.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : শোয়েব শাহরিয়ার

এটা প্রায় নির্ধারিত সত্য সিদ্ধান্ত: বহুচর্চিত পথে সাহসী পদক্ষেপ দুর্ভর এবং তা চোরাপাঁকে আপন অস্তিত্বনাশ, বিশেষতঃকথাসাহিত্যে। বিশ্বসাহিত্যের উকর্ষ অঙ্গনে ইতোমধ্যেই কথাসাহিত্যের যে স্বর্ণসৌধপুঞ্জ শাশ্বত স্তম্ভতুল্য তার স্ফটিক রশ্মি বঙ্গসাহিত্যের স্হুুলত্ব-সর্বস্ব গতরে ঠিকরে পড়ে ঔজ্জ্বল্য এনেছে বটে। বিরুদ্ধ বাতাসে পাল উঁচিয়ে উজানে চলার দৃঢ় ত্রাতা কিছু পরিবর্তন ও স্থায়িত্ব প্রত্যাশী তরুণ সেই বিশ্ববোধ আত্মস্থ করার চেষ্টারত বর্তমানে। তারা দীর্ঘ প্রয়াসসিদ্ধ গড্ডল ঐতিহ্যকে একটু বায়ে রেখে দৃষ্টি রাখলেন দক্ষিণে: যেখানে বিশ্ববোধের সাথে নন্দন চেতনার স্ফূর্ত-স্ফুরণ। যেখানে ম্যাজিক রিয়ালিজম, এ্যান্টি ন্যারেটিভ, পোস্ট মর্ডানিজম, নিও- ক্লাসিসিজম ইত্যাদি নতুন সূর্যের দীপ্ততা নিয়ে উচ্চৈঃশ্রবা। সেখানে রত্নসম্ভারের প্রাচুর্য তুলনারহিত; গভীর সমুদ্রের তলদেশে ডুব দেবার ক্ষমতা এবং বিস্তীর্ণ রত্নরাজির ভেতর থেকে, ডুবুরীর সততায় মূল্যবান ধাতব ঐশ্বর্য ধারণ করবার দক্ষতা আমাদের নব্য চেতনা বিপ্লবীদের কতটুকু বর্তমান, তার এখনো ন্যূনতম প্রমাণ মেলেনি।

বিশ্বসাহিত্যের সর্বত্রই গড়চলতি জনপ্রিয় ধারায় পাশাপাশি ক্ষীণতোয়া হলেও সচেতন জীবন অন্বেষী, বৈরী, স্থায়ীমনস্ক ধারা অলক্ষ্যে বেগবান সতত। বাংলা সাহিত্যেও বর্তমান রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি জগদীশকে যেমন, তেমনি ত্রি- বন্দ্যোপাধ্যায় পরে একেবারে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত একমাত্র কমলকুমার এবং অমিয়ভূষণ, দেবেশ রায়, সুবিমল মিশ্র, সন্দীপন, বাংলাদেশের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসেরা।

নতুন প্রজন্মের গাল্পিকদের আমি এই ক্ষীণতোয়া ধারায় পাড় ভাঙ্গা বিপুল বিধ্বংসী বলে মনে করি। নতুন প্রজন্মের গল্পকারেরা অনেকটা উৎকেন্দ্রিক উদ্ভ্রান্ত বলে চিহ্নিত হলেও তাঁরা তথ্যকেন্দ্রিক, বুদ্ধিবৃত্তিক। নিছক তরলীয় আবেগে স্নানস্বচ্ছ হওয়া তাদের অপছন্দ, ভাঙচুরের নেশা গঞ্জিকা সেবন প্রসূত নেশার মতই তীব্র ও আগ্রাসী, ভেঙ্গে ফেলবার পর্যাপ্ত তাত্ত্বিক সমর্থনযোগ্য বৈদেশিক পুঁজিও বর্তমান, তবে ভাঙ্গার দুঃসাহসের ফলাও চিত্র যেভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে ভাঙ্গা হচ্ছে না ততখানি বা ভাঙ্গা যাচ্ছে না ততখানি।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, এ-প্রজন্মের নিবিষ্ট কণ্ঠকথক, স্বল্পপ্রজ ধ্রুপদী ও ধৃতিমান। ভিন্নতর এক মেরুমাত্রা থেকে জীবনায়ন আর স্থিরসিদ্ধান্ত, সহজলভ্য অর্থ ও খ্যাতির দুর্মর মোহগ্রস্ততা থেকে তিনি ঈর্ষণীয় ঋষিস্বভাব। রিয়াজ স্বল্পভাষী, দূরদ্রষ্টা, ঘনীভূত রহস্যের গভীর স্তরান্যাসে অনায়াস-সিদ্ধ। তাঁর গল্পে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ মোহিনী শক্তির ন্যায় আন্তর প্রভ। কখনো কখনো সূক্ষ্ম আইরনি হয়ে ওঠে জীবন মন্থনের প্রতীক। মাঝে মাঝে গতিমান চাবুকের তীব্র স্বভাবে অভিঘাত মুখর। বাচনভঙ্গি, বচনশৈলী, ভাষা সঞ্চার, সর্বোপরি নির্মাণ-কৌশলে রিয়াজ আত্মপ-প্রবৃত্ত, উত্তরণ-প্রত্যাশী। রিয়াজের গল্পের কেন্দ্রাভিসারী ব্যাপ্ত উপাদান হলো প্রবল যৌনানুগ কষাঘাত। যৌনতা বেশ তপ্ত মত্ততা নিয়ে মুখিয়ে থাকে প্রায়শই।

রিয়াজ আপাদমস্তক ছোটকাগজের লেখক। লিটল ম্যাগ স্পষ্টতঃ যে নীতি নির্ধারক ও আদর্শ দ্যোতক– রিয়াজ তার পরিশ্রুত প্রতিনিধি। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা রিয়াজের ঘনিষ্ঠ জীবন বিশ্বাসের নান্দনিক চৈতন্য, যা থেকে, এখনো পর্যন্ত, একটুও চ্যুত হয়নি, ভ্রষ্ট হয়নি, হত-বিশ্বাস হয়নি।

