.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

শাদা কাহিনী │ছোটগল্প│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ

গল্পটা শুরু করা যাক।
 
এক যে ছিলো দেশ... রাজা…. রানী…. হঠাৎ হ'ল কি........... দেখা 
গেলো আকাল….
না,এভাবে নয়—-

গল্পটা ঘটতে পারে এই রকম যে, 
অর্থাৎ চুনাতিপাড়ার দুঃখের কথা কেউ তো বলে না; 
কেউ তো জানে না-

পান হ'তে চুন খ’সলে কী কী হতে পারে ;কতভাবে হতে পারে— কত রকম হ'তে পারে–- ঠিকঠাক জানাজানি থাকলেও, চুনেরও যে রয়েছে আরো কত ব্যবহার— হরেক প্রকার, তা চুনাতিপাড়ার লোকেরা ওয়াকেবহাল নয় মোটেই। চুনাতিপাড়ার লোকেরা আর কিছুতেই মোটের উপর যাকে বলে অজ্ঞান এবং তারা এমনই যে কোন ক্রাইসিস নাই; হ'তে পারে না কোন গল্প! 

অথচ চুনাতিপাড়ার দুঃখের কথা কেউ তো বলে না; কেউ তো জানে না-

ঝিনুক হ'তে চুন হয়...... আর হ্যাঁ তাই একদা এই রকমই ছিলো বলেই তো যে, নদীটার জাহাবাজ স্রোত..... এবং ঝিনুক এসে জমতো এই করতোয়া নদীর কূলব্যাপী সেজন্য তার পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠে চুনাতিপাড়া; এখানে গাদা খানিক লোক বসবাস করতো, কুড়িয়ে আনতো ঝিনুক অজস্র — বানাতো চুন মহাসুখে। পান- চুনে রঙীন করে মুখ নারী-পুরুষ হাসি-তামাশায় মাতে বইকি! 
এখন করতোয়া আর ঝিনুক পাঠায় না।

অথচ চুনাতিপাড়ার দুঃখের কথা কেউ তো বলে না; কেউ তো জানে না—

করতোয়ার শরীর ছিলো বিপুল, মেজাজ সমুদ্রের। বর্ষাকালে এমনই খোলতাই যে— বৃষ্টি কারণ, মেঘ ছিড়ে বৃষ্টি নামাতো অহরহ।

বর্ষায় নদীর তিরিক্ষি চেহারা দেখে পাকা মাঝিও পানিতে নৌকা ভাসাতে ১০০ বার বিসমিল্লাহ আওড়াতো, এতো ছিলো হররোজ ঘটনা; নারীরা, যতক্ষণ পর্যন্ত পুরুষেরা তাদের নদী হ'তে না ফিরে করে রাখতো মেঘের মতো কালো চেহারা ছবি। এই নদী অজস্র নারীর চোখ ফাঁটিয়ে বৃষ্টি নামিয়েছে অবলীলায়, তবে চোখের পানিতে নোনতা হয় নাই নদী।

উশুল হয়েছে যেন অন্যভাবে— নদীটা কীভাবে কীভাবে যেন শুকিয়ে ভূত, আগের নদীটার প্রেতাত্মা ঠিক। ঢিম খেয়ে গেছে নদী। গজব যেন, এক দৈত্য চোঁ চোঁ করে নদীটার পেট ভরা পানি দিলে সাবাড় করে ফেলেছে;নদীটার এখন হাড়গোড় বের হওয়া দশা—

যে ছিলো ঢোঁড়াসাপের মতন, কেঁচোর গড়ন এখন সেখানে। সব যেন মিথ্যার কারুকাজ!

দীর্ঘশ্বাস বলে শুধু যে নদীটা পেছে।

অথচ চুনাতিপাড়ার দুঃখের কথা কেউ তো বলে না;
কেউ তো জানে না-

নদীটার আজ চলেছে বৃদ্ধাকাল; যারা একদা দেখেছিল যৌবনা এই নদী — বেঁচে নাই; ফলে সাক্ষী নাই। অথচ বাঁচলে বলতো নদীর রূপকথা: জ্যোৎস্না রাতে সিন্দুক খুলে নদী বের করতো রূপা-চান্দির কারুকাজ খচিত গহনা......... মনোরম করে নগ্ন শরীর সাজাতো ঝিলমিলে রূপটানে; নদীর নগ্ন ভুলভুলানি রূপসী জালে মজে যেত সবাই-ই—নদী তখন, সুন্দরী নারীটারও প্রতিদ্বন্দ্বী সতীন যেন।

নদী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে সুন্দরীর পর সুন্দরী; ডুবিয়ে মরতে সুযোগ বাৎলেছে গলায় কলসী বাঁধা নারীকে কতবার।

আসলে নদীটার যৌনতা ছিলো
প্রবলতর........... যখন সে কামুক — প্রবল উত্তাপে কাঁপতে কাঁপতে দু'পাশের পাড় শুধু পাড় ভেঙে নিতো, গিলে ফেলতো বসতি। 

এইভাবেই ভাঙাভাঙি বারবার, আর এইতো সৃজন আরেক। সৃজনের উৎসই এমত যৌনতা কেবল।

এই যৌনতা সেই যৌনতা নদী হারিয়ে মনমরা; কাঁদে না, ভুলে গেছে; পাড় ভাঙে না, পারে না; নদীর নিতম্ব উপচানো পানির ছলাৎ ছলাৎ গুম হয়ে গেছে কলকলানি ;রং- ঢং- ছেনালিপনা-মদির ভাবসাব গেছে, সব গেছে.....! 
নদীর চলছে এখন রজঃনিবৃত্তি ।
এবং ঝিনুক নিবৃত্তি......। 
নদীর যৌনতা নাই, এখন সে-ই ঝিনুক জন্ম— হায়! 
অথচ চুনাতিপাড়ার দুঃখের কথা কেউ তো বলে না;
কেউ তো জানে না-

নদীর যৌনতা— উদ্দামতা; বর্ষায় ভরভরন্ত আদল আর খরায় ছিপছিপে— সব মিলিয়ে খুবসুরৎ সে; নারীর মতো নদীর ভাঁজময় খাঁজ কাঁটা কামুক শরীর; এই নিয়ে আর কোন কাব্য হবে না। কাব্য রচনার জন্য কোন কবি যেমন হয়ে উঠবে না আর তেমন উদ্বেলিত, প্রাচীন মানুষেরাও উধাও বলেই আর কোন স্মৃতি নাই অবশিষ্ট, যে... মোঘলদের বাঈজী যৌবন নিয়ে পালিয়ে এসে ঢেকে রাখে নদীর যৌবনের আবডালে– নদীরই তীরে, কাছাকাছি চূনাতিপাড়ার। নদীর সঙ্গে যুগলবন্দী হয়ে রাত জুড়ে পায়ের ঘুঙুর বেজে বেজে ক্লান্ত হোত— একদা এই যা ছিলো বাজনা — সত্যি এখনও কেউ বিভ্রমে ঝনাৎ ঝনাৎ ধিন তা ধিন কানে শুনলেও যেন এমনই দূরময় মখমল মাত্র একখন্ড।

নূপুরের তো হয় নিক্কণ কেবল এবং সঙ্গে ঐ নদীর যৌবন গল্প বলার আজ কেউ নাই। 

অথচ চুনাতিপাড়ার দুঃখের কথা কেউ তো বলে না; 
কেউ তো জানে না—

গ্রামের ভেতর আবুইল্যার দোকানটা ঠিক রাজধানীর মতো!

পেছনে যে গাছটা: কতবার যে ভোল পাল্টায় বছরের একেক সময় একেক রকম মাথাকাল্লা নাই, আর ডাইনী এলে তো একবার না হ'ক চড়ে বসে ক্যানক্যানে গলায় গান মক্‌শ করবে নিশ্চয়ই — উপরন্তু জ্বীন-পরীধরা কত পাগলা-ছাগলা মাত্রই ডালে উঠে বসে থাকে -শুয়ে থাকে- ঝুলে থাকে। তো, ঐ নিচেই আবুইল্যার দোকানপাট।

আবুইল্যা এখানেই থাকে কেবল রাতে ঘুম ছাড়া, সবসময়। আবুইল্যার লোটাও আছে একখানা— বাহ্যকর্ম করতে হয় তো, যা কিনা সেরে আসতে হয় পেছনে গিয়ে তাকে; মজার কথা নয় কি যে, কাজ শেষ করার পর দেখা যায় প্রায় ঠোঁট মুছে ফেলতে, আর সে ক্ষেত্রে লোটা পানির ভূমিকা প্রশ্ন সম্মুখীন হবেই। তবে কথা আছে:যদি হয় কষা আর কঠোর কর্ম মোকাবেলা, তখন জোর খাটাতে কি ঘামের ছড়াছড়ি নিষিদ্ধ!

হ্যাঁ সে যাক, আবুইল্যা এই নিয়ে বিতর্ক বলা হোক আর কবির লড়াই: জ্বীন-পরী গু খায়।

আরো আছে, গাছের নিচে বসবাসের ফলে গাছটি সম্পর্কিত বেশ চমকপ্রদ জ্ঞান লাভ
করতে পেরেছে আবুইল্যা। 
সে গাছের রূপ খুব হদ্দ হয়ে দেখে যায়। তখন বের হয়ে পড়ে দোকান হতে হাট্
করে খোলা ফেলা রেখে, ঝিম মেরে বসে থাকে মুখোমুখি।

কবিতা আওড়ায় আবুইল্যা আর পড়ে যায় মহাফাঁপড়ে— গাছ/তুমি সবুজ / আমি
অবুঝ / কাছে আসো / ভালোবাসো, কিন্তু গাছের কি পা আছে!কি জ্বালা!
এই গাছটি হচ্ছে জ্বীন-পরীর আস্তানা!
আসলে ভাব বলে জিনিসটা ভালো হ'লেও ভাব নিয়ে ভাবনাটা মোটেও না।

আবুইল্যা কবিতা বানাতে তৎপর হ'লেই এ রকম কোন হিজিবিজি তখন আবার মগজে বুদবুদ করে ওঠে—

গাছ তুমি জ্বীন-পরীর আস্তানা/আমি তোমার প্রেমে মাস্তানা।

কবিতা মানেই যেন আবুইল্যার কাছে এক লাইনের শেষ শব্দের সঙ্গে পরের লাইনের শেষ শব্দে মিল লাগানো আর খাপে খাপে লাগাতে পারলে আসলেই এক লাগানোর মজা পাওয়া যায়–

আবুইল্যার কল্পনার পাখি ফুরুৎ করে অন্য দিকে চলে গিয়ে সেধায়।

আবুইল্যা কবিতা লেখে হিসাব করার খাতাতেও আকছার; কবিতা আওড়ায় বাইরে আর লেখে বসে বসে দোকানের মধ্যে—সূর্য ডুবে অন্ধকার ঘনালে মন মেতে উঠবেই, রাত মানেই যেন কবিতার উথাল পাথাল; খুব ভালো লাগে রাত:ভেতরে কুপির আলো দোকানে, বাইরে উপুড় করা জ্যোৎস্না, সামনে মাটির ওপর আলো আঁধারির নকশা; সে মুগ্ধ——চাঙ্গে উঠে যায় দোকানপাট, মুখ হা; কবিতা মগজে জড়ো হয়ে বুড়বুড়ি কাটে।

আবুইল্যা পড়াপড়ি আর লেখালেখি পারে; থ্রি-ফোর পর্যন্ত প্রাইমারী স্কুলে পাশ –শুধু কি তাই একবার তো বাপ কেমনে কেমনে এইট পাশ ঘোষণা দেওয়া একটা সার্টিফিকেট চাকুরী করার জন্য—তার জন্যই বিড়াল স্কুলের হেডমাস্টারের কাছ থেকে বাগিয়ে এনেছিল। এতে হ'ল কি সে এক অকাট এই সার্টিফিকেট পেয়ে রীতিমত হতবাক—হেডমাস্টার মূর্খকেও লম্বা সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে দেয়! শুরু হয় লেখাপড়া নিয়ে বেজায় দ্বন্দ্ব।

এবং কবি হওয়াকেই ভালো মনে করে— সেই শুরু তো চলছে।


চৈত্র মাস এলে গাছটা যখন পাতা খুইয়ে একেবারে উদোম আর এই দেখে মনটা খারাপ করা বাতাস ওঠে— সব কবিতা উল্টে পাল্টে এই গাছ নিয়েই যে, কবিতা যা আসে সবই মন খারাপের।

গাছের রূপ বদলের সঙ্গে কবিতার আগাপাশতলা এধার ওধার হবেই। বৈশাখে যখন ঝড়ো অবস্থা, গাছের পাতায় পাতায় শনশন, কবিতার সঙ্গে সুরের দেখা মিলে।

এই হচ্ছে রকমারী আবুইল্যা, আকিকা করা নাম: আবুল বাদশাহ্ যার বাদশাহী তো পুরোটাই। শুধু বিপদ, মন্দ লোকেরা বলে: এই পাগলটা গাছে চড়ে না ক্যান! 
কিছু যায় আসে না— থোড়াই কেয়ার!

আবুইল্যার দোকানটা হচ্ছে খুটা পেতে বসানো, একেকটা বাঁশ হাঁটুতে কেটে জোড়া দিয়ে কষে বাঁধার পর মাটিতে পোতা-- আর, জোড়া জোড়া বাঁশের মাথায় বসে চৌকি বিছিয়ে দোকানটা সটান; তা এটা কি রকম দোকান? ধুৎ! সে বুঝুকগে আবুইল্যা!

আবুইল্যা তো কবি, দোকানটাও শুরু করেছিল বেশ একখানা ভাবসাব নিয়ে অন্য রকম সকম করে— কিন্তু এখানে লোকগুলো না হ'ক বিটকেলে, পাত্তা মিললো না; মুড়ি ছাড়া বেচা হয় না সব। অথচ কি ইচ্ছা ছিলো আর ঘটছে কি সব! দোকানে বয়ামগুলো এখন সব মুড়ি ভর্তি রাখা— কেক-বিস্কুট-লজেন্স থাকবার কথা ছিলো, চললো না; মুড়ি ছাড়া যেন কোন খাবার নাই, সবাই চায় আর খায় মুড়ি, মুড়ি এক টাকার –এক টাকার। মুড়ি বেচার জন্য বয়ামের সংখ্যা বাড়াবার দরকার ছিলো না, বস্তায়ই বেশি আঁটে; শালারা চোদায় মুড়ি খায়— এই খারাপ কথা আবুইল্যার কবি প্রাণও হুম করে বলে ওঠে।

পানি চাপিয়ে আবুইল্যা কেতলিতে করে চা বানিয়ে বেচে, সিগ্রেট বিক্রি করে দোকানে— বেশি চলে নেভী আর দামীটা বলতে গোল্ডলিফ — অন্য খাওয়ার পাবলিক জোটে না; দোকানে আর একটা জিনিস বিক্রি বাট্টা করায় মার নাই—তার দোকানে কনডোমের বেচাবেচি একটা বিশিষ্ট অংশ জুড়ে আছে বলে কবিতার পরেই স্মরণ করে সে; দেদারসে চলে কনডোম — বয়ামে ভ'রে রাশি রাশি কনডোম ইদানিং সাজিয়ে রাখছে, বেশ অর্থকরী তো তাই আগে দড়িতে লটকে ঝুলিয়ে রাখতো এখন রাখে না!
 
সে ধুয়ে বেচে বটে কনডোম —পোলাপানরা মুখে নিয়ে ফুলিয়ে বেলুন বানিয়ে খেলছে হরদম, বাচ্চাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে আবুইল্যার দোকানের কনডোম -- সরাসরি মাল আসা শুরু করেছে খোদ কোম্পানী থেকে –পানি দিয়ে ধুয়ে নেয় বলেই আঠা আঠা ভাব চলে যেতেই বেলুন না ভেবে পারা যায় না বইকি!
খুব চলছে এইটা, প্রথমে সূত্রপাত এইভাবে—
এক ছোড়া, একটু আগে কেনার পর ফিরে এসে বলে:চাচা বেলুনে আঠা খুব, একটু ধুয়ে দেন।

আবুইল্যা আকাশ পাতাল ভাবনা শেষে পান ভেজানোর বালতির পানি দিয়েই কচলে নিয়ে উদ্বুদ্ধ করে: দে ফু দে!— সেই শুরু আর থামাথামি নাই বরং রমরমা; কোম্পানীর লোকদেরও খবর হয়ে গেছে, পুরস্কার পেলো পাঁচ হাজার টাকা একবার আবুইল্যা!

দোকানে আবুইল্যার যে একখানা রেডিও আছে, যাকে বলে ট্রানজিস্টার, চার ব্যাটারীর জোরে ঘরঘর করে রাজ্যের খবর কানের কাছে শোনায়— গান গাওয়া হয়: ও সোনা বন্ধুরে..... তো, ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর অনুষ্ঠানের সময় চোখ-কান-মুখ লাল ব'নে গেলেও আওয়াজ হালকা করে মন দিয়ে শুনতে ভালো লাগলেও প্রাণের অনুষ্ঠান অবশ্য সৈনিক ভাইদেরটাই— গলা কাঁপিয়ে ঘোষণা দিয়ে ফাটাফাটি কি সব গান, তখন আওয়াজ জোরসে করে দিয়ে রেডিও বাজানোর সত্যিই সুখ!

তবে হ্যাঁ, রেডিওতে সব খবর কুলায় না– এ ব্যাপারে তার জ্ঞান মোক্ষম; এই যে দুলু মাস্টার আছে না— সেবার সে ঘরের ভেতর বউ রেখেই কাজের মেয়ের সঙ্গে বাড়তি কাজ করতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেলো, তো ঐ মেয়ে মানুষ ঠুকে দিয়ে এলো নালিশ চেয়ারম্যান সাহেবের ধারে…. সারা শহর হৈ হৈ, হ'লো কি, ঐ খবর রেডিও ছড়াতে না পারলেও দোকানের সামনেই পেতে রাখা বেঞ্চের সঙ্গে বসাবসি করে পাছাক্ষয় লোকজনদের মুখে মুখে বেবাক খবর তাল হ'ল— এ রকম নানান খবরে ভরপুর থাকে দোকানের চৌহদ্দি।

এই যে চুনাতিপাড়া, আরেকটি ব্যাপার এখানে, কারেন্ট বাতির ফটাফট ব্যাপার- স্যাপার নাই, মাগরিব যেতেই অন্ধকার; শহরে কারেন্ট আছে, আশেপাশেও যুগযুগ করে বাতি জ্বলা দেখা যায়— দূরে পেট্রোল পাম্পের বাতিগুলো তো রাত ভর জ্বলে জ্বলে ভোরের আলোর কাছে থাপ্পর খেয়ে তবেই দম ফুরোয় কেবল, – কারেন্ট বাতি ছাড়াও রাতে ধাই ধাই করে জন্তুর মতো চলমান ট্রাক-বাসের দৌড়ানো বাতি দেখা যায়। চুনাতিপাড়ার ভেতর কারেন্ট বাতি টেনে আনার খায়েশ নাই কারোর তেমন; মতি মহাজন একবার তো খুব লাফালো, বেশ ক'দিন লাগাতার ছুটাছুটির পর, বোধ হয় বেধড়ক নাকানি চুবানির পর চুপসানো বেলুনের মতো— উৎসাহ কুরবানি। মতি মহাজন বেশ হিসাব করে জানায়: বাঘে ছুলে আঠারো ঘা তো কারেন্ট পোদের উপর মারে একত্রিশ ঘা, –ইলেকট্রিক কানেকশন নেওয়া মহাঝক্কি, কারেন্টঅলাদের খাই অনেক, বামহাতের কারবার আছে; তারপর বাতি জ্বললো তো মাস মাস সরকার(চুতমারানীদের)কে টাকা গুণে দিয়ে আসতে হবে। অতএব কারেন্টের নিকুচি।— একরাতে এক টাকার তেলই সই।

খায়েশ নাই আর কারো কারেন্ট বাতির জন্য; কখনো সখনো কারেন্টের তার পাশ দিয়ে চলে গেছে, মরে আটকে থাকতে দেখা যায় কাক এবং তখন লোকেরা বলাবলি করে: হুঁ,মতি মহাজন ঠিক বলেছে! কারেন্ট শালার বিশ্বাস নাই, আপদ ঘরে না আনাই ভালো, বউ বেটি কারেন্টে খেয়ে নিতে কতক্ষণ!

এই যে বাইরে আলোর ঝলমলানি আর গ্রামের ভেতর রাত বিরেতে নিকশ অন্ধকার, —এখানে যে কেউ ঢুকে আন্দাজ করতে না পারলে হুমড়ি খাওয়ার সম্ভাবনাটা ষোল আনা— কিন্তু বাঁচায় আবুইল্যার দোকানে রাখা আলো, অভ্যর্থনা পায় ঐ আলোর। তবে ঝকমারি আছে, আবুইল্যা তো আবার কবি— জ্যোৎস্না রাতে খোদার খোদ পাঠানো আলো মার খাবে বলে হ্যাজাক বাতি না জ্বালায় সে। কুপির আলোয় চাঁদের মোলায়েম আলো খোলতাই হয় বড় বেশি!

আবুইল্যার দোকানে পূর্ণিমা আর অমাবশ্যায় দুই দুই রূপ!

রূপালি আলোয় চারপাশ ফটফট করতে থাকলে, সব ভুলে বেভুল আবুইল্যা জেগে জেগে অনেক রাত পর্যন্ত তাজিমের সঙ্গে চোখে জড়িয়ে নেয় চাদের আলোর বেশুমার কেরামতি। বুদবুদ ওঠে কবিতার; উথাল পাথাল হয় আবুইল্যার; লিখতে পারে না ঠিক ঠিক যা দেখে সে। গেঁথে নিতে পারে না এই কবিতা যা সে দেখে: ছড়ানো চাঁদের আলোর জন্য গাছ যে ভূতুরে ছায়ার কারুকাজ তৈরি করে, ওর মধ্যেই কেমন তেলেসমাতিতে যেন নিত্য ঘোরাফেরা করা নেড়ি কুত্তাটা এক মানুষের বাচ্চা!

আবুইল্যার দোকানের কাছেপিঠেই পাকাপাকি দু'টা জিনিস সব সময়, ১. নেড়ি কুত্তা ;২. হাড়গিলা বুড়ি; জ্যোৎস্নার রূপজালে এই দুইকে আলাদা করা যায় না; জ্যোৎস্না মেখে কুত্তাটা কুই কুই করে, আড়মোড়া ভাঙে, ধূলাবালি গায়ে মাখে; একসময় ঐ কুত্তাটা চলে আসবেই হাড় জিড়জিড়ে বুড়িটার কাছে, পরস্পর যেন গা হাতে গন্ধ শুঁকে.... তখন মনে হয়: মা ও শিশু, – শীতকালে বোনা কুয়াশার আবরণে এ দৃশ্য আরও বেশি জ্যান্ত হবেই!-- একটা কবিতা লেখার জন্য আবুইল্যা পাগল হয়ে ওঠে;পারে না; হাত কামড়ায়, দুরমুজ পেষাই হয় অবিরাম। সে আঙুল দিয়ে গোল্লা আঁকে
তবুও কবিতা নয় একবারও, যা চায়—

আবুইল্যা তো আরও চায় এক নিদারুণ মর্সিয়া রচনা করতে যখন পুড়তে পুড়তে থাকা ঝিনুকদের কান্না শুনতে পায়; ঝিনুক পুড়ে ম'রে তবে চুন বানাতে যায়, — দোকানের পাশেই বামে একটু তফাতে যে মাটির ঘর এবং সব ঘরই মাটির এখানে, আর উপর দিকে ছনের ছাউনি; তো ঐ বাড়িটার পাশেই চেতড়িয়ে যে আছে ন্যাড়া মতো জায়গা ওখানেই চুন বানানোর আগে ঝিনুক ঝলসাতে আগুনের মচ্ছব লাগবেই। আবুইল্যা ঝিনুক পোড়ানোর সঙ্গে মরা পোড়ানোর মিল পায়; শাদা শাদা ঝিনুক যেন কাফনমোড়া শবদেহের মতো পুড়ে খাক হচ্ছেই, যেমনটি শ্মশানে জাতিভেদে?

যে আবুইল্যা পারে না, নিজেকে তার মনে হয় এক জন্তু। হাঁটুর ওপর লুঙ্গি সব সময়, গলায় তিন ভাঁজ, কানে- বুকে -নাকে -বগলে গিজগিজ লোম, রং খানা কালো— আগুনের আঁচে যতটা হতে পেরেছে, বাহু-কোমর-গলায় তাগা, বোঁচা নাক, কুতকুতে চোখ আবুইল্যার অথবা নিজেকে মনে করে কবি আবুল বাদশাহ নয় বরং কবিতার ডাইনীর হাতে ঘাড় মটকে যাওয়ার পর সে এক মুণ্ডুহীন!
 চুনাতিপাড়ায়—আহা, মানুষের পেশার কত না চমৎকারিত্ব!
আহা, ওরা চুন বানায়,
চুন দিয়ে পান,
চুনে-পানে হয় ঠোট-জিহ্বা লাল!

চুন বানাতে ঝিনুকের আছে বিস্তর ভূমিকা; পাহাড়ের মুল্লুক হতে, যেখানে সমুদ্র দিগন্তে বৃত্তমুখী—ঐ সমুদ্রের কূলে ছড়ানো ঝিনুক টুকিয়ে চালান করে আনে কন্ট্রাক্টর; সে-ই আনা ভেজা ভেজা ঝিনুক শুকাতে বিছিয়ে রাখা হয় রোদের নিচে; রোদে ভাজা ভাজা হয় ঐ সব রাশি রাশি ঝিনুক। একেকটা ফেলে রাখা ঝিনুক যেন একেক মৃতদেহ অথবা পড়ে আছে যেন ১৯৭১– যখন অজস্র লাশ, সারি বাঁধা বা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। লাশ পঁচে যেমন আকাশ-বাতাস গন্ধে ভারী—এমনই ঝিনুকেও, আতকা বাতাসের সঙ্গে বোটকা গন্ধ ছড়াবেই!
মুসলিম মরে লাশ হ'লে মাটির তলে কবরে বিলীন আর হিন্দু পুড়ে খাক— আর ২/১টা মরার পর ছিটকে হয়ত ভর করে আবুইল্যার দোকানটির পিছের গাছে; ঝিনুক শব আর কোন জাত নয়, হিন্দু বটে— তবুও গায়ের শাদা রঙ যেন কাফনেরই— মাটিতে পোতার আগে যেমন ঢেকে নেয়া হয় তেমন।

বড় এক সাযুয্য চিতার সঙ্গে এভাবেই যে, ঝিনুক পোড়ানো হয় ঘটা করে — মচ্ছব লাগে আগুনের; ঝিনুক পোড়ানোর প্রস্তুতিতে প্রথমে আগুন পাতবার জন্য তৈরি করা হয় শয্যা— ইটের ভাটায় যেমন, শ্মশানে যেমন—— একই। ঝিনুক পোড়াতে যে আগুনের কারবার করতে হয় তাতো আর এমনি নয়— ব্যাপার-স্যাপার আছে; ঐ যে শহরের মালতিপাড়া আছে না ওখানে ইট -সুড়কি-লোহায় তৈরি অথচ নাম মাটির মসজিদ যা পার হয়ে যেতে যেতে ঠিক ভিতরে নদীর কিনারা ঘেষে যে হিন্দুশব দাহ করার শ্মশানটি রয়েছে তাতে মরা পোড়ানোর কায়দা কানুন ব্যবস্থা দেখে নিতে পারলেও এখানেও এমন—

কবে কত আগে কীভাবে মাটি কেটে আগুন ধরানোর জন্য খোদল করেছিল লোকরা পাড়ায় জ্বীনে ধরা গাছটার বাম দিকের খোলা জায়গায় তা আজ কিংবদন্তী— ঐ কালের মানুষজন মরে হেজে শেষ; ঐ গর্তটা টিকে আছে— টেকসই, যেমন পেশা ও আগুনের আজ পর্যন্ত ব্যবহার; আগুনের জন্য আনজাম ঐ গর্তে অনন্তের অংশ।

নদী ছিলো আগে আরো কাছে কিন্তু শুকিয়ে আজ হ্যাংলা আর হটে গেছে দূরে; একদা দেবী দুর্গার অস্ত্রচালনায় শত্রুর কান বিচ্যূত হয়ে নদীটায় পড়েছিল— যে কথা, নদী ছিলো কাছাকাছি এমন ধারারই এক অংশবিশেষ স্মৃতিতে।
সেই যে কোন জন্মে গর্ত তৈরি আগুন জ্বালাতে, ওখানটায় এখনও খড়ি করার পর সেঁধিয়ে আগুনের দপদপানো চললেও একটা দোষে দুষ্ট ঐ সব কাঠ-টুকরা যা এমনই যে অনেক আগে দরকার ছিলো না, চল ছিলো না, কেরোসিন-পেট্রোল তো সেদিনেরই কথা—এসব ছাড়া আগে লাকড়িতে আগুন দিলে টিকে থাকতো দিব্যি আর আজ সব নয়া জমানার লাকড়ির মর্জিই বদলে গেছে, তাই পেট্রোল-কেরোসিন ঢেলে আগুন গুজে দিলেই তবে ফস্, — তারপর দাউ দাউ।

আগুন মানেই তো এক ধরনের ঊর্ধ্বগামী লাফালাফি তো চলবেই, ভক ভক করে আগুন উপর দিকে উঁচাবে মাথা আর এই জন্যেই ঝিনুক পোড়াতে বেশ দরকারী কারুকাজ প্রয়োজন যে আঙ্গিকে চিতায় শবের শেষকৃত্য, তো এখানেও যে গর্তে আগুনের চুলাটা হয় ঐ কুণ্ডের ওপর থাক থাক করে তাকে তাকে শয্যা বানিয়ে শেষবারের মতো শুইয়ে আগুনে ঝলসানোর জন্য রাখা হয় ঝিনুক সকল; আগুনের কুণ্ডুটা ফুলে ফেঁপে যেখান হ'তে দৈত্য আদল নেবে ওটাকে মাঝামাঝি রাখার পর দু'পাশে গাছের গুড়ি ফেলে একটু উঁচুর পর চেলা কাঠগুলোর প্রান্ত তাতে ঠেকিয়ে বিছানোর পর যেমন একটা পাটাতন হয়,-- ঝিনুকগুলো ছড়ানো ওখানেই থাকে.... এভাবে একেকটা স্তর, কয়েক ধাপ।

আগুন ক্যালক্যাল করে আক্রোশের সঙ্গে নিচ হ'তে উপর পর্যন্ত ধেই ধেই নাচতে থাকে বাতাসে ছাই। আগুনের খাই খাই শেষে ঝিনুক ভষ্মের গুরুত্ব এবারে বেজায় হয় আর পাড়াময় লোকজন উঠে-পড়ে লাগে চুন বানাতে, অঙ্গার হওয়া ঝিনুক ঘষে ঘষে তবেই চুনের তৈরি বলে কথা—চুনের তেজ হয় বড়; তেজী স্বভাবের চুন করার শেষ ধাপে শরণাপন্ন হ'তে হয় আবার ইঁদুরের মতো গর্তের। চুনাতিপাড়ার সব লোক, হাত ঢোকানো যায় ঐ সব গর্তেরই ভেতর, নিজ নিজ আঙ্গিনায় করে নিয়ে, তবে মেতে ওঠে চুন পাকানোতে; গর্তের ভেতর পোড়া পোড়া সব ঝিনুক একেবারে একটা একটা করে নিয়ে ফেলার পর পানি ঢেলে একটু একটু ঘষে-পিষে, লেই পায় চুনের যা মুহুর্মুহু ঘষানিতে মিহিনতর।

চুন বানানোর হরেক পর্বে সকলেরই কোন না কোন ব্যস্ততা থাকলেও কেবল বেওয়ারিশ কুত্তাটা, জ্বীনে ধরা গাছের নিচকার এপাড়ার একমাত্র দোকানের আবুইল্যা আর হাড়গিলা বুড়িটা ক্ষান্ত রাখে নিজেদের।

এই যে বুড়ি আদতে মেয়ে মানুষ –একদা যৌবন ছিলো, কুকুরের সঙ্গে এখন ডলাডলি করে গলাগলি থাকে ভাগাভাগি খায়— তারও গল্প আছে; লোকের মুখে শোনা কথা: মেয়ে মানুষটি ছিলো, বেশ্যা। এই হচ্ছে তার জন্য পেশা বদলের অভিশাপ।

তবে আবুইল্যাও কি অভিসম্পাতে কুপিত হবে?

চুন বানানোর ধূম পড়লে আবুইল্যার দোকানে বেচা-কেনা বাড়ে, বাজারে যাবে চুন পয়সা পারি আসবে, সকলেই প্রসন্ন থাকে এবং কুত্তাটা বুড়িটার জন্য সদয় আচার- বিচার চাঙ্গা।
বুড়ি প্রাণ খুলে দোয়া করে যেমন আল্লার দরবারে ছাপ হবে এমনি যে ছপ্পর খুলে
আসবে রহমত!

কুত্তাটা কিভাবে কোথায় কেমন প্রার্থনা জানায় মানুষের আচারে সন্তুষ্টির পর কে
জানে!

জীবন কি নিস্তরঙ্গ –এই গ্রামে? ঢেউ নাই? কম্পন নাই? –এই তো কাছাকাছি আছে নদীটা, যদিও আধমরা তাতেও তো ঢেউয়ের পরে ঢেউ :ছলাৎ ছলাৎ রয়েছে।
গ্রাম কি মরাহাজা নদীটার চেয়েও অসার?
এবং উত্তেজনাহীন?
উত্তাপহীন এবং
ঘটনাবিহীন!

এখানে কোথাও কোন তারতম্য নাই—আসা নাই যাওয়া নাই ফেরা নাই....... লোকজন খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে... স্রেফ ? ঘুমাচ্ছে নাক ডাকাচ্ছে— সুখী?
সন্তান উৎপাদন করছে; ছেলেপুলে বড় হচ্ছে; আয়ু হারালে মরছে; ভোট আসলে সীল মারছে— ব্যস!

এখানে কি অঘটন নাই? — যে, মেয়েছেলে পালাচ্ছে পুরুষের হাত পাকড়ে? — যে, লাঠালাঠি লাগে না এদলে ওদলে? –যে, টিপসই নিচ্ছে না কেউ ফলস মেরে সর্বস্বান্ত করতে? — যে, আগুন দেগে ওঠে না বাড়িগুলোর কোনটার গোলপাতার ছাদে? — যে, কেউ করে না আত্মহত্যা অসম্ভব পাঁকে পড়ে মরে বাঁচার তাগিদে ???

সবই কি মরা? মরা? মরা? মরা? —মরে ভূত? আর কোন দাবী নাই?
এই যে গ্রামের সবেধন দোকানটা –মরা?
 চুন বানাতে ব্যস্ততায় লোকজন-- মরা? সুপারি --- নারকেল- আম-কাঠাল, অজস্র গাছগাছালি ---মরা?
কুত্তাটা আর ঐ যে বুড়ি ঝিম খাচ্ছে—মরা? ন্যাড়া উঠান--- আঙিনা, ঘর বাড়ি----মরা?

নাকি সবই তাজা বেজায় এই ফুরফুরা বাতাসে?

অথবা এমন নয়তো যে, মরা হচ্ছে সে? চোখ দু'টি তার মার্বেল, যা দেখাচ্ছে সব হয়ে যায়— যাচ্ছে মরার মতো?

তবে?— তবে কি তাই?— এই গ্রামে ক্রাইসিস বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব একেবারেই নাই?
কোন ক্রাইসিস নাই তো গল্প হবে কোন মন্ত্রে?

গল্পের জন্য ক্রাইসিস কি জরুরী? দ্বন্দ্ব? ক্রাইসিস? –এই কি যে, একটু ভূমিকা থাকবে গল্পে— বিস্তার হবে কাহিনীর— একটু দ্বন্দ্ব খেলা করবে— শেষমেষ গুড এনডিং গল্প কি এমনিই, এতটুকু?

এই গ্রামে খানাতল্লাশ কোথাও কোন ক্রাইসিসের মুখ পাওয়া গেলো না; গল্পের উপাদান খোঁহজা বেগার একেবারে। লোকজনের অদ্ভুত করে চাহনি হজম করা নগদ নগদ লাভ শুধু। তো, ক্রাইসিস অনুসন্ধানের পর উপসংহার এই রকম যে, এখানে সবই বেদম ঠাণ্ডা। চারিদিকে শীতলতা, নিস্পৃহতা— অথবা সাপের মতো.....

আহা রে! বাহা রে! তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠেই, কবি আলগা পাতলুন কোমরের যথাস্থান পরিত্যাগের পর নাভি ছেড়ে আরও নিচে এক বিঘৎ নামতেই, দুই সাইড খামচে ধ'রে হিড় হিড় উত্তোলনপূর্বক পুনরায় পশ্চাৎদেশীয় অঞ্চল স্থিতু করে গ্রামটিতে যে একমাত্র দোকানটি বিদ্যমান সেটার সামনে পেতে রাখা বেঞ্চের মসৃণ কাঠের উপর অতঃপর আব্দুল কুদ্দুস।

এই নাম কুদ্দুস নিয়ে ডাকসাইটে গল্পকার কোনদিনই হ'তে পারবে না এমন ভবিষ্যত বাণীতে ভারাক্রান্ত জীবনে এ যাবত রিজেক্ট খেয়েছে গোটা পঁচিশেক গল্প। নামজনিত অসফলতার সম্ভাবনা প্রথম কানে শোনে বেশ আগে একবারই যখন মোলাকাত ঘটেছিল জানু ঢাকা পাঞ্জাবী মোড়ানো বড়সড় ঘনঘোর এক দৈনিক খবরের কাগজের সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে। প্রস্তাব ছিলো নাম পরিবর্তনের, যে নামে জেগে উঠবে ভাবী কালের গল্পকার এবং সেই সঙ্গে তাগিদ দিয়েছিল নিয়মিত পায়ু বিহারের— তাতে ফল লাভ হাতেনাতে, শুধু গল্প ছাপা না পাছা!

ঐ সম্পাদকের সঙ্গে একরাত যাপন ছিলো ঐ বয়সে গোঁফ ওঠে নাই যখন এবং সব কিছু না কামিয়েই মসৃণ আব্দুল কুদ্দুসের। রাতে তাকে পরার জন্য দেয়া হয়েছিল যে লুঙ্গি, ঘুমাতে যাওয়ার পর বাতি নিভিয়েই হ্যাচকা টানে খুলে নিতে সময় দিলো না সম্পাদক সাহেব; সহসা আষ্টেপিষ্টে আকর্ষণ—শরীরময় কিলবিলিয়ে চলে আঙুল — পায়ুপথে রাস্তা খুঁজে নেয় কঠোর এক লম্বাটে বন্ধু, পায়ু জুড়ে কষা পায়খানার অনুভূতি—ঝাঁকি আর ঝাঁকি, ওঠা নামা –অকস্মাৎ উষ্ণ প্রস্রবণ তার উপুড় হওয়া শরীরের ঐ খাঁজে! পরে, ভারী মমতায়, ব্যাণ্ডেজের তুলার রোল খুলে খুলে সাফ সুতরা করে দেয়া হয় গুয়ের পথটা। আব্দুল কুদ্দুস ঘৃণায় একবার পায়ু পথে পাল্টা সশব্দে বাতাস ছাড়তে পারে কেবল !

নাম পাল্টানো হয় নাই, পায়ু শোক গুবলেট করা গেলেও নাম বদলের শোকের চাড়া ছিলো বড় তীব্র রকম তার জন্য, মুদ্রিত অক্ষরে গল্প লেখক হওয়া হয়নি আর আব্দুল কুদ্দুসের; গল্প লেখক হ'তে হ'তেও না পারার ব্যাপারটির মধ্যে শুধু পায়ুঘটিত স্মৃতিটা আজ টাটকা বলেই এক জেদ তাকে করে রাখে ক্ষ্যাপা — আজও সে গল্প লেখার জন্য জঙ্গি। সে এমনি এক গল্প রচনা করতে চায় যে, সব কিছু কেঁপে উঠবে, ফাটাফাটি করে হয়ে যাবে টুকরা টুকরা; এমনি এক গল্প হবে যা দেখে সকলের কলমের নিব হ'তে ঢাকনা খোলা হবে না আর। সবাই শুধু বলবে: জয় কুদ্দুসের জয়! —এই ভাবনা বিস্তারে নারী সান্নিধ্যের মতো রোমাঞ্চিত হ'ল সে এবং আরও বেশি ঘামলো যা এমনিতেই চক্কর পেড়ে প্লট খুঁজতে, ক্রাইসিসের শুলুক বের করতে করতে জবজবে দশার সঙ্গে উপরি মাথার ওপর রোদের কামড় ছেড়ে কথা বলে নাই, ঘড়িতে নয় শরীরেরই বারোটা বাজা সারা!
হঠাৎ—

আব্দুল কুদ্দুস যেন অমঙ্গলের প্রতিভূ। কোথায় ক্রাইসিস কোথায় ক্রাইসিস করে মাথা খুটে, গল্পের জন্য ক্রাইসিসের তালাশে, উপর্যুপরি মুখে ফ্যানা ওঠানো যখন শেষ অমনি মূর্তিমান ক্রাইসিসের এক জ্যান্তব আক্রমণ এই নির্ভেজাল সরল জনপদে। ক্রাইসিস! হ্যাচকা টানে ক্রাইসিস। ধারালো এক ক্রাইসিস।
অথবা যথা:
ফলে সবদিন একরকম যায় না, একদিন অর্থাৎ আজই প্রথম এই দিনটাই অন্য রকম—
এই যে আবুইল্যা ঝিমঝাম ভাবে দোকানের কাষ্টমার সামাল দিয়ে যাচ্ছিল, বেশ ছিলো: জিনিস সাপ্লাই আর ভাংতি গোনা, তো সেই সময়ে কান ভারী হয়ে গেল— দোকানটিতে আর কোন অধিকার নাই তার, ছাড়তে হবে এবার।
পেল্লায় এক বিষম খেলো আবুইল্যা, তার বাদে ধাতস্থ হওয়ার পর ক্রুদ্ধ সে:বাবায় এই দোকান আমাকে দিছে। দোকান আমার। আমি এতোদিন চালায় আসতেছি আর এখন ভুয়া কথা বললেই যাবো নাকি?

দোকানে উপস্থিত গুচ্ছের লোকজন চিড়িক করে পানের পিক ফেলতে ফেলতে, গাল ফুলিয়ে সিগ্রেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সৎ দুই ভায়ের কাইজা ফ্যাসাদ মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে শুকনা মজায় জমে গেলো সবাই। বিনা পয়সায় এমন মজার স্বাদই আলাদা –বাড়ি গিয়েও খোশ মেজাজে এসব উড়াঝুড়া ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে মনের রং চড়িয়ে গল্পগাছা করা যায়, শুধু কি তাই? –পরিশেষে নির্ঘাৎ মেয়ে মহলে দুপুরে উকুনের গুষ্টি নিকেশ করতে করতে, চুল আচড়াতে আচড়াতে আরও ফেনিভ হবে বইকি!

সৎ ভাই কামাইল্যা একা না, তার সঙ্গে আরও কয়েকজন আছে, তবে প্রধান যে ব্যক্তিটিকে সম্ভ্রম বেশি আর কেউ না সে হচ্ছে মতি মহাজন—ব্যাটার ইচ্ছায় চুন বানানো বন্ধ হয়ে যেতে পারে, সময়ের ব্যাপার—চাঁটগা থেকে ঝিনুক সাপ্লাই করে আনে সে ট্রাকে চাপিয়ে নিয়মিত। মতি মহাজনের পরনে আছে উপর দিকে শাদা টুপি- পাঞ্জাবি, তলার দিকে শাদা চেক লুঙ্গি আর তলার তলায় মোজা দিয়ে পরা নাগরা স্যু।
মতি মহাজনের উপর আবুইল্যা মোটের উপর মহাচটা, শালার বহু‍ ফুটাঙ্গি। মনে প্রাণে আবুইল্যা এখন পাত্তা দিতে চায় না মতি মহাজনকে কিন্তু তা হ'লে কি হবে, মতি মহাজন দেখতে দেখতে সকলের নজর নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে; আশেপাশে ভালো করে চোখ ঘুরিয়ে মোলায়েম এক গলা খাকরি দিলো; ফাঁকা জমি দেখে পিচিৎ করে মুখভর্তি পানের পিক একখাবলা ছুঁড়ে দিলো—এক লোকের শরীর মাখামাখি হলে এমন বিগলিত চেহারা যেন মতি মহাজনের থুথুতে দোয়া আছে!

গেলো প্রথম দফা।

কামাইল্যা এগিয়ে এসেছে আবুইল্যাকে যুৎসই জবাব ঝাড়তে, বললো: বাপে তোকে কবে এই দোকান দিছে? বসে বসে ভাত খাচ্ছিলি তাই তোকে দেখবার দিছিল, বাপে এখন লেখাপড়া করে এই দোকান দিয়া দিছে। আমার ভাগে এই দোকান পড়ছে। তুই যদি এই দোকান না ছাড়িস তাইলে খারাবি আছে বল্লাম।

কুঁদে ওঠে আবুইল্যা, লাফ মেরে নামে দোকান ছেড়ে, এক হাতাহাতি দূরত্বে দাঁড়ায়
কামাইল্যার সামনে, চেচায়: যা ভাগ, ক্যাচাল করার জায়গা পাচ্ছিস না।

আজ সকালে কথাবার্তা ছাড়া ধুমসে এক পশলা বৃষ্টি ঘটেছে পরেই আবার খুনে রোদ তবু মাটি কাদায় প্যাঁচ প্যাঁচ। বৃষ্টির পরেই রোদের মারমুখী কারণে সকলের শরীরে ঘামের নহর।

কামাইল্যা, কপালের ঘাম হাত দিয়ে মুছতে গেলে হাতের ঘাম কপালে মাখিয়ে তেড়েফুড়ে পাল্টা ঝাল উগড়ালো তাতে আবুইল্যা জ্বলুনির চোটে ধেই ধেই লাফায়, হাত পা ছোড়ে।

জ্বীনে ধরা গাছের গায়ে কতক কাক তারস্বরে চেচামেচিতে সকলকে সচকিত করছে এবার; একজন যেন কে গাল দিলো; মরার কাক! এক বালক পুচকেকে গাছে তাক করে ঢিল মারতে দেখা গেলো, ঐ ঢিল লাগসই ভাবে তাকসই হয় না, কাকের দঙ্গল কা কা কা করে উড়াল ছাড়ে, টিনের চালের মধ্যে ঠনাঠন ঠনাৎ করে ছোড়া ঢিল আছড়ে পরে একটার পর একটা—সব মিলিয়ে বেজায় ক্যাওয়াজ! বালকটার উৎসাহ বাড়তে থাকে এবং সঙ্গীও পেয়ে গেছে কয়েকজন ওর মতোই সাইজের!

মতি মহাজন নিজের গলার উপর ভরসা রাখতে পারে না, যতটা সম্ভব উঁচিয়ে বলে:রমজান, শুয়ারগুলাকে বাধ তো!

রমজান তাগড়া ও গান্ডু টাইপ, ব্যস্ত ছিলো গরমকালে বরাবরের মতো অভ্যাসে –বগলে নাক ডুবিয়ে টেনে ঘামের গন্ধ শোঁকায়, এবার কর্তার কথায় জটলার মধ্যে নাড়া দিলো নিজেকে।

আবুইল্যার কাছে মতি মহাজনকে একটি ফণা তোলা সাপের মতো মনে হয় অকস্মাৎ, চোখে চোখ রাখলে দেখতে পায় ঠাণ্ডা ফিনকি। সে যেন সাপের মুখোমুখি, মাথার ভেতর কবিতা ফুলকি মারে, কবিতার ডাইনিটা শেষ পর্যন্ত আস্ফালন করে ওঠে; সাপ মারতে আগুন হচ্ছে খাঁটি জিনিস, চোখ বিঁধে যায় দোকানে বেচার জন্য টিনভর্তি কেরোসিনের দিকে— এবং সে শুধু অবলীলায় আগুন ছাড়লো!

ঝলকে ওঠা আগুন পলকের মধ্যে খেয়ে ফেলে দিবে যেন সব; বড় আক্রোশ আগুনের; দাউ দাউ করা আগুনটার বড় ক্ষিধা — একটা কবিতা লিখতে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত! মাতাল আগুন কেরোসিন টেনে উন্মাতাল!

দৌড়

দৌড়


দৌড়

দৌড়

দৌড়

শুধু দৌড়

কে যেন আগুন নিয়ে ধাওয়া করে আসছে। আব্দুল কুদ্দুস পালায়।
ভাগে সে।

শেষ করা যেতে পারে এইভাবে যে, যদি চুনাতিপাড়ার জনগণ চুনের ব্যবহার ঠিক ঠিক কাটায় কাটায় জানতো তবে চুন দিয়ে অবিরাম অশ্রান্তভাবে দেওয়ালে দেওয়ালে লিখে লিখে ছড়িয়ে দিতে পারতো: চুনাতিপাড়ার দুঃখের কথা কেউ তো বলে না; কেউ তো জানে না। 
কিন্তু গল্পটা আব্দুল কুদ্দুসের এ্যাডভেঞ্চারের মতো শেষ হয় না আর। 
এ জন্মেও শেষ হবে না।
গল্প লেখার জন্য একটা যন্ত্র নাই কেন?

‘দ্রষ্টব্য’ মে ১৯৯৫

শাদা কাহিনী
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ 


মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: শাদা কাহিনী │ছোটগল্প│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
শাদা কাহিনী │ছোটগল্প│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s16000/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s72-c/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashid-short-story-shada-kahini.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashid-short-story-shada-kahini.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy