা একটি মহিলা চিনে ফ্যালেন তাঁর ভাই-এর ছিন্ন লাস এবং আর্তনাদ ক'রে ওঠেন, ধপ ক'রে বসে পড়েন মাটিতে এবং ঐ সন্ন্যাসী তাঁরই চোখের সামনে দোলাতে থাকেন প্রিয়জনের কাটা মাথা। তীব্র পচনশীল মাংসের, তেলের ও সিঁদুরের গন্ধের ভিতর থেকে দেখি স্বর্গের স্বপ্ন, আমি পারিজাত ফুল চিনতে পারি, শুনি কিন্নরদের পদধ্বনি। আমি ঘন তমসার ভিতর দিয়ে দেখি সেই অত্যাশ্চর্য মহাশ্মশান সেখানে চিতার আগুন কখনো নেভে না, আমার গায়ে এসে লাগে রাত্রির উৎসবের বাতাস, আমি শুনি শ্মশানযাত্রীদের তীব্র চিৎকার, হরিবোল ধ্বনি, শুনি শিবের গান, শুনি বাঁশের লাঠি দিয়ে ফাটিয়ে ফেলা হচ্ছে মৃতদেহের মুণ্ড, চর্বি ছিটকে পড়ছে চতুর্দিকের আগুনে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘাস, আমি রাত্রির বাতাসে গন্ধ পাই এক নির্জন বন্য ফুলের আর চর্বির যেখানে জ্বলে জোনাকি আর তারায় ভরা আকাশ আর জ্বলে চমৎকার ইশারাময় শান্ত শাদা দু'টি চোখ।
বর্ধমানে এবং কান্দী মহকুমায় ঐ শ্মশানসন্ন্যাসীদের বলা হয় 'কালিকার পাতা'। এবং রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী একদা লেখেন: কালিকার পাতা-রা আর মড়া, মনুষ্যের শবদেহ, অনেক সময় গলিত শব আনিয়া মন্দিরের উঠানে উপস্থিত হয় ও ঢাকের বাদ্য ও ধূপের ধোঁয়াসহ বিকট পৈশাচিক নৃত্যের অভিনয় করে। পূর্বে শব সংগ্রহ করিয়া রাখিতে হয়, গলিত দুর্গন্ধ শব হইলেই বিশেষ বাহাদুরি, অভাবে গোটাকতক শুকনা মাথা। (গ্রামদেবতা: সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা: ১ম সংখ্যা ১৩১৪ সন।)
ধলভূমগড়ে আমরা যাই ফাল্গুনের সুরুতে এবং সেইখানে টিলার ধারে আমাদের জমিজরীপের তাঁবু পড়ে ছ'টা, এবং আমাদের সঙ্গে ছিল একটি জিপ, দু'জন আর্দালি এবং রান্নার বাসনপত্র এবং একটি ছোটো পেট্রলে-চলা মেশিন যা তাঁবুতে তাঁবুতে ইলেকট্রিক আলো জ্বালায়। পর পর দু'বছর এই অঞ্চলে দারুণ অনাবৃষ্টি হ'ল। আমরা পথের চতুর্দিকে দেখেছি গৃহপালিত জীবজন্তুর লাস, আকাশে সর্বদা উড়ছে গৃধ, দিনের বেলায় পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে শৃগাল। আমরা, সংক্ষেপে, জায়গাটির নাম দিই 'পদচিহ্ন' গ্রাম। আমাদের তাঁবু পড়ে কুলজঙ্গলের পাশে, লোকালয় থেকে কিছু দূরে এবং সেই রাত্রে আমরা যথারীতি খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার তাঁবুতে ঢুকে পড়ি। পরদিন আমাদের একটি বড়ো-গোছের কাজের আয়োজন ছিল। আমার তাঁবুতে আমি থাকি একা এবং বিদ্যুতবাতি নিবে যাবার পর আমি একটা ছোটো মোমবাতি জ্বালিয়ে সামান্য লেখাপড়া করি এবং কিছুক্ষণ বাদে ঐ মোমবাতি নিবে যাবার পর আমি দ্বিতীয়বার সেটিকে জ্বালাই না। সোজা ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম ভেঙে যায় শেষরাতে। আমি শুনি চারপাশে অক্ষুষ্ট কথাবার্তা এবং মানুষের চলাফেরার শব্দ, আমি শুনি মহিলাদের নিচু গলায় কান্নার আওয়াজ। বিদ্যুতস্পৃষ্টের মতো আমি বুঝতে পারি এটি গ্রামের কবরখানা। তাঁবুর জানালা দিয়ে আমি রাত্রির বাতাসে অন্য তাঁবুগুলির ছায়া
দেখতে পাই এবং দেখি অদূরে নিচে ঘুরছে কয়েকটি হ্যারিকেন, কয়েকজন মানুষ এবং একটি মৃত শিশুকে কবর দেওয়ার আয়োজন চলছে। আধ ঘণ্টা ধ'রে আমি তাদের লক্ষ্য করি এবং শেষকালে তারা সকলে দল বেঁধে চলে যায় উঁচু টিলা পার হয়ে। কিছুসময় শিশুটি শুয়ে থাকে কয়েকহাত মাটির নিচে। তারপর সুরু হয় নিশাচর জীবজন্তুদের উৎসব, বহু দূর দূর থেকে তারা দৌড়ে আসে, পরস্পরকে আহ্বান জানায় এবং মুহূর্তের মধ্যে খুঁড়ে তোলে যা ছিল কিছুটা মাটির তলায়। এবং সুরু হয় আহার। প্রথমে খানিক কলহ চলে কিন্তু তারপর সব স্তব্ধ ইয়ে আসে এবং অন্ধকারে কেবলই শোনা যায় হাড় ও দাঁতের শব্দ, জিহ্বার শব্দ, রক্ত ঝরে পড়ার শব্দ। তারা খুঁড়ে তোলে আরো অনেক বিকলাঙ্গ লাস, নারী ও পুরুষদের টেনে নিয়ে আসে মাঠের উপরে এবং ভোরের আলো ফোটার আগেই তারা সারা মাঠ জুড়ে ভুক্তাবশেষ ফেলে রেখে চলে যায়। আমি ভোরের আকাশের নিচে একা এই শোকাকুল রণক্ষেত্র পরিদর্শন করি এবং তারপর জিপগাড়িটাকে নিয়ে যাই জলার ধারে, অত্যন্ত যত্ন সহকারে আমি ধুয়ে ফেলি তার গা, গায়ে যত রক্তের দাগ লেগেছিল।
মিশরে আবিস্কৃত হয়েছে মৃতদের লোকালয় মাটির নিচে। সেইখানে পাওয়া গেছে সহস্র সহস্র মমি- মানুষের, কুকুরের, বাঘের, বেড়ালের, পাখির, কীটপতঙ্গের, উদ্ভিদের এবং পাওয়া গেছে ছবি লেখা পাতা, হাতে-আঁকা মন্ত্র। একটি লেখা: ৭০ দিন ধ'রে তোমার শরীর বিভিন্ন প্রলেপে মাখানো হবে। ৭০ দিন পরে তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে এক মহাদ্যুতি কবরে। তোমাকে স্থাপন করা হবে মৃতের আসবাবে... তোমাকে টেনে নিয়ে যাবে শ্বেত বৃষ... তোমার পথে পথে ছড়ানো হবে দুধ। তারপর পুরোহিত খুলে দেবেন তোমার চোখ, তোমার শ্রবণ। তোমার শরীর এখন যথার্থ হল। আমরা তোমার জন্য পুণ্য-গ্রন্থ পাঠ করব। আমরা তোমার সৎকারে বহু উপহার আনব। তোমার হৃদয় থাকবে তোমার মৃতদেহেরই ভিতরে, ঠিক যেমন ছিল জীবিত অবস্থায়। তুমি তোমার সূক্ষ্ম শরীরে প্রবেশ করবে তখন, একদা যেমন তুমি প্রবেশ করেছিলে তোমার জন্মমুহূর্তে। তুমি যাবে পশ্চিমের পাহাড়ে। তোমাকে ঘিরে সুরু হবে নাচ।
এ বিষয়ে দীর্ঘ বর্ণনা লিখে গেছেন হেরোডোটাস খৃষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে। তিনি দেখে গেছেন সৎকার নিয়ে কলহ করছে পুরোহিত এবং দরিদ্র গ্রামবাসীরা। তিনি দেখেছেন সৎকার-আলয়ে দীর্ঘ দিন মৃতদেহগুলি ঝুলিয়ে রাখা হয়-যেমন মাংসের দোকানে ঝোলে মাংস। সেইখানে তরুণেরা শিক্ষানবিশী করে। তারা মৃতদেহ সংরক্ষণের পদ্ধতি শেখে, শেখে মন্ত্র-উচ্চারণ, তিনি দেখেছেন মৃতদেহ ব্যবহারের জন্য মন্দির, বাগান ও খেলার মাঠ তৈরি হতে। তিনি ঐ বিস্ময়কর লোকালয়ের নাম দিয়েছিলেন 'নেক্রোপলিস', যা শহর ও সভ্যতা।
'হে মাংস.... তুমি নষ্ট হয়ো না, তুমি গলে যেও না, তুমি দুর্গন্ধ ছড়িও না' মিশরীয়রা এইভাবে প্রার্থনা করত মৃতদের জন্য-কেননা মৃত্যুর পর মানুষ উপস্থিত হয় সেই বিচারালয়ে যেখানে সম্রাট ওসাইরিস, মৃতদের দেবতা, তুলাদণ্ডে মৃতের হৃদয় চাপাবেন একদিকে এবং অপরদিকে এক পাখির লঘু পালক। এই ঘটনা দেখবেন দ্বিচত্বারিংশ দেবদেবী, মৃতের গলায় ঝুলবে বিভিন্ন কবচ, সাপ তাড়ানোর জন্য, কুমীরকে দূরে রাখার জন্য, কেননা পরলোকেও ঐ সব জন্তুর উপদ্রব আছে। যদি দেবতারা সন্তুষ্ট হন তবে তাঁরা মৃতকে আকাশ পথে বহন করে নিয়ে যাবেন নীলনদের অপর পাড়ে। সেখানে যে যথারীতি চাষ করবে, শস্য উৎপাদন করবে, মদ্যপান করবে এবং প্রেম করবে ঠিক যেমন সে করত জীবিত অবস্থায়।
'মৃত্যুর ডানা তাকেই স্পর্শ করুক যে নিদ্রাভঙ্গ করবে এই প্রবলপ্রতাপ ফারাওয়ের যিনি এখানে শুয়ে আছেন অনন্তকালের জন্য' ঐ উক্তি লেখা ছিল সম্রাট টুটানখামেনের সমাধিমন্দিরের ফটকের উপর। পঁয়ত্রিশ শতাব্দী ধরে সে নিস্তব্ধতা কেউ ভাঙে নি। বারোই ফেব্রুয়ারি উনিশশো চব্বিশ সালে মানুষ খুলে ফ্যালে ঐ সমাধিগৃহের দরজা- টর্চের আলোয় ঝলমল করে ওঠে সোনায় কফিন, তার দু'পাশে সোনায় তৈরি উলঙ্গ মেয়েরা যাদের ডানাও সোনা দিয়ে তৈরি। সেখানে দেখা গেল কফিনের উপর হাঁটু পেতে বসে আছেন দেবতা-শৃগাল আনুবিস। ঐ উপরের অভিশাপ লাগে সকল মানুষেরই গায়ে যাঁরা প্রথম প্রবেশ করেন সমাধিগৃহে। লর্ড কানারভন মারা যাওয়ার আগে ভয়াবহ প্রলাপ বকতে সুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যেই মারা যান কর্নেল অব্রে হারবার্ট। যে মহিলা-নার্স কানারভনের কঠিন অসুখের সময়ের দেখাশোনা করেছিলেন, তিনিও অবিলম্বে মারা যান। একে একে ঐ অভিযানের প্রত্যেকে মারা যান। ডক্টর এভেলিন হোয়াইট, যিনি প্রথম সমাধিগৃহে প্রবেশ করেন, তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয় দড়ি থেকে ঝুলন্ত।
লোকে বলে মিশরীয়রা বিষাক্ত পাথরের ব্যবহার জানতো তারা কবিদের মতো বিষ মেশানোর পদ্ধতি শিখেছিল অর্থাৎ কবিরা যেমন মেশাতে শেখে শব্দ। তারা তেজস্ক্রিয় জিনিষপত্র রেখে গিয়েছিল সমাধিগৃহে (অটো নিউবার্ট) এবং সতর্ক করে দিয়েছিল ভবিষ্যত মানুষদের। তারা লিখেছিল "ইহা-ই দেবী আইসিসের অলৌকিক রহস্য।"
আরেকটি সমাধির উপর এইরূপ লেখা ছিল:
তোমার দেহ চিরকাল দাঁড়িয়ে থাক এই সমাধিগৃহে।
তোমার দেহ আরো সবল হোক, তুমি মৃতদের শহরে বাস করো। পশ্চিম দেশ তোমার সৌন্দর্যে অভিভূত হোক- তুমি পশ্চিমের পাহাড়ে ভ্রমণ করো যখনই তোমার খুশি এবং তুমি যখন ইচ্ছে দ্যাখো মৃত্যু- পরপারের মহাভূমি।
তুমি দেবতা রা-কে উপাসনা করো, যিনি সূর্য, যিনি পাহাড়ের উপর উদিত হন।
যখন তিনি দিগন্তে অস্ত যান, তুমি তাঁকে আনন্দিত রাখো।
তুমি এই আশ্চর্য বাগানের চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াও- তুমি ঐ রহস্যময় অনন্তজলের ধারে ভ্রমণ করো।
নরখাদক
উৎপলকুমার বসু
উৎপলকুমার বসু
মন্তব্য