.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সন্তানগণ ও দুধভাত │ছোটগল্প│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ

জয়নুল আবেদীন, তাঁর অবিস্মরণীয় স্কেচ করে অমর হয়ে গেলেন; সেই সময় আবাদক্ষেত্র ও মানুষের উদর শূন্য– ফসলের ও খাদ্যের প্রকট সংকট, –আরেক কেয়ামত। মানুষের জমি তৎকালে সীমিত যদিও মৃত্যুর প্রাচুর্য সীমাহীন।

কালে-কালে এতই বিচিত্র স্বভাব যে, জীবন বিক্রয়ে বেরিয়েছে মানুষ। এবং যৌবন সম্পদও কিঞ্চিৎ মূল্যধারক, ফলতঃ জঠরের পর জঠর খাদ্য শূন্য হ'লেও কতিপয় জঠর মানুষের উৎপন্ন মাংসপিণ্ডে কিলবিল, ভরাট –মানব শিশুর ক্রমবিকাশ। 

তদানীন্তন যাপিত সময়ে, একদিন দ্বি প্রহরে, সূর্যের মুখ যদিও দেড় হাত ওপরে চন্ড নয়, তবু উত্তাপ প্রাবল্য--গনগনে অস্তিত্ব হাশরের মত স্মরণীয়; দেখা গেল এক মহিলা, কালো,
অসুন্দর, অমসৃণ, ক্লিষ্ট এবং অনাবৃত; এক উঠোনে নিজেকে অর্পণ করে, বাড়িটি সামর্থবান গৃহস্থের– আকালে ঝাপ্‌টায় তদ্বধি মচকে দুমড়ে যায় নি; খেতে পায়, হাসতে পারে মুর্গা জবো হয়, জামাই আসে বেড়াতে– আদর পায়, বউও নাইওর যায়–ছেলের বিয়ে ঘটে।

মহিলার সঙ্গে দেখা যায়: তিনটি শিশু-ওরা হয় কন্যা; এক দোনা চাল কিছু আনাজ বদলে দেয় শিশুদের ভবিষ্যৎ। মাতৃস্তন হ'তে শিশু ওষ্ঠ খসে পড়ে আহারের জন্য খাদ্যের আকুতি পৃথক করে দিল সন্তানের মাতৃত্বের মমতা হ’তে।

অতঃপর চোখে পড়ে যে, ঝাড়া হাত পা মা ফিরে চলেছে সঙ্গে এক দোনা চাল নিয়ে, চোখের ভেতর খুশির বালি; ফলে খচ্ খচ্ অনুভূতি, চোখে চক্‌ চক্‌ করে জলকণা; ভেতরটি ফাঁপা গুমোট কোন উচ্চারণ নেই-শুধু দ্রুত পদসঞ্চালনে গন্তব্য অভিমুখী অবশ্যম্ভাবী যাত্রা। মা মহিলার তো এখন মুক্তি। শিশুরা বেঁচে বর্তে থাকবে গৃহস্থ বাড়িতে এই, এক ধরনের নির্ভর চেতনা, বন্ধন শূন্যতা নারীটিকে পৃথক ও পলকা করে তুলতে সক্ষম হ'লেও পারে না দ্রুত অতিক্রম করে পা নিয়োজিত রাখতে। যেহেতু জন্ম দেয়া শিশুদের বিনিময় লন্ধ চালের স্তূপ তার কাঁধে ন্যস্ত এবং তার এই গতি শ্লথতার জন্য দায়ী।

মন্থর পদচালনায় মনাই বাবার দীঘির নাগালে পৌঁছুতেই আসন্ন সন্ধ্যা- সূর্য প্রায় অপসৃত, পশ্চিমাকাশ ঘোলাটে– ঘষা। দীঘির জল, আলো নিভে যাওয়ায় ঘনীভূত গাঢ়তায় আবরিত এবং এই জল ভেদ করে, পাড়ের কিনারা ঘেঁষে, একটি পাকানো শেকল ওপরে উঠে এসে,ভূমিতে কুণ্ডলীকৃত, স্থির, ওজন আছে, ভারী–সরানো যায় না। অকুস্থলে অপেক্ষা করবে ইদ্রিস আলী। এরকমই স্থির ছিল, –যখন তাদের পরিকল্পনা গ্রহণ; তবে আরও পূর্বে সময় ধার্য ছিল, যে সময় হতে এই বর্তমান ক্ষণ অনেক পরবর্তী। চালের দোনা, মাথার'পর হ'তে নামিয়ে নিজেকে অতিরিক্ত ওজন মুক্ত করতে সক্ষম হ'লেও ভার যেন কমে না; বরং নিজের ভার বহনেও অসম্ভব অক্ষমতা নিরুপায় করে তাকে; পথ অতিক্রম কালে কখন, কোন অবকাশে দানা-দানা চাল সমস্ত শক্তি শোষণ করে নিয়েছে যেন বা,, –দেহ ক্লান্তিতে গড়িয়ে পড়লো অকাতরে।

তার মরদের নামই তো ইদ্রিস আলী: ভাত দিতে পারে না, তবে নির্বাচিত, লক্ষ্য সইক্ষম উপায় বের করতে পারে, যার ফলাফলে অনাহারী মৃত্যু সম্ভাব্য কন্যারা খেয়ে পরে, মালিকানা বদল করার বদৌলতে টিকতে পারবে নির্ঘাৎ এমনই এক মোক্ষম সমাধান প্রদান, মেয়েলোকের সঙ্গে যদিও সে আসেনি বা পারেনি আসতে –তাতে কি, সে নিজের উৎপাদন ক্ষমতায় আস্থাবান যেহেতু নারী এবং আবাদক্ষেত্র সর্বদাই উর্বর, বীজে ফলবান – ব্যতিক্রম একমাত্র তার বিপর্যয়কাল।

এ যাবত দীর্ঘ ও প্রসারিত সারিবদ্ধ বৃক্ষরাশি আয়তাকার দীঘিটিকে ঘেরাও করে একটুক্ষণ ঘাড়কাঁধ ঝাকাচ্ছে ভূতের মত। অন্ধকার নিকষ; দূর অচিহ্নিত নিকট যা কিছু সব অস্পষ্ট শরীরের প্রত্যক্ষ সমূহও কালের গর্ভে বিলীন, শনাক্ত অযোগ্য এবং শ্রবণ ক্ষমতা যেন বা কবরের মত অন্ধকারের তীব্রতায় শক্তি লুপ্ত। এলিয়ে রাখা তার দুই হাত, বস্তায় বন্দী চাল মুক্ত করে ছড়িয়ে আনে, সাদা সাদা চাল আর চাল, অন্ধকার সত্ত্বেও পরিচিত, স্পর্শ করা মাত্র ক্ষুধা মোচড় মারে; এক মুঠি চাল মুখ গহ্বরে ঠেসে দিয়ে অপর মুঠি চালের ঘ্রাণ টেনে আনতে গিয়েও ব্যর্থতা নিঃশ্বাস চেপে ধরে কোন এক, কিসের যেন সাড়াশী আগ্রাসন: চিৎকার বের হয় না, শুধুই গোঙ্গানী; মুখ ভরাট চাল স্তব্ধ হয়ে থাকে, গলা বেয়ে নিচু নয়; অন্ধকারে অতঃপর ভাসমান সে বয়ে চলে অনেক হাতের কর্কশতায়, আকর্ষণ-বিকর্ষণে চল্ চল্ চল্ করতে করতে; স্পর্শের তপ্ত ক্ষিপ্ত আঁচড় শরীরময় প্রবাহিত, আবার কখনো বা কষাঘাত। বস্তার চাল ও মুখভর্তি চাল যথাস্থানে নির্বাক; জমাট হয়ে পিন্ড।

ইদ্রিস আলী মুততে গিয়েই অকস্মাৎ সন্ধান পেয়েছিলো মাটির তলায় আলুর কিভাবে যেন তদ্বধি অটুট-কেউই খাবলা বসায়নি, সে-ই আলু পেয়ে যাবতীয় মগ্নতা এতক্ষণ অধিকার করে রেখেছিলো তার– ক্ষুধার বিপক্ষে। ক্ষুন্নিবৃত্তির পর, পাকস্থলিতে অপূর্ব অনুভূতিসমেত নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে এসে চোখে দেখে; আলোক ও অন্ধকারের পার্থক্য ব্যতিরেকে পূর্বাপর দৃশ্যপট হুবহু অবিকল। চারদিক এখন নিশুম, নিঝুম; অন্ধকারে নিস্তব্ধতা অবিরাম দীর্ঘচুল ছড়িয়ে যাচ্ছে অকৃপণ। ইদানীং এই ক্ষুধা পরাক্রান্ত সময়ে শূন্যতা ও নির্জনতা সৰ্বব্যাপ্ত– শুধু দিন ও রাত্রিতে তীব্রতার ভিন্নতা; ক্ষুধার করাল আঘাতে জীবনের ক্ষয় ও পলায়ন; বাঁচার তাগিদে-খাদ্যের সন্ধানে মানুষের ত্রস্ত ছোটাছুটি গ্রামের পর গ্রামকে গহীন এক দৈত্যপুরীতে রূপান্তরিত করেছে–নির্মম মমতায়। ফলে স্তব্ধতায় অভ্যাসগত ইন্দ্রিয় এতই নাচার যে, কোন রূপ ধ্বনি সহসা টংকারে বেজে ওঠেনা।

অন্ধকারের বাষ্প কাটিয়ে নিজেকে ন্যস্ত করলো সে পুকুর পাড়ে সেই স্থানে, যেখানে তলদেশ থেকে জল কেটে ভেসে এসেছে শেকলের বিস্তৃতি। কথিত আছে: এক স্বার্থপর রাজপুরুষ নিজের আয়ুর শেষ উপলব্ধি করে রাজ্যের যাবতীয় ধন দৌলত ও সৌন্দর্য বিশাল তোরঙ্গে আবদ্ধ করে, জলের পাতালে নিক্ষেপ করে স্বার্থপরতায়, যেন পরবর্তী কারুর ভোগে না আসে এমনই নিষ্ঠুর আত্মকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত ছিল তার। এবং পরে তার মৃত্যুও ঘটে। লৌহ শেকল দিয়ে ততদিন পর্যন্ত চূড়ান্ত ভাবে নিজ দখলে রাখার ইচ্ছে করে ছিল, যে অবধি না মৃত্যু। কিন্তু হতাশা! মৃত্যু পূবাহ্নে শেকল ছিন্ন করার অবশিষ্ট অভিপ্রায়টুকু আর পূর্ণ হয় নি। যেহেতু বিনা ঘোষণায় মৃত্যুর আঘাত। পরবর্তীতে সুশাসন পুনপ্রতিষ্ঠিত সত্ত্বেও শেকল টানা হয় না; কেউ সাহস করে নি যেহেতু এক সাধুর ঘোষণা: কেউ যেন এই চেষ্টায় লিপ্ত না হয়-ধর্মের কোর্তা প্রভাব বিস্তারী। সেই হ'তে না কি সোনার দেশে আকাল এবং মন্দের সূচনা। আরও উল্লেখ্য লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু; সাধু মুক্তকচ্ছ হয়ে লাফ দিত, এবং উচ্চারণ করতো।

ইদ্রিস আলী চোখের ডগায় লোভনীয় বস্তু দেখে আত্মহারা, এত চাল! এত! সাদা সাদা সাদা ছড়ানো ছিটানো সাদা সাদা সরু সরু অসংখ্য অন্ধকারেও স্পষ্ট চাল আর চাল; নিজেকে দুমড়ে মুচড়ে ছুড়ে দিল পাজা করা চালের স্তূপে। ঘ্রাণ টানলো আহ জ্যোৎস্নায় নাকি ধানের শীষে দুধ জমে! চাল হ'তে পোয়াতিকালীন নিজ মেয়ে মানুষের দুধের গন্ধ ভূসভূসিয়ে ওঠে।

এতক্ষণে সময় নিয়মিত পদক্ষেপে বেশ অগ্রগামী; নতুন ঠিকানার মানব শিশু তিনটির নতুন নাম নির্বাচনের পর বরাদ্দ হয়েছে-ঢেপরি, টেপরি ও যেপরি তিন জনাই মেয়ে; নামকরণে বিশেষ দ্যোতনা লক্ষণীয়; হয়তোবা; বাপ-মা প্রদত্ত নাম ছিল, কিন্তু বিনিময়কালে পণ্য হিসেবে তিনটি মানব শিশু বনাম এক দোনা চালের দর কষাকষি অধিক মনোযোগ পায়, ফলে কোন রকম পরিচয়করণ স্থান পায় নি। শিশুদের জন্যও বরাদ্দ করা হয়েছে নিয়মিত খাদ্যাহার। কাজের পরিমাণ, ঘুমের স্থান এবং ভবিষ্যত।

বিয়ে হবে এই গার্হস্থ্য বাড়িটির একমাত্র আদরের দুলারীর, –সাত ভাইয়ের মধ্যে চম্পা বোন। পাত্র ভালো, কিছুটা ভারিক্কি, গরীব উচ্চাকাংখী চাকুরীজীবী কোলকাতায় বসবাসরত; যদিও এই আকালের কালে মৃত্যু সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সত্ত্বেও বিয়েতে আনন্দের ধুম, রং, তামাসা; চক্ৰবক্রা পোশাক পরিহিত, ক্লিষ্ট বাজনাদারদের ব্যান্ডে আওয়াজ; নীশিথে যাইও ফুল বনে রে---ভোমরা; মাঝে মাঝে বাজি পোড়ানোর শব্দ, রংগোলা পানি মাতামাতি–রক্তহীন ক্ষুধার মৃত্যুকে সমতা দেয়। মেয়েটির নাম জয়তুন, বিয়ের দিনে ত্রয়োদশ বারের মত রজঃস্রাব আরম্ভ; কন্যার শরীর রক্ত প্লাবিত, চোখে অশ্রু, ঢিবি ঢিবি ভয়। চারিদিকে, সর্বব্যাপী যেন এমন জোয়ার---1

হাহাকারময় এই সময়, বরযাত্রী ব্যতীতও আশপাশ গাঁ-গঞ্জের লোক সকলকেও খাওয়ানো হবে, আরেক দক্ষযজ্ঞ কান্ড। বাড়ির চারিপাশ, ফলে অস্থি-চাম সর্বস্ব গাদাগাদা মানুষে সয়লাব; ওদের চোখ জ্বলজ্বলে, ঝুলে পড়া জিহ্বা তল বিস্তৃত ক্ষুধার প্রতীক।

বিয়ে বাড়িতে দুই প্রকার খাদ্য প্রস্তুত। একদল ভেতরে লালা ঝরানো উপাদেয় খাদ্য গ্রহণে ব্যস্ত এবং বাইরে ছুড়ে দেয়া হয়েছে গলিত আলু-খিচুরী, ট্যালটেলে ঝোল–গামলা গামলা; মুখ ভাসিয়ে, শরীর মাখিয়ে কোৎ কোৎ করে পেটে চালান করছে, যেন এক পাল রাজ্যের কুকুর, হামাগুড়ি দিচ্ছে, মাটিতে ঘোষ্টাচ্ছে অনেকদিন দানা পানি পড়েনি, ওদের চড়া পড়া খটখটে পেটে এবার আহার্যের অনির্ধারিত সংঘাতে কেউ কেউ গ্যাজলা তুলে চোখ ওল্টালো,-- চোখের তারা ঘূর্ণমান। ভেদ বমি করে, অপরিচ্ছন্ন আহারের পর, সাফ হয়ে গেল আরো একদঙ্গল মানুষ জন্তুর মত খায় এবং মরে। এরই মধ্যে বিয়ে-মিলন, কনে বিদায় --- জয়তুন কাঁদলো, মা কাঁদলো, ভাই ভাবীরা ফোঁপালো - জয়তুন কোলকাতা শহরের বউ হয়ে গেল; তখন ব্যান্ড পার্টি আর বাজলো না।মাত্র এক দণ্ড হ'লেও সব কিছু কেমন যেন নিষ্কম্প ও স্থির।

দূর দেশ,--জোতদার তনয়ার সঙ্গে দেখ-ভালের জন্য চললো কেনাবাদী: জোতদারের অর্থ, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিরই চিহ্ন। শিশু তিনটির মধ্যে ঢেপরি-ই জেষ্ঠ্যা –যদিও সব দাঁত পড়ে নাই এবং ওঠেও নাই। তবু তাকেই জয়তুনের সঙ্গে নিয়োগ।

ইদ্রিস আলী ঘরের মেয়েমানুষকে ফিরে না পেলেও, চাল জমা পেয়েছিলো একদোনা, তা-ই ঘরে এনে মশগুল; ইচ্ছে হ'লেই চাল ফুটিয়ে গদ্‌গপিয়ে পেটে চালায়, শান্তি! মুহূর্মুহু আহারের পর পর কামেচ্ছা ক্রমশঃ জাগ্রত, কিন্তু উপায়হীন। সহসা একদিন এক লোকমা চালভাজা গালে ফেলে ফ্যান রাখা মগে ছোট্ট চুমুক মেরে তাকিয়েই দেখতে পেল নিজের মেয়েমানুষকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার পর। চোখের সম্মুখে যোনীর কাঠামো যেন; সে লুঙ্গিতে হাত পরিষ্কারের ব্যর্থ প্রচেষ্টা নিয়ে টান মেরে নিজেকে অনাবৃত করে এবং মেয়েমানুষকেও। কোন প্রশ্ন নেই, শুধুমাত্র একযোগে শরীর ঝাকানো ও তৃপ্তির স্বরধ্বনি–গোঙ্গানী। এক সময় ভাতের ফ্যানের মত থকথকে বীর্যে মেয়েমানুষের তলপেট ও যোনী মাখিয়ে পরিভ্রান্ত ইদ্রিস আলী বেঘোর ঘুমে কাত। এবং নারীর কথা শোনার অবকাশ রইলো না।

পরে, রাতের বেলায়, চাঁদ ও কুপির আলোয় খাবলা খাবলা সাদা ভাত আহাররত ইদ্রিস আলীকে, মেয়েমানুষটি হারিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসা সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ দিতে থাকে— উরু চুলকোতে চুলকোতে, মুখে ভাত ভর্তি কান খোলা ইদ্রিস শোনে অলৌকিক ঘটনাবলী:

দীঘির তলায়, পাতালে নিকানো একটি উঠোন রয়েছে। খুঁটিতে বেঁধে রাখা গরুর দুধ দুয়ে পাত্র পূর্ণ করছিলো এক বুড়ি—পাশে ঝাঁটা, এরপর যেন উঠে, পাত্র পূর্ণ দুধ রেখে তিনি উঠোন ঝাড়বেন। বুড়িটিকে আর কষ্টের মধ্যে যেতে হয় না, ইদ্রিস আলীর মেয়ে মানুষকে দিয়ে উঠোন ঝাঁটায় তন্নতন্ন করে। আপত্তি করতেই গুমগুম কিল বসায় বুড়ি–তখন দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। কোন ক্রমে ঝাড়ু দেয়া শেষ করে, কাঁদতে বসলো মেয়ে মানুষটি উঠোনের মধ্যিখানে, হাত- পা ছড়িয়ে – ভেবেই পায় নি, এখানে কীভাবে আগমন সম্ভব,-- তার, নিজের। বুড়ি মায়া দয়াহীন এবং ততটা শক্তিহীন নয় যে প্রতিবাদ করা যায়, ফলে অনেক কাজ করতে হয়। এতদিনে অনেক কাজ যেন বুড়ির জমে ছিল, যা এককভাবে অসম্ভব,-- এবার সেই গুলো – কাজ সমাধা করতে উঠে লাগলো বুড়িটি। তারপর খাদ্য সরবরাহ করে: আলুভর্তা, ডাল- ভাত, আমের আচার। রাত করে, চুলও বেঁধে দিল পরম মমতায়, এবং তখনই যেন মায়ার উদ্রেক। মেয়ে মানুষটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, ইনিয়ে বিনিয়ে বলে–স্বামী ও সন্তানের কথা। সন্তানের কথা জেনে বুড়িটি গলে পড়ে, ফলে মেয়ে মানুষটির মুক্তি।

শেষ উচ্চারণের স্বর বাতাসে মেশার পূর্বেই মেয়ে মানুষটি হাউহাউ করে কাঁদে। ইদ্রিস আলী বোঝে যে, এ সন্তানের জন্য শোক। সন্তান সৃষ্টি করবে এমন অভিপ্রায়, ইদ্রিস আলী তৎক্ষণাৎ যেন নিজের ফলবান বৃক্ষের মত মেয়ে মানুষটিকে নির্বস্ত্র করেই, যোনীদারে উপুর হলো মুহূর্তেই– আর্দ্র মমতায়। ভাতের সানকি তখন অবহেলায় গড়াগড়ি যায়।
মেয়েমানুষটির উচ্চারিত কথামালা, এক জটিল গাণিতিক প্রক্রিয়া, সরলভাবেই অসংখ্য মানুষের কানে পৌঁছে এবং তাদের কোরাসে আরও ব্যাপ্তি পায়, -যেন বাতাস, আনাচে- কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে: জন-মানুষ এই কথা শ্রবণে আচমকা ধাক্কায় স্তব্ধ রইলো খানিক এবং ঘোর কাটলে পরবর্তী ধাপে সংবাদদাতা হয়ে পড়ে বিশ্বস্ত।

অতঃপর শ্রবণ ও বিস্ময়-পর্ব অতিক্রান্ত সব মানুষদের উৎসুক্য তীব্রতা পেতেই, ক্রমশঃ ইদ্রিস আলীর একরত্তি উঠোনে ভীড় বাড়ে মেলা লোকের ;আলোচ্য মেয়ে মানুষটি চিত্রার্পিতের ন্যায় কড়িকাঠ ধরে দাঁড়ানো যেন –প্রতিমা। মেয়ে পুরুষের দল বিড় বিড় করে শ্রদ্ধাজ্ঞাপক ভাষা বলে, হয়তো দেখে; ত্রাণ ও উদ্ধার,-- মানুষের অসহায়ত্ব এখন, এই রূপে প্রকাশমান।



একটি বালিকা আগুনে আগুনে ঝলসে গেছে; সাদা ফকফকা মাংশ, অস্থি ভেংচি কাটছে–প্রচণ্ড নির্মম। বালিকাটির মা, আগুনে পোড়া বালিকাটিকে সেই কড়িকাঠের সামনের বারান্দার রেখে, ক্রন্দনে ভেঙে পড়ে আকুলি বিকুলি করে। সকলে অবাক হয়ে দেখলো: প্রতিমা নড়ে ওঠে, স্পর্শ করে অগ্নিদগ্ধ বালিকাটিকে।

ক্রমে মৃত্যুর অমানিশা ফর্সা, মৃত্যু ধুয়ে নিল অনেক মানুষ– তবুও জীবন, এতদ্বসত্ত্বেও ক্ষীণ ধারায় ধীরে ধীরে জাগ্রত, প্রাণস্পন্দিত; আর্তস্বর চাপা পড়ে অসংখ্য মানুষের বেঁচে ওঠা,-- নতুন করে নির্মাণ-কলা; ফসল বোনা, জাল বোনা– সংসারের হাড়ি-চুলোয় পুনরায়,-- ধোঁয়া ;মানুষের নতুন সংগ্রাম।

মেয়ে মানুষটি জরায়ু ছিন্ন করে, অপূর্ণ মানুষ সন্তানকে– মাংশ পিন্ড, নিক্ষেপ করে নিভৃত এক স্থান বিশেষে, –এবং যথাসময়ে বৃষ্টি নামলো সেইদিন, ধুয়ে গেল রক্ত মাংশ দলা।

বুদ্ধিদাতা-ইদ্রিস আলী; ইদানীং তার মেয়ে মানুষটি যেন বড় পয়মন্ত; মেলা লোকজন আসে যায় তার নিকট, দেয় থোয়; ইদ্রিস আলীর আর আকাল নেই, লোকেরাও হাতের নাগালে লাভ করেছে যেন এক দেবী। মেয়েমানুষটিকে পীর মানছে,-- পবিত্র মানুষের পক্ষে সন্তান দান গর্হিত, ইদ্রিস আলী দ্রুত বুঝতে পেরে এমন ব্যবস্থা নেয়।

নারীরা যে শেকড় ছেবড়ে নিষ্কৃতি খোঁজে, তাতেই ঘরের মেয়েমানুষকে বাধ্যকরণ। নির্দিষ্ট দিনে জরায়ুর তার ছেড়া। এবং তৎসময়ে অবিরাম মুশলধারায় বৃষ্টি--সব ভেসে যায়, আবাদক্ষেত্র উর্বরতাকে স্মরণ করে; সন্তানের মাংশ ও রক্ত গ'লে যায়; চারিদিকে নারী পুরুষে আনন্দে চোখ ঝকমকায়, এবং মেয়েমানুষটি তবুও কাঁদে, –কষ্ট টনটনায়, অসাধারণ হওয়ার অসম্ভব যন্ত্রণা। ইদ্রিস আলীরও একটি প্রত্যয় হয় সে একজন পুরুষ এবং যে মানুষটি পীর হিসেবে মান্য তাকে উদোম করে গতর সুখ অসামান্য। মেয়েমানুষটির সন্তান বর্জনের কথা, হত্যার কথা কেউ জানে না; এক্ষণে কোন প্রকার গাণিতিক প্রক্রিয়া অচল।

এক সময়, দেশের উচ্চাসনে মুসলমানরা অধিষ্ঠিত হলো যেমন মুঘলরা একদা বহাল ছিল অতীতে। তবে রাজা-বাদশাহদের কাল অতিক্রান্ত, এখন পাজামা, আচকান ও টুপির প্রবাহ। সাধারণ মানুষ-নৈব নৈব চ। এরই মধ্যে একবার রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা--পুনরায় একজোটে লোক সাফ–মৃত্যু ও বিভীষিকা। দেশ ছাড়লো একদিন ইংরেজরা, দেশেই তখন অনেক সাহেব সুবো। একই দেশে দুই দুই পতাকা উড়লো– ব্যবধান এক রাত্রি। অনেকেরই বোধগম্যের বাইরে রয়ে গেল কখন তাদের বেঁধে রাখা গরুসহ উঠোনটি অন্যদেশে এবং মানুষজনের ঘর আরেকদেশে। অনেক আত্মীয় এমনকি বাবা মা সন্তানও ভিনদেশী। অদ্ভুত এক গোলযোগ পূর্ণ রসায়ন, অবোধ্য। এবং যারা বুঝতে পারলো সার বত্তাটুকু, নিজের পক্ষে অবস্থান নিল সুদৃঢ়। সন্ধানীরা কোপ মেরে ঝোপ বুঝে রাতারাতি লাল। দেশ বিয়োগ অজস্র মানুষের অতীত হরণ করলো নির্নিমেষে। 

জয়তুনকে পালাবদলের ধকলটুকু সহ্য করতে হয় নি এতটুকু। স্বামী বুঝদার মানুষ এবং রাজকর্মচারী গর্বিত। সম্ভাবনার ঘ্রাণ শুকে অনেক পূর্বেই দুই সন্তানসহ জয়তুনকে
মুসলমানদের দেশে পাঠিয়ে নিজেও প্রস্তুত হ'তে লাগলো; নিজে মুসলমান বলে তিনিও তো একটু করে গর্বিত। ঢেপরি ছিল সঙ্গে তার, রান্না করে খাওয়াবার জন্য। একটু একটু করে মালসামানও ওধারে পার।

যে মাত্র দেশের আযাদী, অমনি তৈরি হয়ে রওনা, মাথায় টুপি চড়ালো ওপারে গিয়ে, পাজামা ও চাপকানও অথচ তার পূর্বে মিহি পাড়ের ধুতি শার্টে খাসবাবুটি যেন। গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে,দিন কতক বিশ্রামের পরে, বউ- সন্তান -কেনা বাদী বগলদাবা করে ঢাকা শহরে এখানেই কর্মযোগ: বিশাল শহর হ'তে টিমটিমে এই নগর বা বন্দরে যেন! এখানেই বাঘের লেজের বদলে বিড়ালের মাথায় অধিষ্ঠান। স্বপ্ন ছিলো; বাবু থেকে সাহেব হবে, এইবার সেই মতো টুপি আচকান বাদ, এবং সাহেব কুলের মত স্যুট বুট শরীর জুড়ে ঢলঢল করতে লাগে--অসভ্য।
নতুন অফিস এখানেই স্থাপিত; দেশ ভাগের পর পরই যেমন সব কিছু ভাগাভাগির ধুম, এবং পূর্ব অফিসের চেয়ার টেবিল আলমারী হ'তে পাইটি পর্যন্ত ভাগ করে, মানুষ জন ভাগ হয়ে এখানে আগমন-- অফিস চালু; নিজেরাই রাজা এই আপন ভুবনে। জয়তুন আনন্দিত, বিগলিত, উচ্চ পদস্থ, অহংকারী, মূল্যবান হর্তাকর্তা সুলভ স্বামীকে তৃতীয় বারের মত সন্তান উপহার দিল; দুই কন্যার পর প্রথম পুত্র; স্বামীর আনন্দ এবার দ্বিগুণ বর্ধিত এতদিনে জনক সে গর্বিত। পুত্রের নামকরণ মানিক, যেন সাগর সেঁচে পাওয়া সন্তান, যে কন্যা নয়।

জয়তুনের কাজকর্ম, সন্তান পালনে অপটুত্ব সীমাহীন; তবে কেনা বাদী ঢেপরি কর্মসক্ষম, কুশলা ও সুনিপুণা ফলে অসুবিধা হয় না তেমন। জয়তুন, অতঃপর শুধু পটের বিবি যেমন, সোনাদানা মূল্যবান বেশভূষার মোড়কে নিজেকে গুছিয়ে বসে থাকে, আলমারী খোলে এবং বন্ধ করে, খায় দায় মোটা হয়, গলায় জোর বাড়ে, ক্যাট ক্যাট করে বেশুমার এবং শয্যায় স্বামীর সঙ্গে শুধুমাত্র প্রয়োজনে একমাত্র দায়িত্ব পালন করে সুনিপুণ; জ্ঞাতব্য: স্বামী যদি ইচ্ছা করে তবে সহস্র কর্ম সত্ত্বেও আহবানে সাড়া দিয়ে শয্যায় আনন্দদান-ই বেহেশতের পথ, জয়তুনকে এত বিপত্তি অতিক্রম প্রয়োজন হয় না, যেহেতু ঢেপরি, এমন কি পশুপালন হ'তে শিশু পালন, ঘর গেরস্থি আপ্যায়ন, রন্ধন, কাপড় ধোলাই সমেত যাবতীয় কর্মে পারদর্শী এবং সর্বদা ব্যস্ত। ফলে সুযোগ্যা কেনা বাদীর কল্যাণে জয়তুন ভালোই আছে।

এবং বুকের দুধ জমাট হওয়ার পূর্বেই জয়তুন পুনর্বার পোয়াতি; এবার মাতৃস্তনের সঙ্গে যে সম্পর্ক একমাত্র বহাল ছিল মানিকের এবং সেই সুবাদে কিঞ্চিৎ মাতৃক্রোড়, তাও অতঃপর বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ; আরম্ভ হ'লো ঢেপরি কেন্দ্রিক বয়োপ্রাপ্তি: ঢেপরির নিকট লাভ করে নিদ্রা– আদর-কোল আহারসহ যাবতীয় দেখ-ভাল; শুধু ঢেপরির স্তন জোড়ার সঙ্গে নিগূঢ় সম্পর্ক অনাস্থাপিত যদিও স্পর্শ অপরিচিত নয়।

দেশের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীপদ দিতেই হক-ভাসানী, হক-ভাসানী আওয়াজ সর্বত্র আলোড়িত; ভোটের আগের রাতে এক লীগ নেতা নিজের পক্ষে এক শক্তিশালী পেশী মানুষকে নিয়োগ উদ্দেশ্যে, গ্রামেরই অসহায় তরুণীকে ব্যবহার করলো, পরদিন দলে দলে লোকজন যখন ভোট কেন্দ্র অভিমুখী —নারীটিকে দেখা গেল মেয়ে মানুষ পীরের কৃপা প্রার্থী;রক্ষা চায় মেয়েটি, গতরাতে সর্বস্ব হারিয়েছে, তখনও রক্ত চুয়ে পড়ছে।

বুকের মধ্যে কি যেন ছোবল মারে পীরের; নিজেকে সে পরিষ্কার দেখে; অক্ষমতায় নিজের ভেতর নিজের দংশন-একমাত্র। হাত কামড়ে রেখেছিলো নিজের এবং তা যেন কচ্ছপের কামড়, ধাতস্থ হয়ে মেয়ে মানুষটি যে ইদানীং পীর, সেই হারানো -ভোলানো নারীটিকে কানেকানে শিখিয়ে দেয় অসম্ভব সব কথা; বেঁচে থাকতে হ'লে মহৎ মিথ্যাও প্রয়োজনীয়–এই উপলব্ধিটুকু তার একান্ত নিজস্ব। সে-ই সাপেক্ষেই এমন উচ্চারণ; নারীটি শুনে যায় কথা, মাথা নাড়ে, বাঁচার সম্ভাবনায় দিক প্রদর্শনে পীরের নিকট অবনত হয়, –কৃতজ্ঞতা, যেহেতু এতক্ষণ, এমত সর্বনাশের পর মৃত্যুকেই অনিবার্য জ্ঞান করছিলো– দ্বিধাহীন; পৃথিবীকে পুনরায় নতুন মনে হয় রমণীটির নিকট এবং পীর মেয়ে মানুষটি ভাবে: এই জগৎ মায়াময়, বেঁচে থাকা সুন্দর; মিথ্যা সুন্দর--

নির্বাচন কেন্দ্ৰিক হৈ চৈ, চিৎকার এবং উত্তেজনা এতটা যে, বিয়েবাড়ির উচ্ছ্বাসেও ঢাকনা ফেলে দিতে সক্ষম, তবু জয়তুনের বড় মেয়ের বিয়েতে আনন্দ-উপাচারের তীব্রতাকে চিহ্নিতকরণ সম্ভবপর;জামাই নির্বাচন হয়েছে মিলিয়ে-মিলিয়ে একজন তরুণ উদীয়মান সরকারী খাস কর্মচারীকে, চোখে-মুখে কথায় হাটায় যার শুধুমাত্র উচ্চাকাংক্ষার চমক-ঝমক-গমক।—জয়তুনের মেয়ের সতীচ্ছদ ঘটে গেল, স্বামীর কল্যাণে।

মানিক আশৈশব যেন পুরুষের সংস্পর্শ বিচ্ছিন্ন; তার ভুবনে পুরুষ লোকের অস্তিত্ব অনুপস্থিত; পিতৃ সাহচর্যের বিবেচনায় নিতান্তই ভাগ্যহীন; মায়ের উপস্থিতিও তাৎপর্যশূন্য; বোনদের নিয়ে, এবং ঢেপরি কেন্দ্রিক তার বলয় গঠিত। ফলে বোনের বিয়ে হয়ে গেলে, এবং জগতে সামান্য বিচ্যুতি সত্ত্বেও ঢেপরিকে কেন্দ্র করে নিজস্ব পরিধিতে ভারসাম্য বিদ্যমান। এই ধারাবাহিকতাও অতিরিক্ত কয়েকদিনের মধ্যেই বিনষ্ট, যখন ঢেপরিরও বিবাহ এবং স্বামীর গৃহে পুনর্বাসন।

জয়তুন যথারীতি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, এবং হিমশিম, তার মনস্কতায় ঢেপরির সোমত্ত রূপ কোন প্রকার ভ্রূক্ষেপ রচনা করতে অক্ষম হলেও স্বামীটির নজরে ওঠে –ঠিক। ফলে দ্রুতই একজন দ্বি-গুণ বয়সী পাত্রের নিকট ঢেপরিকে সম্প্রদান, পাত্র অফিসে কাজ করে, পিত্তনের চাকুরী, পূর্বে বিবাহিত এবং সন্তান-সন্ততিও বর্তমান; ঢেপরির মত অমত গুরুত্বহীন-বিয়ে দেয়া হচ্ছে এটাই মূল বিষয়। ফলে ঢেপরি বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা। স্বামী, মরদামি অর্জন করতে সালসা গ্রহণ শুরু করে নিয়মিত। বীর্যপাত দম পায়, এটাও ঢেপরির বড়ই সৌভাগ্য ফলাফল।

মানিকের ইদানীং একাকী দিনকালের সূত্রপাত, এমনিতেই মেয়েলি স্বভাবে দুষ্ট;অনেক লোকের ভীড়ে দমবন্ধ, বেখাপ্পা ও অসংলগ্ন। এবং অস্বাভাবিক। মানুষজনের সঙ্গে স্বাভাবিকতায় অ-মিশুক। ইতিমধ্যে অর্জন করেছে যৌন চেতনা, ফলে এক ধরনের অপরাধবোধ ও গ্লানি ঘূণ ধরায় এবং সে নিজের ভেতর আরও ব্যাপকার্থে –কুণ্ডলীকৃত, গুণ্ঠিত–যদিও অস্থিরতায় ভ্রাম্যমাণ।
বালকটির যথাসঙ্গী জোটে নাই;সব কথাই অনুক্ত; উপচে পড়া কথা ও কষ্ট ভেতরেই জমতে -জমতে শিলীভূত; এবং পাথরের ওজনও ক্রমে বাড়ন্ত। ঢেপরির প্রস্থানের পর বাড়িতে নয়া কাজের লোক নিয়োজিত, ওরা ডাক সাইটে মনিব পুত্র ভয় পায়। অফিসের পিত্তন বাজার করে ওর সঙ্গে বালকটিও পথ ধরে,--পিতার ইচ্ছা পুত্রকে চলনসই করার। দেরীতে হ'লেও পিতাই লক্ষ্য করে পুত্রের এমন ধারার গড়ন ও মনন। ফলে আশঙ্কিত পিতৃপ্রচেষ্টা। এই সুবাদে বাইরের জগতের সঙ্গে বালকটি ক্রমঃ পরিচিত; কিন্তু একাত্মতা দূর স্থ, শুধুই বিকর্ষণ। এই সময়ে শুধু পিওন তসলীমের সঙ্গেই যা কিছু নৈকট্য– অনেক কথা। লোকটি, তাকে সঙ্গে করে আলায়-বালায় ঘোরে অনেক দিন।

বেশ নামী-দামী স্কুলে বালকটি অধ্যয়নরত ;ছাত্রদের ভীড়েও সে নির্জন, কোন বন্ধুও নেই বরং সকলের নিকট হাস্যস্পদ।

উত্তম হাসির খোরাক হয়, ম্যাট্রিকুলেশনের বৎসর, শিক্ষকদের নিকট হতে বিদায় কালে যখন প্রধান শিক্ষকদের নিকট অবনত হয়ে ভুগরে ওঠে:স্যার, আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমাকে আবার ছোট করে দিন, আমি আবার ক্লাস ওয়ান থেকে পড়তে চাই; আমি বড় হ'তে চাই না-

শিক্ষক মহোদয়, আবেগের প্রকাশ হিসেবে ভাবতে গিয়েও পারেন না, বেখাপ্পা অনুভূত হয়,থমকে পড়েন তিনি। উপস্থিত সকলের হাসির যাত্রা যুক্ত হলেও দ্রুত স্তিমিত হয়ে পড়ে –বেশি সময় যায় না; নীরবতা। শিক্ষকমণ্ডলীর মুখ গভীর। ছাত্ররাও পরস্পর মুখ তাকাতাকিতে ব্যস্ত হয় ;ওদের চোখে প্রশ্ন; ঘটনার অস্বাভাবিকত্ব সকলকে স্পর্শ করে। মানিককে, বাসায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা হলো এবং শিগগিরই শিক্ষকরাও, বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক উদ্যোগী হয়ে
পিতাজীর সঙ্গে সাক্ষাত করে বিস্তারিত করলেন–ঘটনাপঞ্জী, এবং এতদিন দেখা মানিক সম্পর্কিত বিশ্লেষণ।

পরবর্তীতে, মানিকের অভ্যন্তরীণ জগৎ উম্মোচিত হলো: মানিকের যৌনতা বোধ অনেকদূর অবধি ধাবিত করেছে তাকে, পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত করেছে, কেড়ে নিয়েছে আলোক উজ্জ্বলতা ফলে ইদানীং শুধু অন্ধকার। তসলীম, বাবার পিত্তন তাকে মাগী বাড়িতে টেনে নিয়ে ছিলো একবার। ওখানে, দু'জনাই ওরা এক নারীর শরীরস্থ হয়, অতঃপর পাপবোধ। আত্মক্ষয় ধাবিত করে তাকে নির্জনতায়, মানুষের সঙ্গে মিশতে গেলেই আত্মপাপের চেহারা তাকে ধাক্কা দিত খাঁদে–যেখানে নিমজ্জমান সে, এতদিন। নিজের নোংরা শরীরকে সে অন্যের সাহচর্য অযোগ্য মনে করত। ভাবতো:সকলে বড় ভালো এবং সে ভয়ানক অশ্লীল। নিজের উদোম শরীর আকড়ে-কামড়ে একাকার করে তাকে। তাই তো, নতুন করে শুরু চায় জীবনের যখন সচেতনতা তাকে আর অপরাধকর্মে তাড়িত না করে অবিরাম বিশুদ্ধতায় অটুট রাখবে নিশ্চয়। মানিকের মস্তিষ্কের ভারসাম্য নষ্ট। - - - যন্ত্রণা; মুক্তি নাই, এমন শূন্যতা।

মানিকের প্রতিকার করার জন্য বিয়ে মনস্থ করা হয় তার চাচাতো বোনের সঙ্গে। এই উপলক্ষে বিশাল আয়োজন। অসংখ্য লোকজনের উপস্থিতিতে কাজী সাহেব বিয়ের পাঠ আরম্ভ করে। সম্মতি প্রদানের সময় মানিক নিশ্চুপ; এই জগতের যেন বাসিন্দা নয়-দূর প্রদেশে অবস্থান। পিতার ঝাকুনি খেয়ে, একবার খর চোখে এবং অফুটে উচ্চারণ করে একটি কথা: রেণু তো আমার বোন! বোনের সঙ্গে বিয়ে হয় না!

চারিদিকে স্তব্ধতা।

আসলে কোথায় যেন তখন ক্ষীণধারায়, যে স্তনে সন্তানের ওষ্ঠ-দাঁত অস্পর্শক, তা থেকে দুগ্ধ গড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে টুপ টুপ টুপ। 

মানিক কান সচকিত করে এবং সিক্ত হয় ক্রমান্বয়ে।

সন্তানগণ ও দুধভাত
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সন্তানগণ ও দুধভাত │ছোটগল্প│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
সন্তানগণ ও দুধভাত │ছোটগল্প│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s16000/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s72-c/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashids-short-story-sontangon-o-dudhbhat.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashids-short-story-sontangon-o-dudhbhat.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy