.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : মনিরুল হাসান

১.
সকল জাতির বেলায় এমন ঘটনা ঘটে না, যেমনটি ঘটেছে এই জাতির নিজস্ব স্বাধীন রাজনৈতিক অস্তিত্ব নির্মাণকালে, ১৯৭১ সালে, একটি রক্তাক্ত জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে এই জনপদের মানুষেরা তাদের নিজস্ব মানচিত্র নির্মাণ করেছে। সকল প্রকার রাজনৈতিক বিতর্ক বাদ দিয়ে জনযুদ্ধ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে এই অর্থে যে, ঐ যুদ্ধের ভেতরে এই অঞ্চলের প্রায় সকল মানুষ সম্পৃক্ত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন মারা পড়ে, গ্রামের পর গ্রাম যখন ভস্মীভূত হয়, এক কোটি মানুষ যখন সীমান্ত অতিক্রম করে তখন ঐ যুদ্ধটি অবশ্যই জনযুদ্ধে রূপ নেয়, তবে এ বিষয়টিও লক্ষ্য করতে হবে যে, এই যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দলটির শ্রেণীচরিত্র ছিল পেটি বুর্জোয়ার। যার ফলে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা এবং একটি জাতির লক্ষ্য ও স্বপ্ন নির্মাণের ব্যর্থতা এই নেতৃত্বের একটি স্বাভাবিক সত্তা। খণ্ডিত ইতিহাস চেতনা এবং ক্ষমতার দৌড়ঝাঁপে অল্পকিছু লোক হয়ে উঠল মুক্তিযোদ্ধার দাবীদার। অথচ যে ব্যাপক জনগোষ্ঠি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তাদের কথা বাদ পড়ে গেল অনায়াসে। ঐসব যোদ্ধাদের খবর আমরা এখন মাঝে মাঝে দৈনিক পত্রিকার ফিচারে দেখি “অমুক মুক্তিযোদ্ধার করুণ অবস্থা" এই সকল শিরোনামে।

০২. 
সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাঙ্গালীর ইতিহাস অনতিবিলম্বে হয়ে উঠে স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস; নেতৃত্বের ব্যর্থতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদিকে পুঁজি করে ক্ষমতা দখল করে সামরিকতন্ত্র, শুরু হয় ইতিহাসের পশ্চাৎমুখী যাত্রা। ১৯৭১ সালে ব্যাপক বুদ্ধিজীবী হত্যার ফলে এদেশে স্বাধীনতার পরে শিল্প সাহিত্য তথা যাবতীয় অঞ্চলে এক ধরনের শূন্যতা দেখা দেয়। অবশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা (দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) সামরিক চক্রের নানা প্রকার ভয় ও প্রলোভনের ভেতর আত্মসমর্পণ করে অথবা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রে পরিণত হয়। এসবের পেছনে তাদের শ্রেণীচরিত্রও কাজ করেছে। ফলে নিরপেক্ষ বা মুক্ত চিন্তার জগত ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে গিয়েছে।

০৩. 
এ সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে আমাদের শিল্প- সাহিত্যে, মুক্তিযুদ্ধের মত একটি বিশাল গৌরবময় ঘটনা, যা হয়ে উঠতে পারত আমাদের শিল্প-সাহিত্যের প্রধান বিষয়, উল্লেখিত কারণে তা হয়ে উঠল না।

০৪.
সামরিকতন্ত্র কখনোই পুঁজির বিকাশ অস্বীকার করেনি বরং নীতিহীনতা, লুটপাট; দুর্নীতি, ঋণের খেলাপ ইত্যাদি দ্বারা একটি লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণী তৈরি করার চেষ্টা করেছে নিজেদের স্বার্থেই। এর ফলে একটি দরিদ্র দেশের ভঙ্গুর বুর্জোয়া শ্রেণীর যে রকম চরিত্র দাঁড়ায় ঠিক সে রকম একটি ধনিক শ্রেণীর উত্থান ঘটে বাংলাদেশে। একই সাথে শহর-কেন্দ্রিক শিক্ষিত একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীও বেশ সংগঠিত রূপ নেয়।

০৫. 
সমাজ বিকাশের দ্বান্দ্বিক শর্ত অনুযায়ী গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভেতর থেকেই ক্রমশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি ঐ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আকাংঙ্ক্ষা জোরদার হয়। এর ফলে ৯০ দশকের প্রথম দিকে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ইতিমধ্যেই আমলাতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক কম্পানি ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষিত জনগণের ভেতরে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত একটি অস্পষ্ট হলেও ধারণা তৈরি হয় ।

০৬. 
সমাজের ভেতরে ঘটতে থাকা এসকল ঘাতপ্রতিঘাতের ভেতর দিয়েই আমাদের শিল্প-সাহিত্য তথা সমস্ত সাংস্কৃতিক জগত এগিয়েছে। এই এগোনোর মধ্য দিয়ে আমাদের সাহিত্য কয়েকটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। আমরা যদি মোটাদাগে এর বিভাজন করি তাহলে আমাদের সাহিত্যে নিম্নল্লোখিত প্রবণতাসমূহ দেখা যায়:

(ক) রাজনৈতিক সাহিত্য: গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম আমাদের বহু সাহিত্যিককে রাজপথের শ্লোগানে শরিক করেছে। চিরকালের জন্য সাহিত্য রচনার বদলে সমকালের দাবী মেটাতে গিয়ে এরা এদের সমস্ত ক্ষমতা সমর্পণ করেছেন রাজনীতির ভেতরে। এর ফলে শ্লোগান বা পোস্টারের শিরোনামের মানের উন্নতি ঘটলেও শিল্প বিচারে সে সকল সাহিত্য হয়ে গেল অনুল্লেখ্য । 
(খ) প্রচলিত সাহিত্য: এই ধারায় সাহিত্য রচনা-ই সবচেয়ে প্রবল, খানিকটা সচেতনতা, খানিকটা বিনোদন এসবের মিশেল দিয়েই এই ধারার সাহিত্যগুলি মূলত রচিত হয়। তবে একথাও স্বীকার করে নেয়া ভাল যে, এই ধারার কিছু সাহিত্যই কিন্তু নিজস্ব শিল্পমূল্যে উল্লসিত। এ ধারার লেখকরা মূলত কোন প্রকার পরীক্ষা- নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হন না। এদের হাতে কখনো সাহিত্য বাঁক নেয় না। তবে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টিং প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং তরল মধ্যবিত্তের বিকাশের ফলে বাংলাদেশের সাহিত্যে এই ধারাই সবচেয়েক্রিয়াশীল।
(গ) অন্য ধারার সাহিত্য: প্রচলিত ধারার বিপরীতে আমাদের সাহিত্যে অন্য একটি ধারাও বিদ্যমান। এই ধারার লেখকেরা অকারণে সস্তা জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটেননি। বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোতেও লিখতে এদের প্রবল আপত্তি।

অনিবার্যভাবেই এই সব সাহিত্যিকরা প্লাটফর্ম হিসাবে বেছে নিয়েছেন লিটল ম্যাগাজিন। তরুণ, সম্ভাবনাময় এবং কিছু করার উন্মাদনাই লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের বৈশিষ্ট্য।

০৭. 
লিটল ম্যাগাজিনের লেখকরা অত্যন্ত সচেতনভাবে তাদের লেখাকে সস্তা জনপ্রিয় অথবা রাজনৈতিক শ্লোগানে রূপ নিতে দেননি। যথেষ্ট পড়াশুনা ও নিরলস চর্চার ভেতর দিয়ে তারা তাদের কাজকে শিল্পে রূপ দিতে চেয়েছেন। সবাই সফল হয়েছেন একথা না বললেও এটুকু বোঝা যায় যে, তারা প্রত্যেকে এককভাবে এবং সামষ্টিকভাবে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন। ৮০'র দশকে প্রকাশিত বহু লিটল ম্যাগাজিন এই বক্তব্যের সাক্ষ্য দেবে। পরবর্তীতে অনেকেই এই ধারার প্রতি সৎ থাকেননি, তবে সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ ।

০৮. 
১৯৯৯ সালে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক কথা সাহিত্যিক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ এবং চিত্রকর রনি আহম্মেদ তাদের যৌথ শিল্পে একটি গল্প-অ্যালবাম বাজারে আনেন। লেখা ও চিত্রের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। গল্প অ্যালবামটির নাম “লাশ নাই"।

০৯. 
যৌথ শিল্পীর একজন হলেন চিত্রকর রনি আহম্মেদ। এই গল্প-অ্যালবামে তিনি ড্রইং এবং স্কেচএর মাধ্যমে যে চিত্রমালা উপহার দিয়েছেন তা অনবদ্য। তার আঁকা ড্রইংগুলি ও স্কেচগুলি গল্পের ইলাস্ট্রেশন না হয়ে আরো অধিকতর ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত। আলাদাভাবেও তার চিত্রমালা যুদ্ধের ভয়াবহ দুঃসময় ফুটিয়ে তোলে। গল্প ও চিত্রের এ রকম আলাদা অথচ যৌথ প্রচেষ্টা আমাদের শিল্প অভিজ্ঞতায় এক রকম বিরল সংযোজন। চিত্রকলা সম্পর্কে আলোচকের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের কারণে রনি আহম্মেদ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা গেল না। তবে আমাদের মুগ্ধতা ও বিস্ময় রনি আহম্মেদের পরবর্তী কাজ দেখার জন্য সাগ্রহে প্রতিক্ষারত।

১০. 
এবার লেখক সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের এটি তৃতীয় গ্রন্থ। রিয়াজ জনপ্রিয় লেখক নন। তিনি লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। সচেতন ভাবেই তিনি শুধুমাত্র লিটল ম্যাগাজিনে লেখেন। সুতরাং জনপ্রিয় লেখক না হওয়াটাই সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের একটি লক্ষ্য বলে আমরা বিবেচনা করতে পারি। এই বিবেচনার পক্ষে তার লেখাগুলি আমরা প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। যে গদ্যভাষা সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ নির্মাণ ও ব্যবহার করেন তা অত্যন্ত পরিশ্রমী, স্বনির্মিত গদ্যভাষা। বিনোদন নির্ভর পাঠকের পক্ষে সেই ভাষা আয়ত্ব করা কঠিন। দ্বিতীয়তঃ তার গল্পের চরিত্রগুলি সাধারণ মানুষ। পতনশীল মধ্যবিত্ত, ইটের ভাটার মজুর, চুনতি পাড়ার আবুইল্যা থেকে শুরু করে খলিফাপাড়ার বুড়ো দর্জি পর্যন্ত। কোন সুপারম্যান জাতীয় চরিত্র রিয়াজের গল্পে  থাকে না। এছাড়া রিয়াজের গল্পে ঘটনার চেয়ে তার অনুষঙ্গ বড়। একটি ঘটনার বর্ণনা দেয়ার চাইতে ঐ ঘটনাটির ঘটনশীল মুহূর্তে পারিপার্শ্বিক চরিত্রগুলির আচরণের মধ্য দিয়ে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ তার মানবিক সম্পর্কগুলি নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। দেখার ও বলার এই ভিন্ন প্রক্রিয়া রিয়াজকে গড় পাঠক থেকে বিচ্ছিন্ন করে সচেতন পাঠকের কাছে নিয়ে যায়।

১১.
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের গল্পের চরিত্রগুলির প্রবণতা বিচিত্র। চরিত্রগুলি কখনো ব্যক্তিগত, কখনো প্রতিনিধিত্বশীল। মুয়াজ্বিন তালেব আলী যখন বিশ্বব্রহ্মান্ড কাঁপিয়ে 'না' বলে চিৎকার দেয় অথবা বুড়ো খলিফা যখন এক সুশৃংখল স্বপ্ন দেখে তখন ঐ চিৎকার বা স্বপ্ন আমাদের সকলের প্রতিনিধি। আবার একই ভাবে তালেব আলী একজন মুয়াজ্বিন বা বুড়ো খলিফা একজন ব্যক্তিগত খলিফা মাত্র। তাদের বিশ্বাস এবং বোধের সাথে আমাদের দূরত্বও থাকে। এইভাবে নৈকট্য, দূরত্ব এবং বহু বিচিত্র অনুভূতির ভেতর দিয়ে রিয়াজের গল্প দাঁড়ায়।

১২. 
আসুন এবার আমরা গল্প অ্যালবামটির গল্পের ভেতরে প্রবেশ করি। প্রথম গল্পটির নাম “মারণ দাত”। '৭১ সালে যুদ্ধচলাকালীন রাতে কোন এক দম্পতির গৃহের দরজায় শত্রুপক্ষের টোকা পড়ে। ঐ দম্পতির ছেলে ও মেয়েকে ইতিমধ্যেই নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দেয়া হয়েছে। দরজায় করাঘাত বাড়ে, অনিবার্য পরিণতির কথা বিবেচনা করে গৃহিণী আত্মহত্যা(?) করে। যুদ্ধরাতে কোন এক পরিবারের আক্রান্ত হওয়া এবং সেই সময়ে রাত্রিকালীন ভীত, সন্ত্রস্ত, মৃত্যুদশাগ্রস্থ একটি শহরের করুণ বাস্তবতা আর অসহায়তার ডিটেলস বর্ণনা এই গল্পটিকে অন্যরকম ব্যঞ্জনা দান করেছে।

“দীর্ঘজীবী হোক আবুল হোসেন” এই গল্প অ্যালবামের দ্বিতীয় গল্প। এই গল্পে রিয়াজ ঘটনাটি দেখেন ও বর্ণনা করেন ক্যামেরার ভেতর দিয়ে। খলিফা আবুল হোসেনের জীবনে ঘটে যাওয়া ৭১ সালের একটি পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে একজন আহত মুক্তিযোদ্ধার শরীর সেলাই করতে। এই ঘটনাটি আবুল হোসেনকে দাঁড় করায় প্রতিনিধিত্বশীল মানুষের কাতারে। যুদ্ধটা যেহেতু সকলেরই, আবুল হোসেনকে তাই তার মানচিত্রটি সুঁই দিয়ে মানুষের শরীর সেলাই করে নির্মাণ করতে হয়। গল্পটিতে যুদ্ধ -পরবর্তী সময়ের কথাও এসেছে। আবুল হোসেনের স্বপ্ন আর বাস্তবতার দূরত্ব এত বেশি যে, লেখকের ক্যামেরার ফোকাস আর স্থির থাকে নি। না থাক, যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ দৃশ্যঘটনায় সম্পৃক্ত হতে আমাদের একটুও অসুবিধা হয়নি। দক্ষ ও স্থির হাতে রিয়াজ ক্যামেরাটি ধরে রেখেছেন। ফ্রেম একটুও কাটেনি। ব্যক্তিগত বিবেচনায় এই গ্রন্থ তথা সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের এখন পর্যন্ত লেখা গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প এটি ।

“গল্পটি ভূতের নয়” এই গল্পটি অ্যালবামের তৃতীয় গল্প। রাজাকার পাহলোয়ান মিয়া চোখ বেঁধে দীননাথ মাস্টারকে ধরে নিয়ে আসে। দীননাথ মাস্টারকে পরে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডে জড়িত হওয়ার ফলে পাহলোয়ান মিয়া ক্রমশঃ অপরাধবোধের ভেতর আক্রান্ত হয়. মৃত দীননাথ মাস্টার তার কাছে ভূত হয়ে ফিরে আসে। তাকে তাড়া করে, সে পালাতে থাকে। রাজাকার এবং মানুষ পাহলোয়ান মিয়ার দ্বন্দ্বই এই গল্পটির মূল ঘটনা।

"লাশ নাই" গল্প অ্যালবামের চতুর্থ গল্প। "লাশ নাই" গল্পটি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ বর্ণনা করেছেন ভিন্নতর ফর্মে। আমাদের গ্রামবাংলায় যেভাবে কিসসা বর্ণনা করা হয় সেইভাবে লেখক এই গল্পটি উপস্থাপন করেছেন। গ্রামের এক সাধারণ মুয়াজ্জিন প্রতিদিন অসংখ্য লাশের খবর শোনেন অথচ সেই সব লাশ বহনের জন্য খাটিয়ার প্রয়োজনে কেউ তার কাছে আসে না। বিষয়টি তাকে ভাবিত করে। যখন একজন মুক্তিযোদ্ধার লাশ বহনের জন্য খাটিয়ার প্রয়োজন হয় তখন শত্রুরা তাকে খাটিয়া না দেয়ার জন্য হুমকি দেয়। প্রতিবাদে তালেব আলী নিজেই লাশ হয়ে যায়। পড়ে থাকে ঐ খাটিয়ার উপর। এই গল্পের বর্ণনায় লেখক আরোপ করেন কাব্যময়তা, বাংলাদেশের আকাশ-মাটি-পাখি বর্ণনায় কবিতার ফর্ম ব্যবহার এই গল্পটিকে করে তুলেছে অনবদ্য।

১৩. 
এই গল্পগুলো কি তবে অবিমিশ্র শৈল্পিক? কোথাও কি কোন দুর্বলতা নেই? সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ কি তবে শিল্পযাত্রায় সেই অসমতল রুক্ষ পাথুরে রাস্তা পেরিয়ে এমন কোন স্থানে পৌঁছেছেন যেখান থেকে পরবর্তী রাস্তা সমতল? না, মনে হয় এখনো আরো কিছু পথ বাকী আছে তার। সেই প্রসঙ্গে আসা যাক ।

প্রথম গল্পটি দিয়েই শুরু হোক। “মারণ দাঁত” গল্পটিতে জরিনার মৃত্যুটি কি হত্যা না আত্মহত্যা? গল্পের এই জায়গাটি অস্পষ্ট। এর কোন কারণ বোঝা গেল না। অকারণ জটিলতা শিল্প সহায়ক নাও হতে পারে। নিরীক্ষার কারণে জটিলতা মানা যেতে পারে কিন্তু জটিলতা বা অস্পষ্টতা যদি নিরীক্ষার বিষয় হয় তাহলে এ ক্ষেত্রে রিয়াজের সতর্ক হওয়া দরকার।

এই গল্পটি লেখক পাঠকের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে শুরু করেছিলেন। আমরা জনাব নাসিমের ভেতর দিয়ে গল্পের ভেতরে প্রবেশ করি। কিন্তু জরিনার মৃত্যুর পরের বাক্য থেকে লেখক নিজেই আবির্ভূত হলেন। একই ব্যাপার ঘটেছে "গল্পটি ভূতের নয়"-এর বেলায়ও। ঐ গল্পের পঞ্চম অধ্যায় থেকে লেখক নিজেই চলে গেছেন পাঠকের কাছে। এই বিষয়গুলি গল্পের কাঠামোকে দুর্বল করে ফেলেছে ।

আসা যাক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ভাষা সম্পর্কে। রিয়াজ নিজস্ব এক গদ্য ভাষা নির্মাণ করতে আগ্রহী। তার পূর্ববর্তী দুটি গ্রন্থে আমরা এই প্রবণতা লক্ষ্য করি। এই গল্প অ্যালবামটিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে তার নিজস্ব ভাষার কাজটি এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। তার ভাষা নির্মাণের উঠানামা এখনো ক্রিয়াশীল। এই গল্প অ্যালবামে তার প্রমাণ রয়েছে । একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এই অ্যালবামের প্রথম গল্পের ভাষা নির্মাণ ও পরবর্তী তিনটি গল্পের ভাষা থেকে একটু আলাদা। শেষ তিনটি "গল্প সাম্প্রতিক রচনা হিশেবে ধরে নিলে বলা যায় যে রিয়াজের ভাষা ক্রমান্বয়ে পরিশীলিত হয়ে উঠছে। তবে তার ভাষা থিতু হতে আরো খানিকটা সময় নেবে। তবে আমরা কামনা করি ভাষা দিয়ে লেখককে সনাক্ত করার যে দুঃসাহস রিয়াজ দেখাচ্ছেন তা অব্যাহত থাকুক।

১৪. 
এ সব কিছুর পরেও এই গল্প অ্যালবামটি একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তার কারণ একাধিক। এই অ্যালবামের মাধ্যমে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ মুক্তিযুদ্ধের মত একটি OBJECTIVE বিষয়কে তার গল্পের উপজীব্য করেছেন। লিটল ম্যাগাজিনের কথা সাহিত্যিকদের বিরুদ্ধে আমাদের সাধারণ অভিযোগ এই যে, তারা সাধারণত ব্যক্তির অন্তর্জগতের টানাপোড়েন নিয়েই গল্প লিখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। OBJECTIVE বিষয়গুলি তাদের রচনাতে দেখা যায় না। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের “লাশ নাই” গল্প অ্যালবামটি সেই অভিযোগের বিরুদ্ধে এখন থেকে কথা বলবে। এ ছাড়াও আমরা এই গল্প অ্যালবাম থেকে টের পেতে শুরু করি যে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি চটকদার সাহিত্যের বাইরে অন্যধারার সাহিত্যে আসা শুরু করেছে। বীজ রোপিত হয়ে গেছে। একদিন মহীরুহের আগমন অবশ্যাম্ভাবী।

বাংলাদেশের সাহিত্য প্রবণতা এবং সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের 'লাশ নাই' গল্প- অ্যালবাম প্রসঙ্গে
মনিরুল হাসান
 

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : মনিরুল হাসান
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : মনিরুল হাসান
► মনিরুল হাসান রচিত প্রবন্ধ
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s16000/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s72-c/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/11/Monirul-Hasans-article-on-Syed-Riazur-Rashid.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/11/Monirul-Hasans-article-on-Syed-Riazur-Rashid.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy