লিটিল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ, গবেষক ও সংরক্ষক শ্রী সন্দীপ দত্ত (১৯৫১-২০২৩) বাংলা সাহিত্য জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি হয়তো নয়নের সন্মুখে এখন নেই, কিন্তু তিনি ঠাই নিয়েছেন হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। নক্ষত্রের উজ্জ্বল আলো নিয়ে আসা আলোর পথিক তিনি। স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে নিয়ে আসা—প্রমিথিউস, আমাদের সন্দীপ দত্ত। তাঁর মতো করে আগে তো কেউই ভাবেননি, আস্তাকুড়ের সম্পদ হতে যাওয়া লিটল ম্যাগাজিন। তিনিই তাকে দিয়েছেন— যোগ্য সম্মান, যোগ্য স্বীকৃতি। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে তিনি ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন “সাময়িক পত্র পাঠাগার" নামক একটি গ্রন্থাগার যেটা পরে ১৯৮৫ সালে তার নাম পাল্টিয়ে “লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি"। যেখানে বহু ছাত্র-ছাত্রী তাদের গবেষণামূলক তথ্য সংগ্রহ করতে পারত শুধু তাই নয় এই লাইব্রেরির সাহায্য নিয়ে অনেক গবেষক তাদের পি-এইচ, ডি.র কাজ সফলভাবে সম্পূর্ণ করেছেন। সন্দীপ দত্ত নিজেও তাদের সমস্ত দিক থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই লাইব্রেরীতে ৭০ থেকে ৯০ হাজারেরও বেশি সংখ্যক পত্রপত্রিকা, ৫০০০ কবিতা গল্প প্রবন্ধের বই সেখানে স্থান পেয়েছে। এই প্রসঙ্গে মদন গোপাল গোস্বামী লেখেন— “গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁকে অনেকবার দেখেছি, তাঁর বহ কথা শুনেছি। কখনও মনে হয়েছে তিনি যেন এক মালাকার। তাঁর ভাব-সুতোয় ওপার বাংলা জুড়ে যে যেখানে ছোটপত্রিকা নিয়ে কাজ করছে, সকলকে গেঁথে এক উজ্জ্বল বহুবর্ণের মালা গেঁথে ফেলেছেন। এ মালা চির অমলিন থাকবে। আমি তাঁর টেমার লেনের বাড়িতে গেছিলাম। … কলকাতার পাতিরাম এবং সন্দীপদার বাড়িতে গিয়ে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া! বাড়িটার নাম হতে পারে ‘লিটল ম্যাগাশ্রম’। কত শত পত্রিকা সেখানে পাশাপাশি বসে গল্প করছে, একে অপরকে নিজের দুঃখ-বেদনার কথা শোনাচ্ছে— ‘আমার সম্পাদক কত কষ্টে, তিল তিল করে এক একটি টাকা জমিয়ে, কর্জ নিয়ে, ভিক্ষে করে আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন জানিস।’
অথবা,
‘তোর মূল বাড়ি কোথায় ছিল রে? এই আশ্রমে আসার আগে কোথায় ছিলিস?’
‘আরে, বলিস না ভাই। আমি উত্তর-পূর্বের এক সুদূর কোণে জন্মেছিলাম। মুনিবর সন্দীপ দত্ত এই আশ্রমে ঠাই না দিলে, কোথায় হারিয়ে যেতাম! কেউ আর আমাকে খুঁজেই পেত না। অনাথ হয়ে যেতাম।’ (মদনগোপাল গোস্বামী, ‘লিটল ম্যাগ-এর মুনি’, ‘মানবী …অক্ষয় সন্দীপ’, সম্পাদক: শর্মিলা দত্ত, কাছাড় নেটিভ জয়েন্ট স্টক কো. ক্লাব রোড, শিলচর, আসাম, ৭৮৮ ০০১, সপ্তদশবর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, এপ্রিল-জুন, ২০২৩, পৃ-১০১-১০২)
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে— বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, শিলচর, ধানবাদ, জামশেদপুর, কানপুর ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জেলার পত্রপত্রিকার বাসস্থান এই টেমার লেন। প্রতিটি জেলার জন্য আলাদা আলাদা র্যাক। পত্রিকার নাম এমনকি প্রকাশকালের পরম্পরা মেনে প্রতিটি সংখ্যা থরে থরে সাজানো। আরও মজার ব্যাপার কোন সংখ্যায় কী বিষয়, বিশেষ সংখ্যা হলে বিশেষ সংখ্যার বিশেষত্ব বা মৌলিকত্ব, সব তার মুখস্ত, কণ্ঠস্থ। সেই পত্রিকার সম্পাদক মহাশয়ও দু’বছর আগেকার পত্রিকার ক্রোড়পত্র কী ছিল বলতে পারবেন না হয়ত, কিন্তু পারতেন সন্দীপ দত্ত। পত্রপত্রিকার বিষয়, সংখ্যা নিয়ে একেবারে আপডেট থাকতেন। কলকাতার পাতিরাম থেকে নিজের পয়সায় বই কিনে নিজের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে রাখতেন। অদ্ভূত এক দায়বদ্ধতা নিয়ে আমাদের এই দেশে জন্মেছিলেন সন্দীপ দত্ত। পেশাগত জীবনে সিটি কলেজিয়েট স্কুলের বাংলার শিক্ষক। লিটল ম্যাগাজিন তার ধ্যান-জ্ঞান, সমস্ত আবেশ—অনুভূতি, ভাললাগা আর আজন্ম ভালবাসা নিয়ে জন্মানো অল্পবিস্তর মনীষীদের মধ্যে সন্দীপ দত্ত অবশ্যই একজন। কবিমনোভাবাপন্ন এই মানুষটি লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের কাজে জীবনের সবটা সময় ব্যয় করেছেন। কারণ এটা ছিল তাঁর স্বপ্ন-সাধনা। এর জন্য অপরিমেয় সময় তিনি ব্যয় করেছেন। কিন্তু এরই মাঝে যেটুকু বাড়তি ঝরতি সময় পেয়েছেন সেই সময়ের কাজটুকুও ঈর্ষণীয়। তিনি কবিতা লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, রম্যরচনা লিখেছেন, সমালোচনা, প্রবন্ধ লিখেছেন। সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু রচনা হল— ‘কবিতা কোলাজ’ (১৯৭৪), ‘স্ল্যংগুয়েজ’ (২০০০), ‘ভুবনেশ্বরী’ (২০০২), ‘বিবাহ মঙ্গল’ (২০০২), ‘বহতা’ (২০০৪), ‘আলুতং ফালুতং’ (২০১১), ‘নষ্ট logi’ (২০২২) ইত্যাদি। আর সংকলিত গ্রন্থের মধ্যে বিশেষ উল্লেখিত: ‘বাংলা গল্প কবিতা আন্দোলনের তিন দশক’ (১৯৯৩) । এছাড়াও তিনি চারটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, যেমন— ‘পটপুত্র’ (১৯৭০), ‘হার্দ্য’ (১৯৮৭-৮৯), ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ (১৯৯০), ‘All India Little Magazine Voice’ (২০১০-১১)। এবং কিছু গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন, সেগুলো হলো—‘জীবনানন্দ প্রাসঙ্গিকী’ (১৯৮৪), ‘গল্পের কোলাজ’ (১৯৯০), ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়: জীবন ও সাহিত্য’ (১৯৯৫), ‘বাংলা ভাষা বিতর্ক’ (২০০৪), ‘জন্মদিন-জন্মদিন’ (২০০৭), ‘লিটল ম্যাগাজিনে দেশভাগ’ (২০১৯), ‘ফিরে দেখা: মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ (বাংলা আকাদেমি, সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলা ২০২৩)। শুধু তাই নয়, সন্দীপ দত্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ পঞ্জি নির্মাণ এবং প্রকাশ করে গেছেন। যেমন— ‘ভারতীয় সংস্কৃতি নিগ্রহের ইতিহাস’ (১৯৮৩), ‘বাংলা কবিতার কালপঞ্জি’ (১৯৯০), ‘বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় কালপঞ্জি’ (১৯৯৪), ‘শঙ্খ ঘোষের রচনাপঞ্জি’ (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ২০২২)।
শ্রী সন্দীপ দত্ত কালের কষ্টিপাথরে লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি তার নিখাদ প্রেমের স্বাক্ষর রেখে গেছেন এভাবেই। সন্দীপ দত্ত সম্পর্কে সম্প্রতি ‘বার্তালিপি’ দৈনিকে সন্দীপ দত্তের স্মৃতিচারণে বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক সুশান্ত কর লিখেছেন— “ব্যক্তিগত জীবনে অতি সামান্য মানুষটি অসামান্য সব কাজ করে গেছেন। গুরুচন্ডালিতে প্রকাশিত জয়িতা ভট্টাচার্যের নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানতে পারছি ৪৫ বছর ধরে ৯০ হাজার লিটল ম্যাগাজিন সহ ৫০০০ কবিতা গল্প-প্রবন্ধের বই তিনি যোগাড় করে আঁকড়ে ধরে বসেছিলেন....।” বাংলা সাহিত্য আর লিটল ম্যাগাজিনকে এই প্রগাঢ় ভালবাসার এইরকম নজির আমাদের দেশে সন্দীপ দত্ত ছাড়া দ্বিতীয় কেউ ছিলেন বলে অন্তত আমার জানা নেই। ব্যক্তিগত জীবনে খোলামেলা এই মানুষটি নিজের পরিবার, সন্তান নিয়ে কোনদিন সেরকমভাবে ভাবিত ছিলেন বলে মনে হয় না। তাঁর সন্তান কী করেন, কোথায় থাকেন—সেইরকম একান্ত পারিবারিক কথাও কোনদিন কারো নজরে আসেনি, বা তিনি কোনদিন প্রকাশ্যে আনেননি। পত্রিকা সাধনার জন্য তাঁর জন্ম, পত্রিকা অন্তপ্রাণ পৃথিবীর আর কোন মানুষের সঙ্গে তাঁর তুলনা এখন অব্দি নেই। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রাঙ্গনে তিনি লিটল ম্যাগাজিন মেলার আয়োজন করেছিলেন। দূর-দূরান্ত থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সমস্ত লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকেরা সেদিন বাংলা আকাদেমি চত্বরে তারা সম্মানীত হয়েছিলেন, এবং সেই ধারা এখনও বহমান। সন্দীপ দত্ত নিজে মেলে প্রাঙ্গনে ‘লিটল ম্যাগাজিন পড়ুন, লিটল ম্যাগাজিন বাঁচান’ লেখা কাগজের টুপি পরে লিটল ম্যাগাজিনের চলমান বিজ্ঞাপন হতেন। সাহিত্যের মূলধারার পাশাপাশি যে লিটল ম্যাগাজিনের একটা ধারা অনেকদিন ধরে বয়ে চলেছে, এবং সেই ধারাটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে হয়ে চলেছে—সেই বার্তাটিও সন্দীপ দত্ত দেওয়ার প্রয়াস করেছিলেন। আমাদের দেশে বাণিজ্যিক এবং অবাণিজ্যিক নানাবিধ লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ এবং প্রচারের ধারা অনেক দিন ধরে চলে আসছে। সাধারণভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনের কোন নিশ্চয়তা সেভাবে এদেশে নেই। কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক। শখের বশে বা অত্যন্ত প্রয়োজনে একটি সংখ্যা প্রকাশের পর একদিন সবার চোখের বাইরে সেই পত্রিকা চলে যায়। সন্দীপ দত্ত সেই ইতিহাসের নির্মাতা। একটি দু’টি যেমন সংখ্যা হোক না কেন—তিনি সেটাকেও যথাযোগ্য সম্মানে মাথায় তুলে নিয়েছেন এবং তাকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। জেলায় জেলায় লিটল ম্যাগাজিন মেলায় তিনি পৌঁছে যেতেন। আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশেও তিনি লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে গেছেন। কবি, গল্পকার, গবেষকদের তিনি পুরস্কার দিয়ে সম্মানীত করেছেন। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক মহাশয়দেরকেও সাদরে সম্মানের আলোয় নিয়ে এসেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন নানাভাবে। যারা তার কাছে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ বা পথ নির্দেশিকা চেয়েছেন সাগ্রহে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক, গবেষকদের জন্য তাঁর হৃদয়ে জায়গা ছিল সবসময়। আসলে তিনি একজন স্কুলের মাস্টারমশাই; সেই গুণের জন্যই তিনি তাঁর সাধ্যমত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পেরেছেন। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে হবে’ —সন্দীপ দত্ত সেই কাজে বড় হওয়া এক প্রতিভার নাম। হয়ত তাঁর ফোন নম্বরে এখন ফোন করলে রিং বেজে যাবে– কিন্তু ফোনের ওপার থেকে সেই ভারী মিষ্টি কণ্ঠে ভেসে আসবে না, “নমস্কার, আপনি কে বলছেন?” ১৮এম টেমার লেন থাকবে, শিল্পী শুভাপ্রসন্নের আঁকা ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাগার’ থাকবে পাঠকের মনে আপামর লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের মনের মণিকোঠায়।
সন্দীপ দত্ত : এক স্বপ্ন-সাধক
স্বাগতা বিশ্বাস
স্বাগতা বিশ্বাস
মন্তব্য