১৯৭৬ এর ৬ ফেব্রুয়ারি, কলকাতাবাসীরা স্তম্ভিত হয়ে জানতে পারলেন, ঋত্বিক ঘটক আর নেই। খারাপ খবর তাড়াতাড়ি পৌঁছে যায়, এই মৃত্যুর খবরও দাবানলের মত মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার মানুষদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করল। দুপুরের মধ্যে দেখা গেল প্রেসিডেন্সি গভর্নমেন্ট হসপিটালের গেটে জড়ো হয়েছেন শয়ে শয়ে নানান গোষ্ঠীর ও বৃত্তির মানুষ— শিল্পী-সাহিত্যানুরাগী, কেরানী-চাকুরীজীবী, চলচ্চিত্র যন্ত্রশিল্পী-পরিচালক, মঞ্চ ও পর্দার অভিনেতা-অভিনেত্রী, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ! বিকেল গড়িয়ে গেলে, শেষকৃত্যের যাত্রা শুরু হল। একজন অনন্য মানুষের অনন্য শেষকৃত্য। হাজারে হাজারে লোক হয়েছিল, সকলে মিলে কেওড়াতলা শ্মশান পর্যন্ত হাঁটলেন। হাঁটার সময়ে তাঁদের কণ্ঠে বেজেছিল ওঁর সবথেকে প্রিয় কয়েকটি গান।
কলকাতা ও ঋত্বিকের মধ্যে ছিল এক অচ্ছেদ্য বন্ধন। তবে সত্তরের শুরুর দিকে উভয়েই এমন বদলেছিল যে আর চেনা যাচ্ছিল না। যে কলকাতা ’৬৬-র খাদ্য আন্দোলন দেখেছে, ’৬৭-র যুক্তফ্রন্ট সরকার দেখেছে, সিপিআই(এম) - নকশাল সংঘাত দেখেছে, ’৭২ এর ভুয়ো নির্বাচন দেখেছে, সেই কলকাতা সত্তরের মাঝামাঝি এসে ধুঁকছিল যেন। শহরের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঋত্বিকের নাড়ির স্পন্দনও ক্রমশই ঊর্ধ্বগামী। ১৯৭২ এর সেই ভয়াবহ কারচুপির পর বাইরের দুনিয়া মনে করেছিল কলকাতাতেও বুঝি জঙ্গলের রাজত্ব চলছে। তবুও, যখন শহরের সন্তান বরাবরের মত এই শহর ছেড়ে যেতে বসেছে, তখন কিন্তু কলকাতার মানুষ সেই আতঙ্কের ছায়া থেকে বেরিয়ে তার সেই সন্তানকে এক মর্মস্পর্শী বিদায় জানাতে সমবেত হয়েছিল।
১৯৮২ সালে ঋত্বিকের প্রথম ছবি “নাগরিক”-এর তিরিশ বছর হবে। অনেকেই মনে করেন, এই ছবি থেকেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের উত্তরণের এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। যদিও অনেকেই হয়তো এ কথাও মেনে নেবেন, তাঁর বানানো যেকোনও ছবি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সোনা-রুপোর ময়ূর বিজেতাদের কাজকে ম্লান করে দিতে পারলেও, তাঁর ছবিগুলো জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে বা আন্তর্জাতিক স্তরে যথাযথ প্রচারের উদ্দেশ্যে বিশেষ কিছুই করা হয় নি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের তরফে এই ধরনের কলঙ্কময় বিমাতৃসুলভ আচরণ অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত, এবং তা কেবল ঋত্বিকের চলচ্চিত্রের ঐশ্বর্য্য বিশ্বের সামনে প্রকাশ করার জন্য নয়, সবার কাছে ভারতীয় চলচ্চিত্রের মর্যাদা ও শিল্পসুষমা গর্বভরে প্রমাণ করার লক্ষ্যে।
১৯৫৫ সালে বিশ্বের চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সমালোচকেরা হঠাৎ করে নড়েচড়ে উঠে দেখলেন সত্যজিৎ রায় নামের নতুন এক প্রতিভাকে, যাঁর প্রথম কাজ, ‘পথের পাঁচালি’ পূবের নতুন বাতাসের মতো সর্বত্র প্রশংসিত হল। অচিরেই তিনি একাধারে চলচ্চিত্রের এক নতুন নন্দনতত্ত্বের স্রষ্টা, পথপ্রদর্শক, ও সর্বজনগ্রাহ্য বিশারদ হিসেবে গণ্য হলেন। তারপর প্রায় পঁচিশ বছর কেটেছে, এখন সত্যজিৎ রায়ের জগতজোড়া খ্যাতি, একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার বলে তিনি পরিচিত। তাঁর কাজ দেশে-বিদেশে অসংখ্য কমবয়েসি চলচ্চিত্রকারদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, অনেকে মনে করেন তিনি আধুনিক ভারতীয় চলচ্চিত্রের অভিমুখ নির্দেশকারী একজন।
এসবের আড়ালে, বাণিজ্যিক ও অভিজাত গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত যে সুচারু প্রক্রিয়ায় যেকোনও বৈপ্লবিক তাৎপর্যপূর্ণ প্রচেষ্টাকে যেনতেন প্রকারে প্রতিহত ও দমন করা হয়, সেই উপায়েই বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছিল একটি ঘটনা। ‘পথের পাঁচালি’ দিনের আলো দেখার অন্ততঃ তিন বছর আগেই চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক সম্পদতুল্য ছবি শেষ করে ফেলেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে চমকে দেওয়া প্রতিভা। তাঁর নাম ঋত্বিক ঘটক, ছবির নাম ‘নাগরিক’। তৈরির পর পঁচিশ বছর ধরে ছবিটি কোনও স্যাঁতসেঁতে গুদামে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে রইল, চিরকালীন বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবে থাকার ভবিতব্য নিয়ে। সৌভাগ্যক্রমে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের সুবাদে, হালে এই ১৯৭৭ সালে, স্রষ্টার মৃত্যুর এক বছর বাদে সেই ছবি পুনরুদ্ধার করে একটি প্রিন্ট নেওয়া সম্ভব হল। তারও পরে, ভারতের নানান শহরে ছবিটির প্রদর্শনী চলাকালীন লোকজন বুঝতে পারল ঋত্বিকের পরবর্তী কর্মজীবনের প্রতি কী পরিমাণ অবিচার করা হয়েছে। আর ১৯৫২ সালে এই ছবিটির মুক্তি আটকে দিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রের অগ্রগতির পথে কী অলঙ্ঘ্য বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঋত্বিক ঘটকের জীবন বরাবরই টালমাটাল, বিপর্যস্ত। তাঁর জীবনব্যাপী তিনি আরও সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও অনেকগুলি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি শেষ করেছিলেন। সারাজীবনে কখনওই তিনি ক্ষমতাসীন শাসকের জ্বালাতন থেকে অব্যাহতি পাননি। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি – ‘সুবর্ণরেখা’ মুক্তি পাবার আগে তিন বছর ঠাণ্ডাঘরে পড়েছিল। ১৯৭০ সালে বানানো ‘আমার লেনিন’ নামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ১৯৭১ সালে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেলেও, জনসাধারণের জন্য এখনও মুক্তি পায়নি। এমনকি তাঁর শেষ ছবি ‘যুক্তি, তক্ক, গপ্পো’ (১৯৭৪), সেন্সর বোর্ডে বিস্তর সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল।
প্রত্যক্ষভাবে তাঁর কাজকে চেপে দেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এই প্রবণতা অনেকদিনের। সে সুদীর্ঘ যন্ত্রণার কাহিনি এখানে বলতে চাইনা। এর থেকেও উদ্বেগজনক ও ভয়ংকর প্রবণতা দেখা যায় আর এক গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়ায়। চলচ্চিত্র নিয়ে যাঁরা পত্রপত্রিকায় লিখে থাকেন, যাঁদের গালভরা পরিচয় হল চিত্র সমালোচক, তাঁরা ঋত্বিককে একাধারে একজন চরম স্ট্রাকচারালিস্ট ও অন্যদিকে এক রহস্যময় ও স্ববিরোধী ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখান। এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি সুচতুর ভাবে সাজানো হয় ঋত্বিকের কাজ ও তার গুরুত্বকে বিকৃত করার উদ্দেশ্যে। ঋত্বিকের কাজের আলোচনায় এহেন ‘সমালোচকের’ যাবতীয় চেষ্টা এসে পুঞ্জীভূত হয় কেবলমাত্র চলচ্চিত্রের ব্যাকরণে তাঁর অবদানের কথা দায়সারা ভাবে বলে নিয়ে, পরক্ষণেই ‘এই অসামান্য শিল্পীর প্রতিভার ঝলকানি’ থেকে তাঁর অপেক্ষাকৃত উপেক্ষাযোগ্য সাংগঠনিক কাজের পরিত্যক্ত পাঁককে বিচ্ছিন্ন করে দেখানোতে।
সমালোচনার আর একটি ধারা রয়েছে, যেটিও সমান ক্ষতিকর, সেখানে একটি অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী অবস্থান থেকে সমালোচক প্রমাণ করতে চান, বৌদ্ধিক ঋত্বিকের দায় তাঁকে যে সাংগঠনিক চিন্তাধারা অবলম্বন করতে ‘বাধ্য’ করেছিল, চলচ্চিত্রকার ঋত্বিকের সংবেদনশীলতা তাঁর ছবির বিষয়কে সেই ভাবনার নিগড় থেকে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে।
অন্য এক পরিসরেও এই দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি দেখা গিয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরেই ঋত্বিককে কমিউনিস্ট পার্টিতে একজন বিদ্রোহী হিসেবে দাঁড় করানোর এক প্রবণতা চলেছিল, যে বিদ্রোহী চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নানান আদর্শবাদী ও তাত্ত্বিকদের বজ্রকঠিন অনুশাসনের বিরুদ্ধে লড়েছে। ঋত্বিকের এই মাতাল ও আপাত-নৈরাজ্যবাদী আচরণকে দেখা হয়েছিল আইপিটিএ-র নেতাদের দ্বারা সৃজনশীল শিল্পীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া কঠোর শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদের একটি ধরন হিসেবে। এর পাশাপাশি শিল্পীদের ব্যক্তিত্বের উপর এসে পড়া অস্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণের দ্বারা আবদ্ধ হতে তাঁর অস্বীকৃতি হিসাবেও তাঁর ব্যক্তিগত আচরণকে ধরে নেওয়া হয়েছিল।
এই সমালোচকরা হয় বুঝতে ব্যর্থ হন অথবা স্বীকার করতে চান না, এই মানুষটি তাঁর জীবনভর এই চলচ্চিত্র বাজার নিয়ন্ত্রণকারী এবং নতুন সিনেমার প্রচার ও পৃষ্ঠপোষক সরকারি সংস্থাগুলির কর্তাব্যক্তিদের কোপে পড়েছেন। ওঁদের অনিশ্চয়তা এবং তার থেকে উদ্ভূত অসীম বঞ্চনার ফলে জীবনভর তাড়া খেতে হয়েছে তাঁকে। এই লাগাতার মানসিক নির্যাতনই তাঁর মতো এক অত্যন্ত সংবেদনশীল ব্যক্তি, কবি, পণ্ডিত ও শিল্পীকে এই বাণিজ্যিক দানব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শিল্পজগৎ থেকে এক ধরণের স্ব-আরোপিত নির্বাসনে নিয়ে যায়। এমন নির্বাসন যা তাঁকে বেশ কয়েকবার মানসিক ও শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল। আরও যা এই সমালোচকরা বুঝতে বা স্বীকার করতেও ব্যর্থ হন তা হল, এই ধরণের অসহনীয় নির্যাতন সত্ত্বেও ঋত্বিক বারবার এমন চলচ্চিত্র তৈরি করতে এগিয়ে এসেছেন, যা পরবর্তী কালের জন্যও পাথেয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা যখন সত্তর ও আশির দশকের ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়ছি, তাঁর ছবি উদ্বুদ্ধ করছে আমাদেরও, আমাদের প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন তিনি। কাজেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কঠিন “নিগড়ের” বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া তো দূরের কথা, ঋত্বিক বরং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অনেক প্রাক্তন খ্যাতিমান ব্যক্তিকেও অনুসরণ করেননি। তিনি সর্বদাই এমন কোনও মাধ্যম বা বার্তার প্রতি অবিচল থেকেছেন যেগুলি মানুষের সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ এবং শিল্পের পরিসরে মানুষের সংগ্রামকে বহন করতে সক্ষম। তিনি কখনও তাঁর শিল্পকে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অনুগ্রহপ্রার্থী করে তুলতে চাননি, নিজেও কোনও রকম চাকচিক্য অথবা ধন-সম্পদের আকর্ষণের শিকার হননি কোনও দিন। নিজের ছবির জন্য কখনও সস্তা জনপ্রিয়তাকে অবলম্বন করেননি। আমাদের আজকের অনেক তথাকথিত "বিপ্লবী" চলচ্চিত্রকাররা জনপ্রিয় হবার জন্য যেসব চোরাপথ ব্যবহার করে থাকেন, তিনি সেসব সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন ।
১৯৫২ সালে তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র "নাগরিকে"র শুটিং করার সময়, ঋত্বিকের সুযোগ-সুবিধা ছিল খুবই সীমিত, সম্বল বলতে নামমাত্র টাকাকড়ি এবং চলচ্চিত্রমাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে অব্যবহৃত একঝাঁক কলাকুশলী। তাঁর উত্তরাধিকার এমন একটি শিল্পমাধ্যম যা ভারতে তখনও তেমনভাবে ডালপালা মেলে গড়ে ওঠেনি। তবুও, বলা যায় তাঁর বিষয়বস্তুর জটিল প্রকৃতি যথাযথভাবে তুলে ধরার তাগিদেই ঋত্বিক তাঁর শিল্পপ্রণালীতে আত্মস্থ করেছিলেন সারা বিশ্বে এই মাধ্যমের সঞ্চিত ও প্রযুক্ত জ্ঞানকে। তার ফলশ্রুতিতে, এমন একটি ছবি তৈরি হয়েছিল, যা শুধু কাহিনির সাপেক্ষেই নয়, বরং মাধ্যমের প্রযুক্তিগত এবং ব্যাকরণগত কাঠামোর সাপেক্ষেও একইরকম এগিয়ে ছিল। তাঁর প্রতিভার এক অন্যতম অনুষঙ্গ হল তাঁর ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। এহেন ঋত্বিক তাঁর চলচ্চিত্রকে এক দ্বান্দ্বিক কাঠামোতে গড়ে নেওয়ার লক্ষ্যে কাজে লাগিয়েছিলেন শব্দকে। চিত্রমাধ্যমে শব্দের ব্যবহারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর হাতে প্রথমবারের জন্য, ভারতীয় চলচ্চিত্রে শব্দ কেবল সংলাপ এবং ঘটনার ‘প্রভাব’ কে বাড়িয়ে তোলার সুর হয়ে থাকে না; বরং সম্পূর্ণ বিন্যাসের একটি সচেতন অংশ হয়ে ওঠে। তার উপযোগিতা হয় গভীরতর। তাঁর ছবিতে শব্দ তাৎক্ষণিক সংলাপধর্মী এবং আখ্যানধর্মী প্রেক্ষাপটকে প্রশ্ন করে, বিশ্লেষণের চেষ্টা করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঘটনাকে একটি বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণ প্রদান করতেও সক্ষম হয়।
ঘটকের আরেক অভিনবত্ব হল ‘ডিপ ফোকাস’ ব্যবহার করে চরিত্রগুলিকে তাদের সামাজিক পরিবেশে সুদৃঢ়ভাবে স্থাপন করার কৌশল রপ্ত করা। এই পদ্ধতিটি তিনি ‘নাগরিকে’ প্রথমবার ব্যবহার করেছিলেন এবং এটি পরবর্তীতে তাঁর শৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। ছবিতে কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্রকে প্রথমবারের মতো দেখতে পাই আমরা শহর কলকাতার এক বিস্তৃত প্যানোরামিক দৃশ্যের পর। ক্যামেরা প্যান করে দেখাতে থাকে সার দেওয়া ঝুপড়ি ও দোকান, আকাশছোঁয়া বাড়ি ও বস্তি, শহর জুড়ে বৈদ্যুতিক তারের কাটাকুটি, এবং দৈনন্দিন কাজে বেরনো সাধারণ মানুষের ভিড়ে ভরা রাস্তাঘাট। এরপর কমপক্ষে বিশ ফুট উচ্চতা থেকে তোলা একটি লং শটে তিনি ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সে ভিড়েরই একজন, তাকে এক বৃদ্ধ মহিলাকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করতে দেখি আমরা। পর্দার এই সাধারণ নাগরিক-নায়ক হেঁটে চলে সংকীর্ণ নোংরা গলি দিয়ে, ভিখারী ও পথশিল্পীদের পাশ দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করতে থাকে ক্যামেরা। এত কিছুর পরে যখন ক্যামেরা নায়কের মুখের উপর এসে স্থির হয়, ততক্ষণে দর্শকরা তাকে নিজেদেরই একজন হিসেবে গ্রহণ করে ফেলেছেন। তাঁদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, পর্দার নায়ক তাঁদেরই মতন, কোনওভাবেই সে অসাধারণ, বীরত্বপূর্ণ, ধনী, বা সুদর্শন কিছুই নয়, অথবা অলীক কল্পনার জগতে কোনও রোমহর্ষক অভিযানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সে আসেনি। ঋত্বিকের সমস্ত চরিত্র তথা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি আসলে এক জনপ্রিয় এবং অধঃপতিত চলচ্চিত্ররীতিকে সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করছেন। সেই রীতির বৈশিষ্ট্যই হল, ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তির জীবন, তিনি ভাগ্যবিপর্যয় অথবা কোনও অদ্ভুত দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতির শিকার হবেন এবং তারপর নিবিড় মনোযোগ সহকারে খুঁটিয়ে দেখা হবে সেই পরিস্থিতিকে। আবার এই খুঁটিয়ে দেখার অধিকারী একমাত্র তারাই, যারা যে কোনও উপায়ে সাধারণ মানুষের জীবন থেকে আরও উঁচুতে বা দূরে সরে এসেছেন।
একটি প্রবেশক প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে ঋত্বিক ঘটকের সমগ্র কর্মজীবনের আলোচনা সম্ভব হবে না। তাই আমরা খুব সংক্ষেপে আলোচনা করব, এই প্রতিভাবান মানুষটি তাঁর ছবির মাধ্যমে গণ-চলচ্চিত্রে ও চলচ্চিত্রের ভাষায় কী অপরিসীম অবদান রেখেছেন, তাই নিয়ে।
ঋত্বিক ঘটক যখন কাজ শুরু করেন, তখন ভারতীয় চলচ্চিত্র বিকাশের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। যদিও ততদিনে সামাজিক নানান ক্ষেত্রের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে কিছু জোরালো ছবি তৈরি হয়েছিল, তবুও চলচ্চিত্র বলতে মূলতঃ বোঝাত একটি বা দুটি ক্যামেরা স্থির রেখে একটি সোজাসাপটা গল্প রেকর্ড করা, অনেকটা যেন উজ্জ্বল আলোকিত মঞ্চে কোনও নাটক অভিনয়ের মত। একটি দৃশ্যের বিশ্লেষণে বা ব্যাখ্যায় ক্যামেরার অবস্থান, সম্পাদনার ধরণ, দৃশ্য সংমিশ্রণ, প্রতীকের ব্যবহার, দৃশ্য বিন্যাস ইত্যাদি নানান কৌশল কীভাবে অগণিত সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে, তৎকালীন চলচ্চিত্র নির্মাতারা এ বিষয়ে বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা ভাবেননি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, তখনও একটি স্বতন্ত্র সিনেমা ভাষাই গড়ে ওঠেনি। ঋত্বিকই প্রথমবার দেখিয়েছিলেন যে সিনেমার ক্যামেরা কেবল এক বাধাহীন আড়ি পাতার যন্ত্র নয় বরং সে হতে পারে একাধারে একজন ভাষ্যকার, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, সমালোচক এবং কবি। তার সার্থকতা একদল চরিত্রের জীবনের জানালা হয়ে নয় বরং মানুষের বেঁচে থাকার একজন সাক্ষী হয়ে। কীসের সাক্ষ্য? গল্প বলা, স্মৃতি, প্রত্যাখ্যান, গ্রহণ, প্রশ্ন, প্রতিবাদ, পরাজয় ও জয়ের। এইভাবে ঋত্বিক ভারতীয় সিনেমাকে দিলেন এক স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যমের ধারণা এবং শেখালেন এই নতুন ভাষাটির সচেতন ব্যবহার। ‘অযান্ত্রিক’ (১৯৫৮) থেকে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৫৯), ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০) হয়ে ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১), ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬২) পর্যন্ত ঋত্বিক তার গল্পের দাবি অনুসারে তাঁর শিল্পের প্রকাশভঙ্গি বারংবার নতুন কাঠামোয় গড়েপিটে নিয়েছেন। এভাবেই তাঁর নিজস্ব শিল্পরীতি পর্যাপ্ত পরিমাণে বিকশিত হয়েছিল। ‘সুবর্ণরেখা’-য় আমরা দেখতে পাই, চলচ্চিত্রটি একই সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে এগিয়ে চলেছে— সেখানে সংলাপ, সঙ্গীত এবং দৃশ্য কেবলমাত্র ‘গল্প’কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বাহন হয়ে থাকে না। এই প্রতিটি উপকরণের রয়েছে এক নিজস্ব জীবন, সবগুলির সংমিশ্রণ থেকে স্বতন্ত্র। প্রত্যেকটি উপকরণই নিজস্ব গতিতে, নিজের পথে এগিয়ে যায় যেমন, তেমনই চলচ্চিত্রের সামগ্রিকতায় তাদের প্রভাব পড়ে, এবং একইসঙ্গে সেই সামগ্রিকতা থেকেই আবার জন্ম নেয় উপকরণগুলি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সংলাপ এবং সঙ্গীত মাঝে মাঝে ভিন্ন এবং পরস্পরবিরোধী ধারা অনুসরণ করে এগোয়– দুটিই নিজেদের মধ্যে এক স্বতন্ত্র অর্থ বহন করে চলে, এবং উভয়ের সংঘর্ষের মাধ্যমে জন্ম নেয় তৃতীয় এক গভীরতর অর্থ। তিনি বিষয় হিসেবে বেছে নেন, বাস্তব জীবনের কিছু অতি সাধারণ পরিস্থিতিদের, যেগুলিতে এমনকি চরম আবেগঘন মেলোড্রামার উপাদানও রয়েছে, কিন্তু সেগুলিকে এমনভাবে ঐতিহাসিক ভিত্তি দিয়ে পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন, যে দর্শকদের প্রতিক্রিয়ায় সহানুভূতি অথবা বিদ্বেষ সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলির ফুটিয়ে তোলা রসে আর সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং আমাদের শ্রেণিজর্জর সমাজের বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত হিসেবে পাওয়া যন্ত্রণা, কষ্ট, নিষ্ঠুরতা ও অবিচারের প্রতিধ্বনি ও প্রতিক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর ছবির নায়করা সারা জীবন জুড়ে চরম আঘাত এবং যন্ত্রণাদায়ক বিবিধ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। সেসব দেখিয়ে কাহিনীর শেষের দিকে তিনি বলেন, জীবন থেমে থাকে না। ‘সুবর্ণরেখা’-তে ভবিষ্যতের ভাবনার সারমর্মটি কেন্দ্রীভূত রয়েছে একটি দৃশ্যে— একটি শিশু আমাদের নায়ককে, ট্র্যাজিক হিরোকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে দিগন্তের দিকে, দুঃখের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার এক বিমূর্ত প্রতিশ্রুতি ধারণ করে। ‘মানুষ বিজয়ী হবেই’ এই বার্তাটি একেবারে অমোঘভাবে, কিন্তু বড় কোমল ও কাব্যিক ভঙ্গিতে পৌঁছে যায় দর্শকমনে। তাঁর তুলনায় মধ্যমানের সমসাময়িকরা থিয়েটার ও সিনেমায় স্লোগানের ভঙ্গিতে এই একই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন— কিন্তু দুটির প্রকাশভঙ্গি ও আবেদনে কী আশ্চর্য ফারাক!
তাঁর আটটি ছবির মধ্যে অন্ততঃ পাঁচটিতে, জীবনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার জন্য সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘বাহন’ হয়ে ওঠে একটি শিশুর পুনরাগমন। অন্য তিনটিতে একই ভাবনা অন্যান্য প্রতীকের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে—‘কোমল গান্ধারে’ বিবাহের মাধ্যমে, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-তে পলাতক শিশুটির বাড়ি ফিরে আসার মাধ্যমে, ‘নাগরিকে’ দরিদ্র হয়ে যাওয়া পরিবারটি তাদের মধ্যবিত্ত পাড়া ও মূল্যবোধ ছেড়ে শ্রমিকদের এলাকায় বসবাস করতে চলে যাওয়ার মাধ্যমে।
ঋত্বিক ঘটক যে শিল্পমাধ্যমে কাজ করেছিলেন, সেটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রসার ঘটায়, বিশেষ করে এমন এক পরিসরে, যেখানে প্রগতিশীল চলচ্চিত্র আন্দোলন বলে কিছু নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কখনও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিতে শিল্পীর ভূমিকার বিশ্লেষণ করার অভ্যাস হারাননি। তিনি কখনও কোনও দ্রষ্টা বা পয়গম্বরের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেননি, বরং তিনি সবসময়েই অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে নিজের কাজ ও কৃতিত্বের কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, "কোনও চলচ্চিত্রকার জনগণকে বদলাতে পারে না। জনগণ মহান। তারাই নিজেদের বদলে নিচ্ছেন। আমি এই মহান বদলগুলি রেকর্ড করছি শুধু।"
১৯৭৪ সালে অসুস্থতা এবং পরপর নার্ভাস ব্রেকডাউনের মধ্যেই তিনি তাঁর অন্তিম ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ শেষ করেন। চলচ্চিত্রের যে ভাষা ও ব্যাকরণ তিনি এতদিন ধরে রপ্ত করলেন, বিকাশ ঘটালেন, শেষ ছবিতে এসে তিনি যেন এই ভাষা এবং ব্যাকরণকেই চরম দুঃসাহসভরে একেবারে নাকচ করে দিলেন। ছবিটি যে কীভাবে দর্শকদের সঙ্গে এমন গভীর ঘনিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হল, তা বোঝা কঠিন। চরিত্রগুলো যেন পর্দা থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি কথা বলে এবং তাদের জবাব না দিয়ে উপায়ও নেই। নিজেদের পক্ষে বা বিপক্ষে খুব তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে বাধ্য করে চরিত্ররা। ঋত্বিকের অভিনীত কেন্দ্রীয় চরিত্রটি তার বাস্তব জীবনকেই এমন বিদ্রুপ করে, যে দর্শকরাও ভাবতে বাধ্য হয়। চরিত্রটির সমালোচনা করা ছাড়া উপায় থাকে না তাদের। সম্ভবত ঋত্বিক আজীবন সিনেমার মাধ্যমে এটিই করার চেষ্টা করে এসেছেন। আবার অন্যদিক থেকে ভাবলে মনে হয়, তিনি হয়তো দেখতে চেয়েছিলেন, সিনেমার ভাষা হিসেবে এতদিন ধরে যা স্বীকৃত হয়ে এসেছে, একমাত্র সেসবের বেশিরভাগটাই সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যানে করেই এটি অর্জন করা সম্ভব হবে।
১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, মাত্র একান্ন বছর বয়সে মারা যান এই মহান চলচ্চিত্রকার। তিনি বুর্জোয়া সমালোচকদের অবহেলা পেলেন জীবনভর, প্রতিষ্ঠান তাড়িয়ে বেড়াল তাঁকে, এবং চলচ্চিত্রশিল্পের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাব্যক্তিরা নিংড়ে নিল। আগামীতে তাঁর বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা ছিল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহান উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’, যার মধ্যে অন্যতম। এই কাজগুলি আর সম্পূর্ণ হবে না কখনও, তবে ঋত্বিকের নামটা বেঁচে থাকবে। মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ঋত্বিক পুনরুজ্জীবিত হতে শুরু করেছেন। জনগণের দাবিতে তাঁর ছবিগুলি আবারও নতুন করে আলোচিত হচ্ছে। অতীত থেকে জনগণ এমন কিছু ফিরিয়ে নিয়ে আসছে, যা তাঁর শত্রুদের একটি গোটা প্রজন্ম মিলেও ধ্বংস করতে পারেনি। তাঁর কাজ শীঘ্রই নতুন চলচ্চিত্রকার ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে।
তাঁর ছবিগুলি চলচ্চিত্রে উৎকর্ষের আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ভাষান্তর: আনন্দরূপ চক্রবর্ত্তী
সূত্র: সফদার হাসমির লেখা প্রবন্ধ ‘The Genius that was Ritwik Ghatak’ -এর এই বাংলা তর্জমাটি ঋত্বিক ঘটকের জন্ম শতবর্ষে ‘মার্কসবাদী পথ’ পত্রিকা থেকে প্রকাশ করা হলো।
ঋত্বিক ঘটক: এক অনন্য প্রতিভা
সফদার হাসমি
সফদার হাসমি




মন্তব্য