আমরা এক ভাঙা দেশের সন্তান। ইতিহাস থেকে আমরা জানি, এই ভাঙন কেবল মানচিত্রের নয়, আত্মারও। ঋত্বিক ঘটক সেই ভাঙা আত্মার শিল্পী। আজ তাঁর জন্মের একশ বছর পূর্ণ হলো—এমন এক সময়, যখন সিনেমা বাজারের পণ্যে পরিণত, যখন কণ্ঠগুলো চাপা পড়ে গেছে বিজ্ঞাপনের আওয়াজে। এই সময়েই ফিরে তাকাতে হয় সেই মানুষটির দিকে, যিনি সিনেমাকে দেখেছিলেন দেশভাগের আর্তি হিসেবে, সংস্কৃতির ক্ষয়রোগের এক দলিল হিসেবে।
ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’—এই চলচ্চিত্রগুলো আজও হৃদয়-মনন কাঁপিয়ে তোলে কারণ এগুলোর প্রতিটি ফ্রেমে আমরা এক ক্ষয়ে যাওয়া সভ্যতার চিহ্ন দেখি। তাঁর সিনেমার ভাষা ছিল আঘাতের ভাষা, তীব্রতার ভাষা; যেন দগদগে ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে, কিন্তু সেই রক্তই আলো হয়ে জ্বলে উঠছে পর্দায়। তিনি জানতেন, সুন্দরতা কোনো মেকি রোম্যান্টিকতা নয়—বরং এক রক্তাক্ত সত্য। প্রতিটি ছবিতে তিনি নিজের ভিতরকার ক্ষতকে পর্দায় ছড়িয়ে দিয়েছেন, যেন দর্শক নিজেকে দেখতে পায় কাঁদতে থাকা এক মহাদেশের আয়নায়। তাঁর ক্যামেরা খুঁজে ফিরেছে মানুষ—যে মানুষ নিজের দেশ হারিয়েছে, ইতিহাস হারিয়েছে, অথচ এখনও কাঁধে নিয়ে হাঁটে অনন্ত আশার বোঝা। তিনি বলেছেন, “আমার ফিল্ম কোনো গল্প বলে না, আমার ফিল্ম চিৎকার করে।” সেই চিৎকারই আজও প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিটি পরাজিত মানুষের অন্তরে, যাদের কোনো দ্যাশ নাই, যাদের কোনো ভাষা নাই।
আজকের তরুণ প্রজন্ম যখন নতুন মিডিয়ার ঝলকানিতে নিজেদের প্রকাশের ভাষা খোঁজে, তখন ঋত্বিকে ফিরে দেখি, শিল্প মানে নিখুঁত ফ্রেম নয়—অসীম অসম্পূর্ণতার মধ্যেও সত্যের অন্বেষা। তাঁর সিনেমা এক অন্তহীন বেদনার ক্যালিগ্রাফ, যা দেশভাগের স্মৃতি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। তিনি নিজেই বলেছিলেন, “আমি দেশভাগের সন্তান, সেই ক্ষতই আমার শিল্প।”
‘বিন্দু’ বিশ্বাস করে, ঋত্বিক ঘটক কেবল চলচ্চিত্রের পরিসরে সীমাবদ্ধ কোনো নাম নন; তিনি এক চিন্তার ধারক। তিনি এমন এক শিল্পী, যাঁর কাছে রাজনীতি ছিল নান্দনিকতার অংশ, আর নান্দনিকতা ছিল প্রতিবাদের ভাষা। তাঁর আত্মবিনাশী জীবনও এই বক্তব্যেরই এক রূপক—যে সমাজে সত্য উচ্চারণ বিপজ্জনক, সেখানে সত্যের কবিরা একে একে পুড়ে যায়, অথচ তাদের ছাই থেকেই জন্ম নেয় ভবিষ্যতের আলোকরেখা। ঋত্বিকের শিল্প রাষ্ট্রের প্রচারপত্র নয়; তার শিল্প পরাজিতদের সংগ্রামের নথি, নির্বাসিতদের স্বপ্নের দলিল।
ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষ আমাদের কাছে কেবল স্মরণ নয়, পুনর্জাগরণের আহ্বান—যেখানে আমরা আবার ভাববো, শিল্প কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে, কীভাবে দেশভাগের স্মৃতি থেকে জন্ম নিতে পারে এক নতুন একতা, এক নতুন দেশ।
এই সংখ্যায় আমরা ফিরে পড়বো ঋত্বিকের চলচ্চিত্র, তাঁর আত্মজিজ্ঞাসা, তাঁর লিপিবদ্ধ উন্মাদনা। কারণ আমাদের লক্ষ্য ঋত্বিক ঘটকের ভেতর দিয়ে এক ছিন্নভিন্ন জাতির অন্তর্গত আত্মচিৎকারকে শোনা।
— সম্পাদক, বিন্দু
বিন্দুস্বর
ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষ
ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষ




মন্তব্য