প্রকৃতি অনুযায়ী রিয়াজের গল্প দু'ভাগে বিভাজিত। প্রথম পর্বের গল্পগুলোর আভ্যন্তরিক উপাদনসমূহ ঐতিহ্যিকপ্রবণ, পূর্বজ পক্ষীয় চৈতন্যের অনুবর্তন-সিদ্ধ অনেকটা। দ্বিতীয় পর্বের গল্পগুলো সম্পূর্ণ নবকলেবরীয়। আঙ্গিক, ভাষিক ও পরিপ্রেক্ষিতের দিক থেকে বিরলপূর্ব সৃষ্টি কৌশলের অভিনব সংশ্লেষণ ও সংযোজন, নিঃসন্দেহে একথা বলা যায়। এ পর্বের গল্পগুলো নিরীক্ষা-নত, নবমাত্রিক বিষয় ও আঙ্গিকের অন্বেষণ ঋদ্ধ। তৎসম বহুল ভাষার গাম্ভীর্যে আপাত দুরূহ আবহ তৈরির ঝোঁক আছে বলে মনে হয়। কিন্তু সে জটিলতার আবরণ দুর্ভেদ্য নয়। রিয়াজের সৃষ্টিমানসকে জানতে হলে বিভাজিত উভয় স্তরের আলোচনাই বাঞ্ছিত।

নুরল এসলামের ইন্তেকাল

গল্পের প্রারম্ভিক পংক্তি: 'রাত্রি হয় ঘুমের'। বাক্যের অবকাঠামোতে 'হয়' পদটি ইংরেজি ব্যাকরণের রীতি অনুযায়ী ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত। কিন্তু বাংলা বাক্যতন্ত্রে এখানে কোনো ক্রিয়াপদ ব্যবহার জরুরী নয়। এবং কোনো ক্রিয়াপদ ব্যবহার না করলে অর্ধবাক্যটির রূপ দাঁড়ায় এ রূপ: রাত্রি ঘুমের। 'রাত্রি ঘুমের' কাঠামো থেকে শব্দবিন্যাসগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বাক্যাংশটি 'ঘুমের রাত্রি'-তে রূপান্তরিত হলে অর্থ বৈপরীত্য সৃষ্টি সত্ত্বেও বাক্যাংশটি 'হয়' প্রচলিত রীতিসিদ্ধ। গাল্পিক বাক্য গঠনরীতিতে কাব্যিক দ্যোতনা সৃষ্টি অভিপ্রায়িত তাই কাঠামো ভিন্নমাত্রিক বটে। যদিও গল্পকার 'রাত্রি' এবং হয় এর মাঝে ছোট্ট একটা'–'হাইফেন ব্যবহার করে সমাসবদ্ধতায় রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন। বাক্যের দ্বিতীয় পর্বটি, যে পর্বে প্রথম অংশের কর্তার অর্থের ব্যাপ্তি ঘটেছে, সে পর্বের শেষে একটা ড্যাশের পর, খানিকটা অসংলগ্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে 'সুপ্তি' ও 'নিরাপদ' শব্দদ্বয়। শব্দ দুটির প্রয়োগসিদ্ধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যায়। নিরাপদ শব্দ মানুষের জেগে ওঠার নিরাপত্তাসূচক বটে কিন্তু সুপ্তি শব্দ মৌল অর্থবোধের সাথে ছিন্নবন্ধন। তারপর সাতটা স্তবকে 'রাত্রি' নামক সময়ের মধ্যে সংঘটিতব্য বিভিন্ন কর্মকান্ডের বর্ণনা উপর্যুপরি 'অথবা' অব্যয় ব্যবহারের মাধ্যমে। তাও কি খুব জরুরী ছিল ?

আমার কাছে গল্পটির আদল সম্পূর্ণ ভিন্নগোছের মনে হয়েছে। প্রচলিত গল্পের প্রথাবদ্ধতার বাইরে এর বেড়ে ওঠা এ্যান্টি আখ্যানে কখনো উল্লম্ফণ, অতিশয়োক্তি, কখনো বা ফ্যান্টাসি, কখনো ম্যাজিক রিয়ালিজমের স্পর্শে। সব মিলিয়ে গল্পের একটা সর্পিল গতির সচেতন প্রয়াস পরতে পরতে অনুভবগ্রাহ্য। রিয়াজ গল্পের প্রথম অংশে রাত্রির যে ক্রিয়াযজ্ঞতার ডিটেল জমা দিলেন পরবর্তী ঘটনাগুলোর ঋদ্ধি সেই রাত্রির কৃষ্ণ গহবরকে কেন্দ্র করে। বিভিন্ন কিসিমের একগুচ্ছ স্ত্রীর রাত্রিকালীন শব্দ- সন্ত্রাস নুরুল ইসলামের কামপ্রবৃত্তির অবাধ ও সীমাহীন স্বেচ্ছাচারের মানসিক পরিণতি ব্যতিরেকে অন্য কিছু নয়। বউ বদলের স্তবক মধ্যবর্তী 'একজনের বুকে পিশাচ বাজনা আর অন্যজনের বুকে নদী' এই কাব্যসুলভ পংক্তির সতত ব্যবহার নুরল এসলামের পরবর্তী কাম স্বেচ্ছাবিহারের সূচনা সংগীত। প্রগলভ যৌন সম্ভোগের বিচিত্র-মাত্রিকতা বিকৃতি-মনস্কতার পরিচয় জ্ঞাপক এবং তা বাস্তবতামুখিন। তবে নুরল এসলামের পলায়নপরতার জন্য জ্বলজ্যান্ত পুলিশের প্রয়োজন নিরর্থক ছিল।

ক্রমশ গল্পের আন্তর বস্তুপুঞ্জের পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নুরল এসলামের পলায়নপরতার সাথে সাথে আধিদৈবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। পরবর্তী গল্পাংশটুকু কুহকী স্বপ্নাচ্ছতায় আকীর্ণ। প্রেক্ষাপট পাল্টে নতুনতর ভুবন-চত্বরে প্রবেশ করে জীবন। কামপ্রবৃত্তির স্বর্ণ আসক্তিতে পূর্ববর্তী জীবন যেখানে অনুপুংঙ্খ জান্তব ও পাশব বিষয়ে ছেয়ে থাকত এখন সেখানে “লোকালয়, মানুষজন স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট”-- পরিশ্রম এখানে সর্বস্ব। কেউ এখানে বিনোদন বহুল নয়। এবং কাম: সুস্থতা, কিন্তু রুক্ষতা নয়: প্রেরণা যোগায় শুধুমাত্র অটুট মানবিক আত্মা।” নুরল এসলামের দৈহিক ও আত্মিক অবস্থান
উচ্চতর হয়। যৌথ ব্যবস্থায় তার জীবন যাপন মধুর ও আনন্দময়। একসময় শ্রমশীল,স্বাধীন সুখী  প্রজন্মের হাতে সমস্ত দায়-দায়িত্ব অর্পণ করে সুকুঞ্জ ছেড়ে সে ফিরে আসে সুদূর অতীতের গলিত ক্ষয়িত  শহরে একজন নির্বানপ্রাপ্ত মানুষ হয়ে। প্রত্যাবর্তিত ভূ-খণ্ডে কুফল রোধের ক্ষমতা শূন্যমাত্রিক বিধায় সে নিজের হাতে কবর খুঁড়ে নিজেই এক ফোঁটা নিবিড় ছায়া প্রপাতকে স্থায়ী করে নেয়।

গল্পের এ-অংশটুকু স্বপ্নাক্রান্ত ইউটোপিয়া সংক্রামিত দলছুট  সোনালি রোদ্দুরের আদরের মত। অন্য কথায়, অতিশয়-গ্রন্থন। অতিরেকী কল্পনাপুঞ্জের দুর্মর বিলাস, স্বকপোলকল্পনা। প্রত্যেক মানুষের অভ্যন্তরেই আদর্শিক একটি স্বর্গীয় পীঠস্থানের প্রত্যাশা নিয়ত বাড়তে থাকে, বাস্তবে যার প্রাপ্তি রীতিমত অসম্ভব, সেই সুখ-কল্পনার মূর্ত- প্রতীক নুরল এসলাম। তার পূর্বজীবনের যৌনবিকৃতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বোধকরি ভেতরে অনুশোচনা বোধ বেড়ে তা অপরাধ বোধে এসে থিতু হয়। সেই অপরাধ বোধের তৃপ্তিসাধনের জন্য তার মানস জগতে এক দূরকল্প অতুল ঐশ্বর্যভূষিত অলৌকিক সর্বশান্তি প্রাপ্তির লীলাস্থান তৈরি করে আপন পাশবিকতার মুক্তি দিয়েছে এবং নিজের হাতেই চিরশান্তির জায়গা খনন করে আপন মৃত্যুকে চরিতার্থ জ্ঞান করেছে। তার এই কাংক্ষিত উচ্ছল স্বেচ্ছামৃত্যুর পর জীবদ্দশায় তার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত ছায়ার সম্পাতও ঘটেছে বড় স্বস্তিময়।

গল্পের প্রারম্ভটায় মানসিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে দুর্জ্ঞেয় রাহস্যিক পথে গল্পের যে উত্তরণ- সম্ভাবনা তাতে একটা মহত্ত্ব পাবার মত ব্যাপার ছিল। স্ত্রী বদলের মধ্যে ভোগপটু পুরুষ চরিত্রের অন্তর্লীন অনুক্ত গুণবৈশিষ্ট্যের প্রকাশ তা কিছু বেশ ঘনীভূত অলঙ্কারে এখানে দ্যোতিত। প্রত্যেক স্ত্রীর আচরণেই একই জাতীয় শব্দভীতি রীতিমত একটা মানসিক প্রক্ষোভ হিসেবে চিহ্নিত হবার যোগ্য। অথচ রিয়াজ নিছক স্বপ্নাচ্ছনতায় বা খানিকটা ম্যাজিক রিয়ালিস্টিক আবহে মোটিফটাকে পরিবর্তন করে ছাড়লেন।

কল্প গল্প অথবা টাল হয়ে ফাং ফুং

নেতার অমৃতে চুর হয়ে নব্যদশাপ্রাপ্ত একজন চৌকস দৃষ্টি ও অভিজ্ঞতাতে তাবৎ বিশ্বদর্শন এই গল্পে ভিন্নমাত্রায় সংস্থিত। নেশা অনেক সময় সত্যদর্শন ও সত্যবচনের উদ্‌গাতা। সুস্থ স্বাভাবিক সামাজিকের পক্ষে যে নিষ্করুণ সত্য কথাটা মানিয়ে নেয়া সমাজের ভেতরে থেকে বলা প্রায় অসম্ভব তা একজন নেশাগ্রস্তের পক্ষে সহজেই বলা সম্ভব। নেশায় তুরীয়দশাপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তি আপন অহংসত্তার উর্ধ্বে উঠে গেলে তার সামাজিক কোনো বাঁধন থাকে না। তাই তার পক্ষে সত্যকথক হওয়া সম্ভব। এ গল্পে মানব সেই চরিত্র। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, শানানো, বিদ্যুৎস্ফূর্ত এই চরিত্র সাম্প্রতিক সময় আত্তীকরণের মাধ্যমে তার অভ্যন্তরস্থ গরলকে ঘৃণার ভাপ মিশিয়ে ফের উগরে দিয়েছে। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় আকন্ঠ গরল নিমজ্জিত থাকার পর নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাবার মুহূর্তে আপন প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত একজন মাথাঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠা শক্ত মেরুদন্ডের মানুষ হল মানব। সময়কে খুঁড়ে খুঁড়ে মানবের রঙিন অভিজ্ঞতায় যা উঠে এসেছে তা আমাদের সাম্প্রতিক সমাজের হালচাল। যেমন জনগণের প্রমোদকর ফাঁকি দেয়া, যৌন সংগমের উপর প্রমোদ কর বসানো। নারীমুক্তির লক্ষ্যে প্রমোদকরের তিরিশভাগ স্ত্রীলোকদের নিয়ে দেয়া, দেশের ভূমিহীনদের হিসেব বের করা, মধ্যবিত্তের উচ্চলম্ফের চারিত্র কড়চা এবং উল্টো পাল্টা হওয়ার প্রকোপ ইত্যাকার ব্যাপারগুলো তার গভীর দৃষ্টিতে পড়েছে। সমাজের ভেতরে অস্তিত্বমান অসংগতির প্রতি বিরক্তি, রোষ, বিবমিষা, ক্ষোভ, বিদ্রুপ, অবজ্ঞা সবকিছু মিলে মানবের মধ্যে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সময়টা বৈরী সময়, বড় দুঃসময়, নিষ্ফলা সময়, ক্ষমতা-লিপ্সু জিয়াউর রহমানেরা সিংহাসন পোক্ত করার জন্য পার্টিগুলো ভেঙ্গেচুরে নপুংসক করে দিয়েছে। রাজনৈতিক বিরাজমান অবস্থার প্রতি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ঘৃণা তুঙ্গে উঠে ফেটে পড়ে যখন তিনি দ্বিধাহীন উচ্চারণ করেন, "এই হাজার হাজার দলের লোকজন বেশ্যা মাগীদের মতো মাইফেল বসায় খোলা জায়গা পেলেই। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে পার্ক যেখানেই ফাঁকা পাওয়া যায়। সেখানেই হররোজ মাইফেল লেগে আছে যেমন কুকুর কুকুরী সঙ্গমের পরেও লেগে থাকে। রাজনীতিকরা সেই মাইফেলে মাই নাচানোর বদলে আঙ্গুল নাচায়, মহিলারা দুটোই।”

বিদ্রূপ অগ্নিতপ্ত শলাকা সদৃশ হয়ে ঘা মারে রকেট কোস্টারের ড্রাইভার চান্দুর পায়ুপথে আবর্জনা পরিষ্কার না হওয়ার বৈজ্ঞানিক বিধিসম্মত উপায়ে পায়ুপথ খোলাসা করার দৃশ্যে। চান্দুর বর্জ্য-পদার্থ দিয়ে কবিদের মূর্তি বানানো, জেলখানায় সমকামিতা ইত্যাকার দৃশ্যাবলী আমাদের হাস্য গন্থিকে বেশ জাকিয়ে সুড়সুড়ি দেয় এবং ঠা ঠা শব্দে আমাদের চপেটাঘাত করে। 

চোখ বিষয়ে

বাইবেলিক বিশেষ প্রক্রিয়ায় চশমা সৃষ্টির উপাখ্যান তৈরি করা হয়েছে বিশেষ চশমার সৃষ্টি পর্বে। সাধারণ এক কাঁচখন্ডকে আতসী কাঁচে রূপান্তরণ, তাকে তৃতীয় নয়ন হিসেবে আখ্যায়ন, আতসখন্ডকে বিভাজন এবং বাম ও দক্ষিণ নামাঙ্কে তৃতীয় নয়নকে মনোনয়ন এবং দ্বিমুখী তৃতীয় নয়নে পরস্পর- বিরুদ্ধ গুণাবলী দর্শন উৎসারণের কেন্দ্রত্ব দান সত্যিকার অর্থেই ধর্ম গ্রন্থ উদ্ধৃত পরিপূর্ণ ঈশ্বরীয়, ঈশ্বর- উদ্ভূত।

রূপগত ক্ষেত্রে গল্পটি অবশ্যই নেতি আঙ্গিক, প্রচলিত গল্পের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রীতিসিদ্ধ বৃত্তায়ন এখানে অনুপস্থিত। রিয়াজ বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি চশমার দিব্যপ্রভ দৃষ্টি রশ্মির অভিঘাতে জীবন ও সময়কে প্রত্যক্ষ করেছেন দশটি আলাদা ও প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ এপিসোডের মাধ্যমে: ১. বিশেষ চশমার সৃষ্টি পর্ব, ২. খেলার মাঠে ঘটনা, ৩ দেখা গেল: লোকটি খুন করতে যাচ্ছে ৪. চারিদিকে এখন নষ্ট জননকেন্দ্র ৫.উলঙ্গ দেহে খামচি -দাঁতের দাগ ৬. ঢাকা ঙনং…. বাসটি দুর্ঘটনায় পতিত হতে চলেছে ৭. চলন্ত কাডিলাকে তস্কর ৮. তিনি ১ জন ভূমিদাস ছিলেন ৯.চশমার খুঁটিনাটি পরীক্ষা এবং দু'দন্ড শান্তি ১০. স্বপ্ন: চেতন মুহূর্তে অজান্তে মনের গহনে ধারণকৃত ভাবনার উচ্চারিত প্রতিধ্বনি –এবং পরিশিষ্ট। উপরোক্ত শিরোনাম অন্তর্ভুক্ত এপিসোড গুলোর অন্তর্বয়ন ক্ষুদ্রায়তনী হলেও মৌলিক ও এর কেন্দ্রীয় গ্রন্থন অদৃশ্য সূত্রবৎ। প্রত্যেকটি এপিসোড প্যারাবোলিক আয়তনে মৌল ও ঋদ্ধ। তবে প্রতিটি উপাখ্যানের ঘটনাপঞ্জির কোনোটাই নায়কের জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য অংশ নয়। নায়ক শুধুমাত্র নির্লিপ্ত ও নিরাসক্ত দর্শকমাত্র। দিব্য শক্তিসম্পন্ন চশমার গভীর সঞ্চারী দৃষ্টির আতসে অনুপুংঙ্খ দৃশ্যমান হচ্ছে সামগ্রিকতা নিয়ে। এখানে চশমা পারসনিফাইড। চশমাই সমস্ত ঘটনার নেতি-ইতি প্রত্যক্ষ করার দায় গ্রহণ করেছে। সেদিক থেকে এ-গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো চশমা, কোনো ব্যক্তি নয়। দর্শন-প্রাখর্য আর তীব্র অণু-অনুভব নিয়ে চশমা উৎকট উল্লাসী। তবে চশমা টেনশন প্রসূত যন্ত্রণার উৎসারক। চশমার ডান আতস শুধুমাত্র জৈবিক ক্লেদাক্ততা, অশ্লীলতা, বিকৃতি তথা তমস গহ্বর আবিষ্কার ও ধারণ করে। যেমন, ৩ নং উপাখ্যানে চলচ্ছবির ভয়াবহ সন্ত্রাসী আবহ, ৪ নং-এ দুঃসহ বিকৃতি-ঋদ্ধি এ রকম:'শরীর বাঁকিয়ে তরল নিঃশেষ করার ১ টি ভঙ্গি নষ্ট ব্যাধিগ্রস্ত লিঙ্গ খসে পড়বে যেন, মূত্রপথে পুুঁজ- রক্ত। লোকটির বীভৎস রূপ দেখে শক্তি হৃত হতে থাকে–অনেকেরই পচা গলিত জননাঙ্গ শবের মত নিঃসাড়ে হিমাগারের ড্রয়ারে শায়িত, ৫ নং-এ বাস-ট্রাকের বিকট বিধ্বংসী সংঘর্ষ, ৭ নং-এ যুবতী অপহরণ, ১০ নং-এ সমুদ্র সমান বিকৃতি। মানব মনের অবচেতনে গুহায়িত রাহস্যিক কিস্তৃত যৌনতার উদ্ভাসন। শেষ পর্যন্ত গল্পটি সীমাহীন যৌনতার অপভারে ন্যুব্জ।

সন্তানগণ ও দুধভাত

ন্যূনতম কেন্দ্রীয় একটি সূত্র কেন্দ্রিক গল্পের শরীরে বহুমাত্রিক খন্ডাংশ যুক্ত করার প্রবণতা রিয়াজের রয়েছে। রিয়াজের গল্প সবিশেষ সূত্রবদ্ধ নয়, বলা যায় একমুখিন নয়। তাঁর ধারায় এসে সংযুক্ত হয় নবকলেবরীয় অংশ। সন্তানগণ ও দুধভাত-এর নির্মাণ কৌশলে বেশ কয়টি বিশ্লিষ্ট অংশের সংযোজন রয়েছে। এ-গল্পে উঁচিয়ে উঠেছে ইতিহাসের ইতিবৃত্ত, মন্বন্তর পীড়িত সময়, রাজনীতি, তথাকথিত দেশভাগ ও শূন্যতাজনিত সুযোগ-সন্ধান, অলিখিত দাসপ্রথা, মানসিক শূন্য, মেরুদণ্ডহীনতা ও যৌন-বিকৃতি।

সূচনায় জয়নুল আবেদীনের রুগ্ন জীবন্মৃত অথচ মৃত্যুউন্মুখ রেখাবলীর উচ্ছ্বাসে একজন ক্ষুৎকাতর ও অস্তিত্ব-নুব্জ জননীর শুধুমাত্র মরণতাড়ুয়া এক দোনা চালের বিনিময়ে উচ্চকিত হয়েছে গর্ভজাত সন্তান সমর্পণের এক নিষ্ঠুরতা আর বাস্তবতা। আর এক নিরেট বাস্তবতা নিকষ অন্ধকার রাত্রে আপাদমস্তক ক্ষুধার্ত ইদ্রিস আলী এক মুঠি চাল মুখ-গহ্বরে ঠেসে দিয়ে আর এক মুঠি চালের ক্ষুধাদ্রেককারী ঘ্রাণ নেবার চেষ্টায় ব্যর্থতা মুখভর্তি চালের গোঙানি।

গল্পে এক উল্লেখযোগ্য অংশ হলো পুকুর সংক্রান্ত কিংবদন্তী। কিংবদন্তীর ফলশ্রুতি সোনার দেশে আকাল এবং মন্দের উদ্বোধন। আকালের মধ্যে গৃহস্থের মেয়ের বিয়ের ঘটনা। এবং কনের সাথে ইদ্রিসের তিনটি মেয়েকে দাসী হিসেবে নিয়োগ, স্ত্রীর সাথে ইদ্রিসের সাময়িক বিচ্ছিন্নতা এবং পরে আকস্মিকভাবে প্রাপ্তিসংযোগ ইত্যাকার ঘটনাবলী –গড্ডল বহির্ভূত নবমাত্রিকী বলা চলে না। ইদ্রিসের মেয়ে মানুষটি তার নিখোঁজ হবার নেপথ্যিক যে কেচ্ছার বুনন করে তাও আটপৌরে। পরবর্তীতে জটিল গাণিতিক প্রক্রিয়ায় মেয়ে মানুষটির ঐশ্বরিক দিব্য অলঙ্কার শোভিত চরিত্র বনে যাবার উপাখ্যানটি নিরেট গতানুগতিক, এ-জাতীয় ঘটনা পুনরাবৃত্তিই বটে। সংযোজিত ঘটনার অভ্যন্তরে যদি নতুন ডাইমেনশন সৃষ্টির ক্ষমতা না থাকে স্রষ্টার তবে তা নিছক একটি ঘটনাই থেকে যায়, এখানেও ব্যাপারটি তাই। তবে একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার উল্লেখ করার মত। বিস্তরজন পূজিত পীর শিরোনামের মেয়ে মানুষটির পূর্ব পরিচিত শরীর নতুনভাবে ভোগ করার মধ্যে ইদ্রিসের এক অদম্য পৌরুষের গর্ব ও সিদ্ধি এবং সীমাহীন সুখপুঞ্জ আছে। ইদ্রিসের চেতনায় এ-বোধের উদ্ভাসন তার ভেতরে আর এক দৃপ্ততেজী ইদ্রিসের উদগাতা।

এরপরের ঘটনাপুঞ্জ গতানুগতিক ও সাধারণ। শেষের মানিক এপিসোডের ভেতরে মনস্তাত্ত্বিক নিরীক্ষণ বর্তমান। নৈঃসঙ্গজনিত বিচ্ছিন্নতা মানিকের ভেতরে এক অন্ধকার গহবরের জন্ম নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যৌনবিকৃতি, মস্তিষ্কের ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ। মানিকের বিয়েতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের মাধ্যমে যে বিষয়টি বেরিয়ে আসে তা প্রণিধানযোগ্য:'আসলে কোথায় যেন তখন ক্ষীনধারায়, যে স্তনে সন্তানের ওষ্ঠ-দাঁত অস্পর্শক, তা থেকে দুগ্ধ গড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে টুপটুপ টুপটুপ। মানিক কান সচেতন করে এবং সিক্ত হয় ক্রমান্বয়ে।” যে স্তনে সন্তানের ওষ্ঠ-দাঁত অস্পর্শক অর্থাৎ সন্তান স্পর্শশূন্য; মনে করা যায় মেয়ে মানুষটি সন্তানহীনা। এ-রকম মেয়ে মানুষের স্তন-পুষ্পে কখনই দুগ্ধস্রোত তৈরি হতে পারে না। গল্পকার এখানে চমৎকার শিল্পীত বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছেন। এখানে সন্তানহীনা স্ত্রীলোকের স্তন থেকেই বিধিসম্মতহীনভাবে দুধের স্রোতধারা প্রবহমান।দুগ্ধ গড়িয়ে পড়া যদি প্রতীকী অর্থে ভালোবাসার অন্য নাম হয়, তাহলে মানিকের জন্য এক গোপন ভালবাসার প্রবহমানতা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তবে মানিকের সিক্ত হবার ব্যাপারটি অনুভবভেদ্য বটে কিন্তু কান সচকিত হবার ব্যাপারটি বোধগম্য নয়।

অবনত ধারাপাত

গল্পটি আয়ত-সংহত হলেও আখ্যান বড় দুর্বল ও শ্লথ। মধ্যবিত্ত পরিবারের আশা-নিরাশার দ্বান্দ্বিক রূপের শতচ্ছিন্নতার মধ্যে আপন নির্মোক ভেঙে  বেরিয়ে আসার জন্য সংস্কারবদ্ধ একজন মহিলা অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের কাছে তড়িৎগতিতে সমাধান প্রত্যাশায় সর্বস্ব বিকিয়ে সর্বসান্ত। আমাদের সমাজের এটাই সাধারণ চিত্র। বিবাহিত বেকার সন্তানের আন্তর-হতাশাও স্বাভাবিক। এখানে কোনো চমক ও সৃষ্টিযোগ্যতা নেই, এমনকি মাত্রাসংযোগ ক্ষমতাও নেই। এ-গল্পের একটি মাত্র সম্পদ হলো পরিণত ও বিন্যাসমন্ত, সুভগ ও নিশ্ছিদ্র ভাষাশৈলী। 

বস্ত্রহীন প্রতিবি‍ম্ব

ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপের উত্তপ্ত হলকা এবং এর সাথে অস্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক অভিযোজনা এ গল্পের উল্লেখযোগ্য উপাদান। রাজা আসার পূর্বে দরবারে অবস্থানরত মন্ত্রীবর্গের শ্লথ স্বেচ্ছাচারী আচরণ রাজার ক্ষমতা, দক্ষতা, ব্যক্তিত্বের মাত্রাগত প্রমাণ দেয়। রাজার ব্যক্তিত্বকে হীনমূর্ত করার অভিপ্রায়ে অনুচ্চারণপ্রভ কিছু ব্যক্তিগত অভ্যন্তরীণ প্রসঙ্গকে প্রাধান্য দেয়া হয়। রাজধর্মের চেয়ে একজন রাজা বাথরুম প্রাজ্ঞ হলে তার মৌলসত্তার মৃত্যুভিন্ন অন্য পথ খোলা থাকে না। তার অনুচর, অমাত্যবর্গও তেমনি লেজ দোলানোর শ্রেষ্ঠ প্রতীক প্রতিনিধি হয়ে যায়। তাই তো রাজার সুগন্ধী তাম্বুলের স্বাদ ও গন্ধে উদগ্র নেশাগ্রস্ত মন্ত্রীরাও ছন্দসিক্ত মস্তিষ্ক-বিহ্বলিত। যার ফলশ্রুতিতে রাজার তাম্বুলশূন্য অবস্থাতেও চামচা শূদ্রকের দলের নেশা থাকে তুঙ্গে। রাজা হঠকারীও বটে। অদ্ভুত দেশ কিম্ভুতকিমাকার রাজা আর উদ্ভট প্রশাসন।

হ্যান্স এ্যাণ্ডারসনের কাহিনী এ গল্পের উৎস হলেও গল্পকার কিম্ভুতকিমাকার আখ্যানটির অবয়বে বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম ঘটনার পুনঃসংযোগ করেছেন। অপুত্রক স্বৈরশাসক স্বেচ্ছাচারিতার শীর্ষশিখর স্পর্শ করলে দেশ-জনতা তথা বিশ্ববিবেকের সামনে কোন অলক্ষ্যে দিগম্বর হয়ে যায় তা সেও ঠাত্তর করতে পারে না।

তবে রতন পাগলার উপাখ্যানটি ভেবে দেখা যায়। রতন নিছক পাগল নয়, তবে তার পাগলামি সত্য। পাগলের মোড়কে সত্য প্রোজ্জ্বলক সে। 'সৃষ্টির পর মানুষের মুখোমুখি, আদি স্বৈরশাসক হলেন ঈশ্বর। আর সেই ঈশ্বরের কথা প্রথম অবজ্ঞা করার সাহস দেখিয়েছিল শয়তান –প্রথম গণতন্ত্রী। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তজ্ঞাপক ডায়ালগ উচ্চারণ কোনো পাগলের পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো দুঃসাহসী শিক্ষিত সমাজ-সংস্কারকের পক্ষেও এ জাতীয় কথা সব পরিস্থিতিতে বলা সম্ভব নয়। বর্তমান সময়ে এ জাতীয় শাস্ত্র-অবনমন উচ্চারণ রীতিমত বিপ্লবাত্মক। এ সব কুফরীয় পাপোক্তি গ্রামে-গঞ্জে কল্পনারও বাইরে। জনপ্রিয় তো দূরের কথা, ঘোরতর পাগলের পক্ষেও অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকা অনন্তর ব্যাপার। 
গল্পের বুনোন কাঠামো ন্যূন-বাস্তব হলেও 'হাওয়াই বস্ত্র' প্রদর্শনীতে রতনের বিবস্ত্র হবার পর তার যৌনাঙ্গ প্রদর্শিত না হওয়া এবং পাশাপাশি ছোট বাচ্চা কর্তৃক রাজার শিল্প দর্শনের ব্যাপারটা বিসদৃশ্য বটে। এবং যুক্তিত্রাতা হিসেবে রতনের হাতে মুক্তির অমল সংগীত বেজে ওঠা অনেকটা অস্বাভাবিকও বটে।

রোম পুড়ে যাওয়া ও সম্রাট নীরোর বাঁশি বাজানোর সাথে হঠকারী রাজার গ্রাম পোড়ানো ও বাঁশি বাজানোর ছিটগ্রস্ততার এক চমৎকার সংশ্লেষণ ঘটেছে। ইতিহাসের এজাতীয় ঘটনা পরবর্তীকালের অনেক স্বেচ্ছাচারী মেধাবিবিক্ত রাজাকে উন্নাসিক করে নেয়। এদৃশ্য কল্পনায় রিয়াজের নান্দনিক শুশ্রুষা আছে।

দাত নাই শিং নখ নাই

এ গল্পে নবমাত্রিক কলেবর চিহ্নায়ন প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। চেতনা ও আঙ্গিকে অনন্য পূর্ব আদল প্রজননে রিয়াজ স্বতঃপ্রবৃত্ত। তাঁর ভাব-ভাষা-বিন্যাস, আখ্যান - প্রেক্ষণে কুমার এসে যান, কখনো আসে দেবেশ রায়ের ডিটেলিং, কখনো সুবিমলের ছায়া অনেকাংশে, কখনো আপন সৃষ্ট আপাত দুরূহ বিন্যাসগত বিকর্ষণের প্রক্ষেপণ।

কবিতার পংক্তির আদলে সজ্জিত এ-গল্পের অবয়ব। মাঝে মধ্যে প্রক্ষিপ্ত কবিতার আদিখ্যেতাও প্রকট। গল্পে কবিতাদোষ বা কবিতা-আক্রান্ত পণ্ডিত-প্রবরদের দৃষ্টিশূল হলেও রিয়াজ সে পর্যায়ে দোষদুষ্ট নন। গল্পের বাক্যবিন্যাস আঁটসাঁট মেদহীন রমণীর স্লিম দেহের মত, তরতর গতিমান, কৌণিক পরিমাণে স্থাপিত প্রতিটি শব্দের বাচ্যার্থ বা প্রতীকার্থ তড়িৎ-স্ফুরিত, গড়িয়ে গড়িয়ে চলে, কোথাও দাঁড়ায় না, কোনো শব্দেরই স্থবিরত্ব দোষ দুর্নিরীক্ষ্য। এভাবেই গল্পের ভীতি-বিহ্বলতার আচ্ছন্নতা। একটা অমূলক ভিত্তিহীন কিম্ভুতকিমাকার জন্তুর অদৃশ্য ও আকস্মিক আক্রমণের রাহস্যিক প্রেক্ষাপট এভাবেই দৃশ্যমান প্রথম দুটো স্তবকে সময় ও পরিপার্শ্বের মুখর -উত্তাপ, সাম্প্রতিকতার উৎকেন্দ্রিক উল্লাস। এখানে সময়ের অভ্যন্তরস্থ দ্যুতিমান দ্বান্দ্বিকতার বিকলন। সান্ধ্যকালীন আজান ও মন্দিরের শঙ্খ-ঘন্টাধ্বনির শ্রাদ্ধ সেরে কিছু তরুণের দল গোগ্রাসে গিলে চলে প্রবৃত্তি-উত্তেজক উন্মত্ত নীলছবি। কোনো ছেদ পড়ে না। উল্টোদিকে ভীতিগ্রস্ত বাইরের চালচিত্র। অন্ধকার গুমোট বাঁধবার পূর্বেই সম্ভাব্য সন্ত্রাসের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য ছোট্ট রাস্তার মোড়ের মুদির দোকানদার দোকানবদ্ধ করে বাড়ি বাড়ি করছে। সারা শহরে বিরাণময় অবস্থা, ম্রিয়মাণ আলো, এই নিরঙ্কুশ শাহরিক শূন্যতার মধ্যে তিনজন মসজিদগামী নামাজীর সংশ্লিষ্টি বিকট শূন্যতাকে আরও সপ্রাণ মুখর করে তুলেছে। পরিস্থিতিকে গভীরত্ব দান করতে গল্পকারের নৈঃসঙ্গ সূচক একটি বাক্য ব্যবহার সুদূর সঞ্চারী: ----গোড়ালির  উপর তাদের পরিহিত লুঙ্গি/হাতে তসবীহ বা শূন্যতা----।' দুটো অৰ্থ এখানে প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়, হাতে তসবীহ অর্থাৎ তসবীহসহ কেউ একজন আর কেউ হয়ত বা শূন্য হাতে। এই যদি হয় নির্গলিতার্থ তাহলে বাক্যাংশটি উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই তা নিঃশেষিত হয়ে যায়। কিন্তু তা কেনো যেন মেনে নেয়া হয় না। শূন্য শব্দের অর্থ যদি খালিই হয়ে থাকে তাহলে এখানে শূন্যতা ব্যবহার না করে শুধু শূন্য শব্দই ব্যবহার করতে হত, যদিও শূন্য ও শূন্যতা উভয়ই বিশেষ্য। কিন্তু শূন্যতা শব্দ ব্যবহার করার সাথে সাথে শব্দটি যে তসবীহ শব্দেরই প্রতিরূপ তাই-ই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তসবীহর সমান্তরালে শূন্যতা শব্দের অর্থগত সমমর্যাদা দান শূন্যতাকে আলাদা মর্যাদা দান করে।

খুন বা হত্যাকান্ড বাংলাদেশে স্বাভাবিক ঘটনা। বৃহৎশক্তির অস্ত্র ব্যবসার জমজমাট ভেনু তো তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশগুলো। নতুন অস্ত্র প্রয়োগ ও পরীক্ষার জন্য তৃতীয় বিশ্বের মানুষগুলোর শরীর-মজ্জার মত পরম আস্বাদ্য জিনিস আর নেই। যে কিম্ভুতকিমাকার জন্তু সন্ত্রাসের উদগাতা তার যেমন কোনো দাঁত নাই শিং নাই নখ নাই, অর্থাৎ অবয়বহীন প্রায় অদৃশ্য তেমনি বৃহৎশক্তি উৎপন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস অবয়বহীন অথচ রন্ধ্রহীন অক্টোপাশী।

আগুনের বিপদ আপদ

গ্রাম্য সংস্কার এই গল্পের মৌল উপাদান। এই সংস্কার আমৃত্যু লালন করেছে জবেদালীর দাদী। তার প্রোথিত বিশ্বাস ছিল যে মানুষের শরীর মাটি দিয়ে তৈরি এবং সে মাটিকে আগুনে পোড়ালে একটা সর্বনাশা অভিশাপের আগুন তাকেই দগ্ধ করে, নিঃশেষ করে। জবেদালী নতুন ইটের ভাটায় প্রথম মুখাগ্নি করে এবং এইটিই তার প্রধান জীবিকা। সংস্কারজনিত কারণে সে তল্লাটে জবেদালী ছাড়া এ কাজ অন্য কেউ করে না। তার দাদী ও স্ত্রীর বিশ্বাস ইটের ভাটায় আগুন জ্বালানোর অভিশাপে সে নিঃসন্তান। এই সংস্কারটির নেপথ্যে মুখ্য কয়েকটি কারণ বিবেচনা করা যায় :মানুষ মাটি দিয়ে তৈরি এটা ধর্মীয় বিশ্বাস। সেই মাটিকে পোড়ানোর অর্থ হল মৃত্তিকা –অবমাননা। প্রকারান্তরে মানুষকে অবমাননা এবং ধর্মশাস্ত্রের অস্বীকৃতি। মৃত্যুর পর মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল নিকষ মাটির অন্তর এবং সেখানেই অনন্তকাল অবস্থিতি। পার্থিব স্বার্থে সেই মাটি পোড়ালে সময় মত সে মানুষের হাড়-হাড্ডি মনি -মগজ পিষে পিষে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে।

বিষয়টি জবেদালী, একজন নিরক্ষর গ্রাম্য খেটে খাওয়া মানুষ,--কে পীড়িত করে। ভেতরে নিয়ত ও নিরন্ত দ্বান্দ্বিক যন্ত্রণা জ্বালিয়ে মারে। কিন্তু জীবিকার একটা নিশ্চিত অর্থ যোগান-সংস্থানকে কিছুতেই হাত ছাড়া করতে সে রাজি নয়। সে প্রশ্নকাতর হয়ে ওঠে। ডাক্তারের কাছে অদ্ভুত প্রশ্নের কোনো জবাব না পেয়ে নিজেই নিজের পক্ষে একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা খাড়া করে এবং আত্মপক্ষ সমর্থন করে। জীবিকার বাস্তবতা জবেদালীকে একজন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যাখ্যাতা করে তোলে এবং সে নেতি– সংস্কারমন্ত হয়ে ওঠে: 'মাটি দিয়েই যদি নির্মিত হয়ে থাকে, তবে মানুষের দেহের মত কোথাও মাটিতে দাগ কাটলে তো রক্তধারা অনুপস্থিত।।' গোটা ব্যাপারটি তার কাছে রাহস্যিক এবং অসমর্থনযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়। তাই তার মূল সঞ্চারী অভীক্ষার আবিশ্ব সন্দেহের বিবরব্যাদান: "তবে কি কোথাও বড় ধরনের মিথ্যা কথা বিদ্যমান ?' প্রশ্নটির অভিঘাত সর্বলোকে সন্তরণশীল।

আগুনের অন্তর্গূঢ় ক্রমবর্ধিষ্ণু শক্তির টান জবেদালীর কাছে অনতিক্রম্য। তাই জবেদালীর ভেতরে কুহকী বাস্তবতায় দুর্মর এক স্বপ্নচ্ছবি তৈরি হয়। যে স্বপ্নের মৃত্তিকা, স্বপ্নের নদী-ঝর্ণা, স্বপ্নের সুখ, স্বপ্নের আকাশ--সব মানুষের, জীবনের, বিস্তীর্ণ বিকশিত জীবনের। এই স্বপ্ন-কল্পনায় জবেদালী এক নতুন পৃথিবীর স্রষ্টা, যে পৃথিবীর ভিত্তিস্থাপন হচ্ছে অসংখ্য সুদৃশ্য ইষ্টকপুঞ্জে, যে ইটকে ইটে রূপান্তরণের জন্য জবেদালীই প্রথম অগ্নি সংযোগ করেছে। ভেতরে ভেতরে এক ভিন্নতর জবেদালীর পুনর্জন্ম হয়। সৃষ্টিশীল আবেগের উত্যুঙ্গ প্রসারণে সে নিজেকে মহান স্রষ্টা হিসেবে আবিষ্কার করার গৌরব বোধ করে। এ এক অসাধারণ অনুভব। শিল্পী জবেদালীর জীবন লাভ। এই অতীন্দ্রিয় অতিজাগতিক উপলব্ধি পর্যন্ত গল্পটি অসাধারণ। শেষাংশে পিতৃত্বে সন্দেহ পোষণ জবেদালীকে শিল্পীর মহত্ত্বের তুরীয় দশা থেকে অবনমিত করে ফেলে।

রিয়াজ দুরূহ ও দ্বান্দ্বিক পথে অগ্রসর হচ্ছেন। নিয়ত নিষ্ঠাই যে পথের একমাত্র মন্ত্র। নিঃশ্বাস আর রক্তের সাথে মন্ত্রের অদ্বয় মিশ্রণ হলেই শিল্পের হিরন্ময় বিকাশ সম্ভব। বর্তমানে যে সর্পিল পথে, দুর্গম পার্বত্য- কন্দরে তিনি চলাচলে অভ্যাসরত, তাতে ত্যাগীপুরুষের সাহসিকতায় সর্বস্ব মোহ ত্যাগের পণ করতে পারলেই সিদ্ধি সম্ভব। দীর্ঘ পথ পরিক্রমার প্রারম্ভিক পর্বে তাঁর নন্দিত ও শঙ্কিত শস্যগুচ্ছ এখনো উজ্জ্বল স্বীকৃতি পায়নি বটে, তবে বিদগ্ধজনের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে, একথা নিঃসংশয়।

দ্রষ্টব্য, ১৯৯৪

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: জীবন রসায়ন ও তাঁর শঙ্কিত শস্য সকল
শোয়েব শাহরিয়ার 

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : শোয়েব শাহরিয়ার
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : শোয়েব শাহরিয়ার
► শোয়েব শাহরিয়ার
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s16000/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s72-c/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/11/Shoaib-Shahriars-article-on-Syed-Riazur-Rashid.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/11/Shoaib-Shahriars-article-on-Syed-Riazur-Rashid.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy