
ভূমিকা
কবি ফার্নান্দো আন্তোনিও নোগুয়েরা পেসোয়া পর্তুগালের লিসবনে জন্মগ্রহণ করেন। পেসোয়া পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে চলে যান। তবে ১৯০৫ সালে স্থায়ীভাবে পর্তুগালে ফিরে আসেন। তিনি লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংক্ষিপ্ত পড়াশোনা শেষে সমালোচনা, গদ্য এবং কবিতা প্রকাশ শুরু করেন এবং বাণিজ্যিক অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন। পেসোয়ার বেশিরভাগ সৃজনশীল রচনা কেবল জার্নালে প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালে, যে বছর তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়, পেসোয়া তিনটি প্রধান সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব বা ভিন্ন নাম খুঁজে নেন: আলবার্তো কাইরো, একজন গ্রামীণ, অশিক্ষিত কবি যিনি মুক্ত ছন্দে লিখেন; রিকার্ডো রেইস, একজন চিকিৎসক যিনি হোরেসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আনুষ্ঠানিক গীত রচনা করেন; এবং আলভারো ডি ক্যাম্পোস, একজন দুঃসাহসিক লন্ডন-ভিত্তিক নৌ প্রকৌশলী যিনি কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান এবং ইতালীয় ফিউচারিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত হন। পেসোয়া তার নিজের নামেও লেখা প্রকাশ করেন। পেসোয়া একাই তার ভিন্ন নামগুলিকে তার নিজের থেকে আলাদা পূর্ণ জীবন দেন, প্রতিটি ব্যক্তির মনোবিজ্ঞান, নান্দনিকতা এবং রাজনীতি নির্ধারণ এবং গ্রহণ করেন। নমনীয়, গতিশীল হিসেবে পরিচয়ের প্রতি পেসোয়া দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন। লেখকত্ব এবং ব্যক্তিত্বের ঐতিহ্যবাহী ধারণাকে পেসোয়া প্রত্যাখ্যান করেন, এর মধ্য দিয়ে তিনি উত্তর-আধুনিকতাবাদী আন্দোলনেরও পূর্বাভাস দেন।
পেসোয়া বার্নার্ডো সোয়ারেস নামে এক কাল্পনিক লেখককে তৈরি করেন, যার বিস্তৃত, অবাধ কাল্পনিক জার্নালটি ২০ বছর ধরে লেখা হয় এবং তার মৃত্যুর পরে জগৎখ্যাত ‘দ্য বুক অফ ডিসকুয়াইট’ বা ‘অস্থিরতার বই’ হয়ে ওঠে।
পেসোয়া ১৯৩৫ সালে লিসবনে লিভার সিরোসিসে মারা যান এবং তার মৃত্যুর পরেই তার কাজ ব্যাপক প্রকাশনা এবং প্রশংসা অর্জন করে। প্রখ্যাত সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুম ‘দ্য ওয়েস্টার্ন ক্যানন’-এ পশ্চিমা সাহিত্যের মানদ- প্রতিষ্ঠায় মাত্র ২৬ জন লেখকের একজন হিসেবে পেসোয়াকে অন্তর্ভুক্ত করেন।
সংবেদনবাদ ইশতেহারের জন্ম হয় ১৯১৪ সালে এবং তা ফার্নান্দো পেসোয়া এবং তার বিভিন্ন লেখক নামের সীমা অতিক্রম করে তরুণদেও মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৪ সালের বসন্ত নাগাদ লেখকদের একটি ছোট দল পেসোয়ার চারপাশে জড়ো হন। তবে তিনি আসলে তাদের নেতা ছিলেন না, কারণ নেতৃত্ব তার ব্যক্তিত্বের সাথে খাপ খায় না। কিন্তু তারা ঠিকই তার নীরব অনুসারী হলেন, তার প্রতিভাকে চিনতেন এবং তা থেকে শিক্ষা নিতেন। এবং তাদের কিছু ধারণা নিঃসন্দেহে তার তৈরি সাহিত্যিক মতবাদের মধ্যে মিলে যায়। তারা ক্যাফেতে মিলিত হতেন, সেখানে তারা আলোচনা করতেন, একে অপরকে তাদের লেখা দেখাতেন এবং কীভাবে নিজেদের এবং তাদের আন্দোলনকে সর্বোত্তমভাবে চালু করা যায় তার পরিকল্পনা করতেন। এর মধ্য দিয়েই পর্তুগালে ইউরোপীয় আধুনিকতার যাত্রা শুরু হয়েছিলো।
সংবেদনবাদ
ফার্নান্দো পেসোয়া
অনুভূতি হলো সৃষ্টি করা। কিন্তু অনুভূতি কী?
অনুভূতি হলো ধারণা ছাড়াই চিন্তা করা, তাই বোঝা, যেহেতু মহাবিশ্বের কোনও ধারণা নেই।
মতামত ধারণ করা মানে অনুভূতি নয়।
আমাদের সমস্ত মতামত অন্য মানুষের কাছ থেকে আসে।
চিন্তা হলো আমরা যা অনুভব করি তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছা।
আমরা যা চিন্তা করি তা কেবল অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। আমরা যা অনুভব করি তা প্রকাশ করা যায় না। আমরা যা অনুভব করি তার মূল্য কেবল আমরাই জানাতে পারি। আমরা যা করতে পারি তা হলো কাউকে আমাদের অনুভূতি অনুভব করানো। আমরা পাঠককে একই জিনিস অনুভব করাতে পারি না, কিন্তু যদি সে একইভাবে অনুভব করে তবে তা-ই যথেষ্ট।
অনুভূতি কারাগারের দরজা খুলে দেয় যেখানে চিন্তা আত্মাকে আবদ্ধ করে।
স্বচ্ছতা কেবল আত্মার দ্বারপ্রান্ত পর্যন্তই পৌঁছানো উচিত।
অনুভূতির পূর্ববর্তী কক্ষেও স্পষ্টতা নিষিদ্ধ।
অনুভব করা মানে বোঝা। চিন্তা করা মানে ভুল করা। কেউ কী ভাবছে তা বোঝা মানে হলো তার সাথে একমত না হওয়া।
কারো অনুভূতি বোঝা মানেই তার মতো হওয়া।
অন্য কেউ হওয়া অধিবিদ্যকভাবে বেশ কার্যকর। ঈশ্বর হলেন প্রত্যেকের।
দেখুন, শুনুন, ঘ্রাণ নিন, স্বাদ নিন, অনুভব করুন- সেগুলিই ঈশ্বরের একমাত্র আদেশ। ইন্দ্রিয়গুলি ঐশ্বরিক, কারণ তারাই আমাদের ব্রহ্মা-ের সাথে সম্পর্ক, এবং ব্রহ্মাণ্ডের সাথে আমাদের সম্পর্কই ঈশ্বর।
অদ্ভুত মনে হলেও, অনির্দিষ্টভাবে সম্ভব চোখ দিয়ে শোনা, কান দিয়ে গন্ধকে দেখা, শোনা আর এর স্বাদ গ্রহণ, রঙ এবং শব্দের স্বাদ গ্রহণ, স্বাদ শোনা ইত্যাদি। এর জন্য কেবল অনুশীলনের প্রয়োজন।
অভিনয় হলো অবিশ্বাস। চিন্তা করা হলো ভুল। কেবল অনুভূতিই হলো বিশ্বাস এবং সত্য।
আমাদের অনুভূতির বাইরে কিছুই নেই। এই কারণেই অভিনয় আমাদের চিন্তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা- আমরা সঠিকভাবে বললে চিন্তা হিসেবে এর বিশ্বাসঘাতক হইনি।
রাজনীতি হলো সমাজ পরিচালনার শিল্প যখন কেউ জানে না কীভাবে তারা পরিচালিত। রাজনৈতিক ধারণা থাকা হলো কোনও ধারণা না থাকার সবচেয়ে সহজ উপায়। রাজনীতি হলো কোচ হওয়ার জন্য জন্ম নেওয়া মানুষদের একটি ভুল ধারণাবশত অহংকার। সমাজকে শাসন করার একমাত্র উপায় হলো অন্য সকলকে অবজ্ঞা করা। ভ্রাতৃত্ববোধের জন্ম হয় পারস্পরিক অবজ্ঞা থেকে।
অপ্রয়োজনীয় মিথ্যার মধ্যে সবচেয়ে নিচুমানের মহত্ব হলো প্রগতি। এমনকি ‘প্রগতির ধারণা’ না থাকলেও, আমরা অগ্রগতি বন্ধ করে দেব।
সংবেদন বস্তুর আকাঁবাঁকা রেখায় সরাসরি লেখে।
সংবেদন হলো সেই অতল পাত্র যেখানে ‘সমালোচনা’ তার ডানাইডীয় ভূমিকা পালন করে।* ব্যক্তিত্ব অক্ষয়, কারণ জন্মগ্রহণকারী প্রতিটি ব্যক্তিই এতে যোগ করে। যুক্তি হলো আসলে শূণ্যতা বা কিছুই-না’র চারপাশে একটি বেড়া।
আমাদের অভিজাত কর্তব্য হলো যারা কাজ করে এবং সংগ্রাম করে তাদের ঘৃণা করা, যারা আশা করে এবং বিশ্বাস করে তাদের পরিহার করা এবং সকল আত্মত্যাগীকে অবজ্ঞা করা।
ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা হলো একটি সিঁড়ি গড়ে তা দিয়ে ভেঙে পড়া প্রাচীর বেয়ে ওঠার মতো। এটি আকর্ষণীয়, কারণ অযৌক্তিক, কিন্তু কেবল বিরক্তির যোগ্য কারণ এটি বিরক্তির যোগ্যই নয়।
সত্যের একমাত্র ভিত্তি হলো স্ব-বিরোধ। মহাবিশ্ব নিজেরই বিরোধিতা করে, কারণ এটি চলে। জীবন নিজেরই বিরোধিতা করে, কারণ এটি মারা যায়। প্যারাডক্স হলো প্রকৃতির আদর্শ।
এই কারণেই সকল সত্যের এক বিপরীতমুখী রূপ রয়েছে।
এই সকল নীতি সত্য, কিন্তু বিপরীত নীতিগুলিও ঠিক ততটাই সত্য। (নিশ্চিত করা মানে ভুল দরজা দিয়ে যাওয়া।) চিন্তা করা মানে সীমাবদ্ধ করা। যুক্তি মানেই বাদ দেওয়া। অনেক কিছু আছে যা নিয়ে চিন্তা করা ভালো কারণ অনেক কিছু আছে যা সীমিত করা বা বাদ দেওয়া ভালো।
রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রচারকরা....... প্রচার করো না ভালো কিংবা মন্দ, পুণ্য কিংবা পাপ, সত্য কিংবা ভুল, দয়া কিংবা নিষ্ঠুরতা। পুণ্য প্রচার করো না, কারণ এটাই সকল ধর্ম-প্রচারক প্রচার করেন, এবং পাপ প্রচার করো না, কারণ এটা তারা সকলেই অনুশীলন করে।
পুণ্য প্রচার করো না, কারণ কেউ জানে না এটি কী, এবং ভুলত্রুটি প্রচার করো না, কারণ এটি করে তুমি সত্য প্রচার করবে। নিজের কথা প্রচার করো, সমগ্র বিশ্বের কাছে জোরগলায় চিৎকার করে বলো। ওটাই একমাত্র সত্য এবং একমাত্র ভুল, একমাত্র নৈতিকতা এবং একমাত্র অনৈতিকতা, ......যা তুমি প্রচার করতে পারো, প্রচার করা উচিত এবং প্রচার অবশ্যই করতে হবে।
নিজেকে আন্তরিকভাবে প্রচার করো, কেলেঙ্কারি এবং জাঁকজমকের সাথে। তুমিই একমাত্র তুমি। ময়ূরের মতো হও, বড় হও, অন্য সবার চেয়ে মাথা উঁচু করে থাকো।
তোমার আত্মাকে একটি অধিবিদ্যা, একটি নীতিশাস্ত্র এবং একটি নন্দনশাস্ত্রে পরিণত করো। নির্লজ্জভাবে ঈশ্বরের পরিবর্তে নিজেকে স্থাপন করো। এটাই একমাত্র প্রকৃত ধর্মীয় মনোভাব। (ঈশ্বর সর্বত্র আছেন, কেবল নিজের মধ্যে ছাড়া।)
তোমার সত্তাকে একটি নাস্তিক ধর্মে পরিণত করো, তোমার অনুভূতিগুলিকে একটি আচার এবং একটি রীতিতে পরিণত করো। নিজের মঠের সুবিশাল বারান্দায় নিখুঁতভাবে [...] বেঁচে থাকো তুমি।
নিজেকে ক্রমাগত প্রতিস্থাপন করো। তুমি নিজের জন্য যথেষ্ট নও। সর্বদা অপ্রত্যাশিত হও, এমনকি নিজের কাছেও। নিজেকে তোমার চোখের সামনে ঘটতে দাও। তোমার অনুভূতিগুলিকে আকস্মিক ঘটনার মতো হতে দাও, এমন অ্যাডভেঞ্চারে যাও যেখানে তুমি হোঁচট খেয়েছ। শ্রেষ্ঠ হওয়ার একমাত্র উপায় হলো একটি আইনহীন মহাবিশ্ব হওয়া।
অস্তিত্ব অপরিহার্য নয়; যা প্রয়োজন তা হলো অনুভব করা। মনে রেখো যে এই শেষ বাক্যটি সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক। একে তোমার সম্পূর্ণ হৃদয় দিয়ে না বোঝার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করো।
এগুলো হলো সংবেদনবাদের মৌলিক নীতি। বিপরীত নীতিগুলোও সংবেদনবাদের মৌলিক নীতি।
সংবেদনবাদের ইশতেহার
ফার্নান্দো পেসোয়া
ভাষান্তর: রথো রাফি
ফার্নান্দো পেসোয়া
ভাষান্তর: রথো রাফি



মন্তব্য