বস্তুত পক্ষে ‘লিটল’ ও ‘ম্যাগাজিন’ এই দুই শব্দের অভিধেয়ার্থে যদি বোঝার চেষ্টা করি, বাঙালির লিটল ম্যাগাজিনের স্বভাবকে, অনিবার্যভাবে বিভ্রান্তি তৈরি হবে -সন্দেহ নেই। বিভ্রান্তি কীসের! ছোট আর ‘ম্যাগাজিন' অর্থে যদি ‘সাময়িক পত্রিকা’ সাব্যস্ত করি, পদে পদে পিচ্ছিল হয়ে উঠবে অনুভাবনের রাস্তা।
‘সাময়িক’ অর্থে যদি ‘অল্পকাল স্থায়ী’ মনে করি, মেলে না। বরং অনেক বেশি সাযুজ্য পায়, ‘বর্তমান বা চলতি সময়ের প্রসঙ্গ’ -এই অর্থটি। কিন্তু, সেক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা দেখা দেয়। ‘সমসময়’ ও ‘আধুনিক’ এই বিষয় দু’টি এমন সব পেশাদার কাগজেও আলোচিত হয়, তাঁদের স্বভাবের সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন বলতে যা বুঝি, তাদের সঙ্গে একদমই খাপ খায় না। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে কি লিটল ম্যাগাজিন পেশা হয়ে উঠতে পারে না? অবশ্যই পারে। কিন্তু তার গড়ে ওঠাটা পেশাকে লক্ষ্য করে নয়। তাহলে, বিষয়টি কী!
এক ধরণের যোগরূঢ়তা প্রয়োজন হয় বাঙালির লিটল ম্যাগাজিন কী তা বোঝার জন্য। ম্যাগাজিন অর্থে আমরা যদি ‘বারুদখানা’ বা ‘অস্ত্রাগার’ বুঝি, তবেই বোধহয় লিটল ম্যাগাজিনকে বুঝতে সুবিধা হয়। কী অদ্ভুত নয়! যার সঙ্গে সাহিত্যের, শিল্পের সম্পর্ক বলতে সম্পূর্ণ বিরোধীতার, তাকে দিয়েই বুঝতে হবে লিটল ম্যাগাজিনকে!
আসলে, যদি, বাংলার অধুনান্তিক লিটল ম্যাগাজিনের প্রথম উদাহরণ হিসেবে যদি বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকাকে স্থির করি, সহজেই দেখতে পাব, একটি সমান্তরাল রাজনীতির লক্ষেই এই কাগজটি প্রকাশিত হতে শুরু হয়। ‘রাজনীতি’ শব্দের অতিপরিচিত প্রয়োগকে এক্ষেত্রে বোঝাতে চাইছি না। ‘রাজনীতি’ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থকেই এখানেই ধারণ করতে চাইছি। আসলে সে সময় পরিচিত প্রকাশনাগুলিতে কবিতার বিশেষ সম্মান ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে পাদপূরণের জন্য কবিতাকে ব্যবহার করা হতো। এই বিষয়টি স্বভাবতই বুদ্ধদেবের পছন্দ হবে না- বলাই বাহুল্য। তাছাড়া অন্নদাশঙ্কর রায়ের হাতে ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকা দেখেও বুদ্ধদেব বসু প্ররোচিত হয়েছিলেন। ফলত প্রচার মাধ্যমে ব্রাত্য একটি বিষয়কেই প্রধান করে তুলে ‘কবিতা’র প্রকাশ আসলে একধরনের সমান্তরাল রাজনীতির উত্থানের দ্যোতক হয়ে রইল।
এ কথা, অতিকথনের দায় পাবে, যদি বলতে চাই, ব্যাপারটা আর কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। ধীরে ধীরে লিটল ম্যাগাজিন প্রকৃত প্রস্তাবেই হয়ে উঠল প্রতিষ্ঠিত প্রচারের বিকল্প আরেকটি স্বর। একই সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে আসলে গড়ে তোলে কথা চর্চার সিম্ফনি।
প্রসঙ্গে ফেরা যাক, লিটল ম্যাগাজিন আক্ষরিক অর্থেই বিকল্প চিন্তার ধারক। বিকল্প বলতে বোঝাতে চাইছি, সমসময়ে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত চিন্তার বদলে আরেকটি অবস্থান, যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষ তার সমষ্টির দ্রোহ ও প্রেমকে বলতে পারে, বলতে পারে তার যাপন সংক্রান্ত অজনপ্রিয় ধারণাকেও। বলা যায়, সর্বার্থেই প্রতিষ্ঠানের সাপেক্ষে একটি অস্ত্রাগার তো বটেই এই লিটল ম্যাগাজিন। বিপজ্জনক একটি অস্ত্রাগার। কিন্তু, এখানেই প্রতিষ্ঠান জিতে যাচ্ছিল বারবার, এমনকি লিটল ম্যাগাজিনগুলোও আসলে প্রতিষ্ঠানেরই একটি প্রলম্বিত অংশ হয়ে উঠছিল-- ইতিহাস সংরক্ষিত হচ্ছিল না লিটল ম্যাগাজিনের। যেহেতু, লিটল ম্যাগাজিন একজন ব্যক্তি বা কয়েকজন ক্ষমতা থেকে দূরবর্তী মানুষের বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন চিন্তার ফসল, তাই, তাদের সম্মিলিত ইতিহাস সংরক্ষিত হচ্ছিল না। আর ইতিহাস সংরক্ষিত না হলে কোনও গভীরতা তৈরি করতে পারে না, সম্ভ্রম অর্জন করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে।
এতটা ভূমিকা করলাম, একটাই কারণে সন্দীপ দত্তের প্রকৃত গুরুত্বটা অনুভব করার চেষ্টায়। দু’টো দায়িত্ব পালন করলেন বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের হিমদল সন্দীপ দত্ত।
প্রথমত,
লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস সংরক্ষিত হল।
দ্বিতীয়ত,
আক্ষরিক অর্থেই কলেজস্ট্রিটের ঘরটিকে করে তুললেন চিন্তার অস্ত্রের ‘আগার’।
কেবল তো, ঘর তৈরি করে, লিটল ম্যাগাজিনের লাইব্রেরি তৈরি করে দেওয়াটাই শেষ নয়, লিটল ম্যাগাজিনের জন্য প্রতি মুহূর্তে প্রচার ও লিটল ম্যাগাজিনকেই আঁকড়ে বাঁচবার এই তীব্র আর্তি বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে কৈ? সন্দীপ দত্তের জীবন ও কর্মকাণ্ডের ইতিবৃত্ত রচনা করার সক্ষমতা নেই। কেবল একজন লিটল ম্যাগাজিনের কর্মী হিসেবে দেখতে চাইছি, সন্দীপ দত্ত ইতিহাসের রক্ষী হিসেবে কতটা গভীর পর্যন্ত চলে গিয়েছেন! বিচিত্র ধরনের লিটল ম্যাগাজিকে স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখাতেই কি সন্দীপ দত্তের ভূমিকা শেষ?
অনায়াসে, এই লিটল ম্যাগাজিনকে ভর করে বিদেশ-স্বদেশের নানাবিধ সম্ভ্রম আদায় করে নিতে পারতেন সন্দীপ। কিন্তু, লিটল ম্যাগাজিনের গোড়ার কথা ও অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য সাব অল্টার্ন। সেই সাব অল্টার্ন চেতনাকে জীবনেই ধার্য করে ফেলেছিলেন তিনি। কিছুদিন চালিয়ে সরকারের ওপর ভর করার যে চলিত প্রবণতা, তার তীব্র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আগাগোড়া একটা আলাদা ট্রাস্টি বোর্ড গড়ে চালিয়েছেন লাইব্রেরি এবং সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড। শুধু তাই নয়, সম্ভবতঃ মৃত্যুর পরবর্তী ইচ্ছে হিসেবে সরকারের দ্বারস্থও হতে চাননি। মনে রাখতে হবে, এখানে কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সরকারের কথা বলা হচ্ছে না। অথবা, এমন অর্থ নির্মাণের বাসনা নেই, যে, দলীয় রাজনীতির কারণে সন্দীপ দত্তের এহেন অবস্থান। ‘সরকার’ সবসময় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রাহ্য হয়েছে সন্দীপের চেতনায়। যে সবসময় সব স্তরের জনরুচিকে প্রাধ্যান্য দিয়ে চলবে আর জনরুচিকে অনুসরণ করবে। বৃহত্তর জনরুচিকে। এই বৃহত্তর জনরুচির বাইরের যে বিকল্প এবং সম্ভাব্য প্রধান রুচিগুলো রয়েছে, তাকেই যখন ধারণ করছেন, তখনই, স্বাভাবিক বিরোধীর সাহায্য নিয়ে সারভাইভ করতে চাওয়াটা তো এক প্রকার আপোস ও আত্মসমর্পণ। এই জায়গা থেকেই আলাদা হয়ে যান সন্দীপ।
বিনির্মাণ করতে করতে বেঁচে থাকার মধ্যে যে অফুরন্ত তাগিদ রয়েছে, তাতেই বাস করতেন সন্দীপ দত্ত। একজন বই ফেরিওয়ালার পোশাকে আগাগোড়া লিটল ম্যাগাজিনের শ্লোগানে ঢাকা সন্দীপ দত্তকে নাহলে কেন বইমেলা থেকে বইমেলা ঘুরে বেড়াতে দেখতাম! কেন দেখলাম না একবারও আলোর তলায় আরও আলো হয়ে উঠতে! কেন, বারবার সংকীর্ণ হয়ে চলা লাইব্রেরি ঘরটাকে ম্যাজিকে বড় করে ফেলতে পারতেন বারবার! কী বলতে চাইলেন সন্দীপ দত্ত?
দেখুন, লিটল ম্যাগাজিন সন্দীপ দত্তের ‘কর্মজীবনের প্রলেপের মতো’ নয় একেবারেই। জীবনটাকেই লিটল ম্যাগাজিন করে তুলেছিলেন। গোটা জীবনের সমস্ত কাজ দিয়ে কয়েকটা কথা লিখে দিয়ে গেলেন সন্দীপ।লিখলেন, আমরা, যাঁরা, তাঁকে দেখেছি, তাঁদের বোধে, আমরা যাঁরা এই কথা ক’টি হয়তো লিখে যেতে পারব, আমরা যাঁরা দেখিনি তাঁদের জন্য; লিখে গেলেন-- প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকে জীবন্ত চিন্তা শক্তি। যে শক্তি সংগঠিত হয়ে বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ও একদিন নিজে অনিবার্য প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। এই ধারাকে যেমন আটকান যায় না, তেমনই বিকল্প ধারার বহুমুখী স্রোতকেও আটকান’র উপায় নেই। এই অনিবার্য দ্বন্দ্বের পরিস্থিতিতে বৈপ্লবিক রাজনৈতিক চিন্তা তো বেছে নেবে ওই বিপরীতমুখী স্রোতকে। যে প্রতিষ্ঠা পায়নি এবং পায়নি বলেই গতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে চাইছে।
কেবল ঐতিহাসিকভাবে নয়, রাজনৈতিক কারণেও সন্দীপ দত্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বুদ্ধদেব বসু যেমন লিটল ম্যাগাজিনের সূচনার দাবিতে স্বরাট, তেমনই সন্দীপ দত্ত তার ইতিহাস ও অবয়ব নির্মাণের হোতা হিসেবে সমান স্মরণীয়। এবং সন্দীপ দত্তের জীবন ও লিটল ম্যাগাজিন গ্রন্থাগার সংক্রান্ত কাজ সমস্তই রাজনৈতিক আধুনিকতার সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পর্ক ও তার স্বভাবকে সংজ্ঞা দেয়। সন্দীপ দত্ত আসলে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা।
লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা
সব্যসাচী মজুমদার
সব্যসাচী মজুমদার
মন্তব্য