.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : শেখ ফিরোজ আহমদ

এই উপন্যাস আমার অবলোকিত জীবনের আলোকিত ঘটনার উপাখ্যান। নারী-পাঠ হয়ে উঠল শেষ পর্যন্ত মেঘ তাড়িয়ে আকাশ দেখার মুহূর্ত। লিখতে মাকে পেয়েছি, খুঁজে পেয়েছি নারীগণকে : ইলেক্ট্রা থেকে গাইনোকোলজি, এনাটমি থেকে সেক্স সাইকোলজি ও ফিজিক্স। 

শরীর। শরীর। 
তোমার মন নাই কুসুম।
পদ্মা নদীর মাঝি—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই আলোকপাতের এন্টিথিসিস আমার এই লেখা গড়ে তুলেছে সিনথেসিস। চতুষ্কোণে দরকার পড়েছিল বহু নারীর। তাদের ভেতর দিয়ে দেখাটার মধ্যে সত্তার বিভাজনের প্রতিপক্ষে যে নারী গড়ে উঠলো তাকে দেখলাম মেনোপজের পর বিরতিসূচক পজ দিয়ে হয়ে পড়ল স্পর্শ-আলিঙ্গন-রতিমিলন-শৃঙ্গারের ভায়োলিন, সেই তার অর্কেস্ট্রা উৎপাদন ক্ষমতার বাইরে এসে পেয়ে গেল সত্তার ভেতরে এমন অগ্নিকান্ড যা তাকে পুরাণ থেকে এনে তুলে লোকায়ত পেশীর সঙ্গে নিজ জংঘার উত্থান পর্বে।

রাষ্ট্রে গুম খুন হয় মানুষ অথচ নারীর শরীরী ভাষাকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ খুন গুম করে, কোন প্রতিবাদ কেউ করে না।.. এই উপন্যাস লিখতে লিখতে শিখেছি অনেক। উপন্যাসটি নারী-পাঠ, শরীরের রসায়ন, সেই ভাষার ব্যাকরণ।

মেঘ দে পানি দে, সঙ্গীতের মূর্ছনা এই উপন্যাস।
মনু বলেন, নারী হলো ভূমি। পুরুষ হলো বীজ। তাই পাপ কোথায়?
এই উপন্যাস সেই উপন্যাস।"
                  –সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ

এক. উর্বরতা ও উর্বরা শক্তির সন্ধানে

নির্মাণ কৌশলে এই উপন্যাস প্রচলিত ধরনের নয়। এটি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ভিন্ন ধাঁচের সৃষ্টি। দীর্ঘদিন কথাসাহিত্য নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন বা কাজ করেছেন–‘কুসুম কথা অমৃত’ নামের এই উপন্যাসটি তাঁর সেই আপন মগ্ন ভুবনের তেমন একটা অনন্য নমুনা। উপন্যাসের ভিতরে ঢুকবার আগে লেখকের মনোগড়ন কী  রকম ছিল তা খানিকটা দেখে নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে।  যাতে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের লেখক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রভাবসঞ্চারী পারিপার্শ্বিকতা, প্রস্তুতি পর্ব, দার্শনিক ভাবনার রূপান্তর, সিরিয়াসনেস ও আত্মনিবেদনের চিত্র পাঠকের অনুসন্ধিৎসায় ধরা পড়ে।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ চল্লিশ বছরের ‘জার্নিম্যান’। একদা লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। কাগজ কলম দিয়ে লেখালিখির জার্নি শুরু হলেও এখন কম্পিউটার কীবোর্ড টিপে লিখে চলেছেন। রিয়াজুরের জন্ম পাকিস্তানের উপনিবেশিককালে। শিশুবেলায় বর্ণ চেনার হাতেখড়ি ঘটে কালো শ্লেটে পেন্সিল মকশ করে। তারপর বানান করে পড়া, অক্ষর লেখা, শব্দ ও বাক্য রচনা। কোনোধরনের কাগজ নাগালের মধ্যে পেলেই অসীম উৎসাহে হস্তাক্ষর চর্চা–এসবই ছিল প্রারম্ভিকে। পরবর্তী সময়ে নতুন আকর্ষণের সূচনায় তিনি অক্ষরজ্ঞান থেকে গ্রন্থজ্ঞানে তাড়িত হন। বাবা অনেক বই পড়তেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাসায় বাবার আলমারি ভরতি ছিল রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং রাশান আর চায়নার বই। একরাতে বস্তায় ভরে সেগুলো অজ্ঞাত স্থানে সরানো হলো। ভয়ে ভয়ে সবাই বলত মালাউন লেখকদের বই পেলে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে। বাবার বিষণ্ন মুখ দেখে রিয়াজুরের মনে প্রথম বইয়ের শক্তি সম্পর্কে ধারণা জন্মায়। প্রশ্নও তৈরি হয় মনে–এতকিছু থাকতে বই কেন? বই কি অস্ত্র? বই কি বোমা?
মুক্তিযুদ্ধের পর রিয়াজুরকে গোগ্রাসে আউট-বই পড়ার নেশা পেয়ে বসল। তখন ঢাকার বইপাড়া ছিল স্টেডিয়ামে। কথা, আইডিয়াস পরবর্তীকালের ম্যারিয়েটা, প্রভিনশিয়াল বুক ডিপো ও স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সসহ কয়েকটি বইয়ের দোকান ছিল এখানে। বিকেলে বাবার সঙ্গে স্টেডিয়ামে যাওয়ার সময় এই জায়গাটার সামনে এলে তার চলার গতি মন্থর হয়ে যেত। বাবা বই-ম্যাগাজিন কিনে না দিলে নড়তেন না। রিয়াজুরের মা ছিলেন বড় স্টোরি টেলার–যে কোনো ঘটনা সুন্দর করে বলতে পারেন। রিয়াজুরের গল্প লিখবার প্রতি তীব্র আকর্ষণের পিছনে হয়তো মায়ের এই গল্প বলার প্রভাবটাই বেশি কাজ করেছে। যে কারণে জন্ম নিয়েছেন নিরীক্ষাধর্মী গল্পকার সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ।    
ম্যারিয়েটার হাত ধরেই রিয়াজুরের পরিচয় ঘটে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে। প্রথাগত সাহিত্য আর নতুন ধারার সাহিত্য ও লেখকদেরও তিনি একটু একটু করে চিনে নিয়েছেন। ততদিনে সংবাদ, ইত্তেফাক, কিশোর বাংলা প্রভৃতি কাগজে ছোটদের জন্য অল্পবিস্তর লিখেছেন। নটরডেম কলেজে পড়ার সময় থেকেই মূলত বড়দের জন্য লেখালেখির শুরু। আরো একটু বড় হওয়ার পর দৈনিকের সাহিত্য পাতা থেকে রিয়াজুর নিজেকে সরিয়ে নিলেন। বলা যায় সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ বদলে গেলেন–হয়ে উঠলেন পুরোপুরি লিটল ম্যাগের লেখক। লিটল ম্যাগ ‘সংবেদ’, ‘অনিন্দ্য’, গান্ডীব-এ তাঁর গল্প ছাপা হতে শুরু করল। লেখালিখির শুরুর দিকে রাইটিং ইজ এ গুড হবি জাতীয় যে় ব্যাপার ছিল রিয়াজুরের, ছিল নিজের নাম ফাটানোর তাগিদ,  তা কেটে গেল। রিয়াজুরের উপলদ্ধি হলো নিজের নামের প্রতি মোহ দশা হ'তে এই যে নির্মোহত্ব, তা লিটল ম্যাগাজিনের জন্যই অর্জন। 
‘কেন লিখি’-ও উত্তরে রিয়াজুর এক জায়গায় বলছেন- ‘‘দেখুন, এই পৃথিবীতে সব কিছুই বড় পুরাতন। সব ঘটনা আগেও ঘটেছে–এখনও হচ্ছে। তাই উচিৎ যা-ই লিখি না কেনো তা যেন হয় স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর এবং মৌলিক বীক্ষণ সম্পন্ন। এবং সমকালকে ছুঁয়ে লেখাটি অবশ্যই স্পর্শ করবে ভবিষ্যৎকে। একটি মর্মমূলে প্রবেশ করে স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর নির্মাণ করার জন্য আমার লেখালেখি।’’
‘স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর’ নির্মাণের এই যে আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ তা একরোখা সৃজনশীল, প্রতিভা দীপ্ত ও পরিশ্রমী একজন লেখকের উপযুক্ত অঙ্গীকারই বটে। নিজের প্রতি কনফিডেন্ট–চিন্তার স্বচ্ছতা, অভিনিবেশ ও গল্পশিল্প নির্মাণের নিবিষ্ট কারিগর তিনি–তাঁর আবির্ভাবকাল আশির দশকে। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ আমাদের কালের অন্যতম নিরীক্ষাপ্রবণ কথাশিল্পী। তাঁর ‘কুসুম কথা অমৃত’ হতে পারত এপিক উপন্যাস বা অন্যভাবে যদি বলি এটি কোনো একরৈখিক সরল কাহিনির মুসাবিদা নয়।
একটি দর্শনকে আত্মস্থ করে তাকে বিন্দু বানিয়ে বিশাল পরিধি তৈরি করলেন। উপন্যাসের শুরুতেই প্রাগৈতিহাসিক উষ্ণতার যে আবহ তৈরি করছিলেন শেষ পর্যন্ত সেই ইউটোপিয়ান প্রেক্ষাপটে থাকেননি। ফোকাস অ্যাডজাস্ট করতে করতে আধুনিক জীবনের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গল্পটাকে পরিণতি দিলেন। পর্ব থেকে পর্বান্তরে শিফটিং করবার সময় কতগুলো জ্ঞানের সিঁড়ি ব্যবহার করেছেন। লোক-সংস্কৃতি, দর্শন, মিথ এবং বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্য ব্যবহার করে অদ্ভুতভাবে উপন্যাসটির নানা শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছেন। গল্পটিকে ধরে রেখেছেন একই সুতোয়, যে দর্শনটিকে তিনি মূল বক্তব্য করেছেন—পাঠকালীন প্রতিটি মুহূর্তে তার আবেশ অনুভূত হয়েছে। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ ‘কুসুম কথা অমৃত’ এরকম একটি উপন্যাস। এর দুটি দিক আছে–এক. এটি হতে পারত অনন্য একটি এপিক উপন্যাস যদি যেভাবে শুরু করেছিলেন সেভাবেই এগিয়ে গিয়ে কল্পনাশ্রিত না দেখা চরিত্র, না দেখা সামাজিক পরিবেশ ও নৃতত্ত্ব নির্ভর সংস্কৃতির পরিমন্ডলে, তাহলে একরকম হতে পারত। দুই. আধুনিক জীবনের জটিল মনস্তত্ত্বনির্ভর। এগুলো হচ্ছে যদি-কিন্তুর কথা। তবে শেষ পর্যন্ত যা হয়েছে তাও অনেক বড় মাপের কাজ–প্রথাসিদ্ধ উপন্যাসের একরৈখিক সরল কাহিনির মুসাবিদা এটি নয়। এই উপন্যাসে রাষ্ট্র যে নারীর বা পুরুষের কারোরই যৌন স্বাধীনতার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি-এই প্রশ্নটিও উত্থাপন করা হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কুসুমের ঘটনা পরম্পরায় আর্ত নিনাদের মধ্য দিয়ে পাঠকের অনেক কিছু ভাবনার অবকাশ রয়ে গেছে। 
লেখক নিজেই জানিয়েছেন,‘‘সুস্থ সতেজ ভরা যৌন সম্বন্ধের পক্ষে সমাজকে প্রস্তুত করার অংশ এই উপন্যাস।’’ সমাজ একটি দুটি লেখাতে পুরোপুরি প্রস্তুত হয় না। কিন্তু দার্শনিক ভাবনায় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে, সহনশীল হতে ইন্ধন জোগায়–অনুপ্রাণিত করে। এই উপন্যাস সেই ক্ষমতা রাখে। ‘কুসুম কথা অমৃত’ উপন্যাসটি রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার বিপরীতে নিঃসন্দেহে সাহসী উপন্যাস। ভাষার তারল্য ও তরল বিষয়বস্তু নিয়ে এই উপন্যাস নয়। পৃথিবী টিকে থাকবে উর্বরতা দিয়ে। প্রকৃতি ও নারী উভয়েই সম-ক্ষমতার এবং  ভূমির উর্বরতা শক্তির অধিকারী। যদি বৃষ্টি না পড়ে, যদি পানি না থাকে একেবারে সেই প্রাগৈতিহাসিক সম সেই দিনগুলোর দিকে যদি তাকাই। কী দেখব? উপন্যাসের শুরুর বর্ণনা : 
 "স্বকালে, বড়ই অকাল পরিলক্ষিত। রুদ্র দাবদাহ; খরতাপ প্রবাহিত; প্রকৃতি নিদারুণ চিৎকৃত। অগ্নি তাপময় বিকট সময় লম্বমান। জ্বলে যাচ্ছে প্রান্তর, বৃক্ষ দগ্ধীভূত হচ্ছে, তাপিত তষ্করের মতো বাতাস তার সেই মসৃণতা পরিত্যাগ করে উদগিরিত-সাপের মতো উদ্যত ফণার আওতায়; গাঢ়, ঘন, অসহ্য তাপ চাবুকের মতো–করছে প্রহার। অবিরত। এমন এক অগ্নিশর্মা প্রকৃতি হতে নিস্তার নিতে যমদূত পর্যন্ত উত্তপ্ত দগ্ধিভূত প্রকৃতি ও পরিবেশ পরিহার করে আপনালোয় স্বর্গের উদ্দেশ্যে পলায়নের জন্য অশেষ যাত্রা আরম্ভ করেছে।
  দিবাশেষেও স্নিগ্ধতা নাই। দিনের সমস্ত উত্তাপ যেন ফুটে ফুটে ঘায়ের মতো রাত্রের শরীরে দগদগে উষ্ণতার সৃষ্টি করেছে। প্রজ্জ্বলিত তারাসমূহ ধিকিধিকি করতে থাকে।"
কাহিনির সূত্রপাতে বর্ণনাত্মক রীতির যে আগাম ইংগিত পাওয়া যায়–পুরো উপন্যাসেই ছন্দপতন  না ঘটিয়ে তা প্রবাহিত হলো। তীব্র উষ্ণতার অবসানে বৃষ্টির জন্য কাতর অপেক্ষা পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে যেভাবে তুলে ধরেছে তার কয়েকটি খন্ড উদাহরণ দিতে চাই। এ থেকে বুঝা যাবে কীভাবে এই উপন্যাসে রিয়াজুরের শব্দ ব্যবহার, বাক্যগঠন ও দর্শনগত চিন্তার সংমিশ্রণ আলাদা সাহিত্যের দিকে আমাদেরকে টানে। একটা কৌতূহলও নীরব উত্তেজনা টানটান বজায় থাকে-আমাদের ভাবনায় ঘুরতে থাকে এরপর কী হয়। কুসুম কী করবে কুসুম কী বলতে চায়! এই উপন্যাসের মূল চরিত্র কার্যত একটাই-কুসুম। যদিও কুসুম উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। কাহিনি বয়ানের বর্ণনাত্মক রীতিতে তাকে আবর্তন করে আছে আরো কটি ছায়া চরিত্র। যেমন:কুসুমের পুত্র রবিন, কুসুমের স্বামী, বান্ধবী পরী, গানের মাস্টার, দোকানদার, গৃহ পরিচারিকা এবং বাবা-মা। খন্ড খন্ড দৃশ্য নির্মাণের সুবিধার্থে লেখক এদের সহায়ক অথচ পরিমিত উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন। 
উপন্যাসের শুরুর দিকের কয়েকটি উপমা ও চিত্রকল্পে নিচে দেওয়া হলো। এগুলো উপন্যাসটিকে সাহিত্যমূল্য দিয়ে রাঙানোর উপাদান। যেমন: 
দিনের সমস্ত উত্তাপ যেন ফুটে ফুটে ঘায়ের মতো রাত্রের শরীরে দগদগে উষ্ণতার সৃষ্টি করেছে। প্রজ্জ্বলিত তারাসমূহ ধিকিধিকি করতে থাকে।
চৈত্র-বৈশাখ মাস; মানুষের ঘাম, সেই ঘামের মধ্যে জমে থাকা যতো লবণাক্ততা–সব যেন টগবগ করছে– ঝলসাচ্ছে।
বন্ধ্যা মেয়ে মানুষের মতো আকাশ-বাতাস, সেখানে কোনো বৃষ্টির সংকেত নাই। জলবতী মেঘের কোনো লেশ নাই; কেবল উপস্থিতি, জলশূন্য মেঘের। খালি কলসের মতো মেঘ বৃষ্টিকে নামিয়ে আনতে পারে না প্রকৃতি।……
…রাত বিরেতে দেখা যায় পরিষ্কার আসমানে নৌকার মতো বাঁকানো চাঁদ। জলের মতো ভেসে যাওয়া চাঁদের আলোয় ধাঁধাময়। জ্যোৎস্নার জলের চাঁদের আলোর ভেতর দিয়ে ভাসমান নৌকার মতো মেঘ দৃশ্যপটে সম্পূর্ণত উধাও। 
মেঘ পাল তুলে আছে না। বৈঠা বেয়ে মেঘ ভাসতে ভাসতে চলে না। কেবল ক্রিয়াশীল উত্তাপ প্রকৃতিতে প্রবল প্রতাপে থাকে ক্রীড়ারত। 
শরীর জুড়ে পুঁতির মালার মতো স্বেদ-বিন্দু জ্যোৎস্নার আলোক বিস্তারে কোনো জ্বলজ্বল, উজ্জ্বল রূপে ধরা দেয় না। ক্লেদ বাড়ায়। গ্রীষ্মের অগ্নিময় ক্রোধাগ্নিতে বৃষ্টির জন্য, এক ফোঁটা নিজেকে বাঁচানোর আকুলতায় নিরঙ্কুশ প্রার্থনায় নতজানু বিধ্বস্ত মানুষ। প্রার্থনা-বৃষ্টির অদর্শন, বৃষ্টির ধ্যান ভাঙাতে পারে না; উছলিয়া পরিপ‚র্ণ হয় না বৃষ্টিধারা। উত্থিত হয় না প্রথম বৃষ্টিতে মাটির সোঁদা গন্ধ।….
….মায়ের বুক শুকিয়ে গেছে। শুষ্ক হয়েছে দুগ্ধধারা। মায়ের দুগ্ধের ফেনা শিশুকে তৃষ্ণায়, ক্ষুধায় কোনো আশ্বাস দেয় না। শিশুরা মরে যায়। মাতৃক্রোড়ে শিশুর নিস্তেজ শরীর।….
’কুসুম কথা অমৃত’-এর শুরুতে যে বিরাট পটভূমির ইশারা ছিল, খানিক পরেই তার পরিসর সংকুচিত হয়ে নির্দিষ্ট ফোকাস জোনে তা চলে আসে। এই ফোকাস জোন খরা কবলিত বাংলা। নদীমাতৃক বাংলাকে লেখক তখন এভাবেই দৃশ্যপটে আনলেন এবং আনলেন শহরকে। 

"মা ভুলে গেছে শিশুকে দুগ্ধপান করার অভিজ্ঞতা।
ফসলের মাঠ জুড়ে শুধু বৃষ্টির জন্য আহাজারি।
প্রতারক বৃষ্টি। পলাতক বৃষ্টি। খুনি বৃষ্টি।
বৃষ্টি যেন আর নামবে না নদীমাতৃক বাংলায়।
গৈ গেরামে এখন বৃষ্টি ছাড়া আর কোনো বিষয়ে সংলাপ নাই।…….."
"…..মানুষ স্বপ্নে দেখে এই বর্ষায় যেন মোষের পিঠে কাক রমন করছে। তার মানে এই তো যে নির্ঘাৎ মৃত্যু হচ্ছে বজ্রপাতে। তাই যেন খালের ধারে প্রকান্ড গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে যে হারুঘোষ দাঁড়াইছিল, আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন। হারু ঝলসিয়া পুড়িয়া গেল। জগৎটি তাহার চোখের পলকে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।…'

…"..আর শহরে, বৃষ্টি শুধু হয়ে আছে স্মৃতি। আকাশের কোনো কান্না নাই। বৃষ্টির কোনো ঢল নাই। রাস্তাঘাট শুকনা খটখটে। ভাপ ছড়াচ্ছে কংক্রীটের দালান। শহরে বৃষ্টি এক উৎপীড়ন, তবু বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা, বৃষ্টি এলে শহর জুড়াবে। শহর একাকার হয় না বৃষ্টিতে। মানুষ বৃষ্টির জন্য আকাশে তাকায়। আকাশ চোখ রাঙায়। মানুষ দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে। সব জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে।"
কুসুম এই শহরের নারী চরিত্র, শহরেই বসবাস তার। আধুনিক জীবনযাপন ও যৌনতার জটিল মনস্তত্ত্বের কিছু দৃশ্যায়ন সেখানে তৈরি হবে। পরে তাঁকে নিয়েই এগোতে থাকবে চরিত্রাভিমুখি কাহিনি। গ্রাম এবং শহর যখন উপন্যাসের দৃশ্যপটে জায়গা করে নিল, তখনই কাহিনিতে সংযুক্ত হলো–নারী ও পুরুষ। বৃষ্টির সঙ্গে তাঁদের বেঁচে থাকার দূরত্বের ক্লাসিক বর্ণনা আমরা এ সময় পেয়ে যাই, পেয়ে যাই বিভিন্ন পারিপাার্শ্বিকতার কিছু তুলনা। কাব্যিক বোধের এই উপমা-প্রধান চিত্রকল্পগুলো আমাদের বোধকে আবেশ-দোলনায় নিয়ে রাখে। অস্তিত্ব বিনাশী যে ভয়ংকর চিত্র এসময় আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয় এবং আমরা দেখতে পাই–তা সভ্যতার মর্মমূলকে কাঁপিয়ে দেয়। প্রকৃতির কাছ থেকে বৃষ্টির নিবৃত্তি এবং নারীর রজঃশ্রাবের নিবৃত্তির ভয়ংকর দূর-কল্পনা সভ্যতার জন্য অভিশপ্ত মুহূর্ত! জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলা মানুষ কীরকম অসহায় অবস্থায় পতিত হতে পারে এই চিত্র সেই নিরূপায় ও অক্ষম সময়ের চিত্র। নারী ও পুরুষ তীব্র গরমে শুকিয়ে কাষ্ঠবৎ চিত্রকল্পে রূপান্তরিত হয়। এই সকল দৃশ্যসমূহ শস্য ও প্রজনন রহিত কল্পিত দুঃস্বপ্নের–একমাত্র উর্বরতাই পারে এই দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে জীবনের আনন্দকে ফুটিয়ে তুলতে। যেমন-

এমনই এক বুক দূরত্বকে লালন করে পরাজিত দুইজন নারী ও পুরুষ, শয্যায় ঘর্মাক্ত কলরবে নিজেদের সব ইচ্ছের মৃত্যু বাজিয়ে মৃত মানুষের মতো শায়িত। ক্ষুধিত ও ব্যয়িত তারা। তারা অশেষ কাতর। এই দূরত্বের মধ্যে দোর্দন্ড এক সাপ ফণা তুলে হিসহিস করছে আর সেই সাপের দৃষ্টি ক্রোধোজ্জ্বল। নিঃশ্বাসে আগুনবাতাস। 
... মানুষ দুটো ঘামের লবণ মাখা দুইটা ভাস্কর্য। আর খটখটে। বৃক্ষ মরে গেলে নিষ্পত্র কাঠখন্ড যেন এখন তারা।.. 
….এই ঘামে, পিচ্ছিলতার মধ্যে তারা মিলিত হতে পারে না।.. 

….ঘাড় মটকানোর জন্য উপস্থিত যেন প্রলয় দূত অতএব বৃষ্টি নিবৃত্তি-বৃষ্টি পড়ে না ফোঁটায় ফোঁটায়, জল পড়ে না–পাতা নড়ে না;

 ..এই নিবৃত্তি রজঃস্রাবেও, শরীরের ঋতুচক্র স্তব্ধ হয়ে শরীরের ভেতরেই আরেক দেহ –মৃত আর তাই স্তব্ধ, আর কোনো দিন নারীটি উম্মোচন করতে পারবে না মাতৃদ্বার, দুগ্ধভারে নত হবে না স্তন যুগল। কোনো শিশু কচি দাঁত, ওষ্ঠ মাড়ি দিয়ে সংঘর্ষ করবে না স্তনের মহিমা। টেনে নেবে না দুগ্ধধারা।…

…অতএব এক যে ছিল দেশ। যে দেশে ভ‚মি, মৃত্তিকা এবং নারীটি একই সঙ্গে অকস্মাৎ নিষ্ফলা।…

এই হলো ‘কুসুম কথা অমৃত’ উপন্যাসে প্রারম্ভিক বন্ধ্যা সময়ের মূল ছবি। এখান থেকেই উপন্যাসে লেখকের অন্বিষ্ট মূল ফিলসফি তৈরি হতে লাগল–তার নাম ফার্টিলিটি বা উর্বরতা। প্রকৃতি ও নারীই যার জন্য ক্ষেত্রমতো সম ক্ষমতা সম্পন্ন। এখান থেকেই গল্পের বিস্তার ঘটতে শুরু করল।  কাহিনির মধ্যে তথ্য, তত্ত্ব ও দর্শনের সংমিশ্রণে পর্যায়ক্রমে যে মূল বক্তব্য তৈরির বা স্থাপনের চেষ্টা দেখি, তা হলো উর্বরতা, ফলন ও জীবনের প্রবহমানতা। সেজন্য ফিলার স্টেটমেন্ট হিসেবে পাওয়া গেল-

…নারীর কাছে জিজ্ঞাসা; বলো মা, বর্ষা নেমেছে কবে?
উত্তর মেলে না।
শেষ মাসিক কবে হয়েছে মা?
উত্তর মেলে না।…

এই পর্যায়ে এসে যৌনতা ও শরীরের বিমানবিকীকরণ এবং শাকম্ভরী তথা ধর্মপুরাণের সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনীয়তার সংযোগ ঘটতে শুরু হলো। কাহিনির এই পর্যায়ে এসে এখনো পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রকে আমরা পাইনি। বর্ণনায়, ভিক্টোরিয়ান যুগে যৌনতা পর্যবসিত হলো আনন্দহীন ক্রিয়াকলাপে.. এই তথ্যটি দেওয়া হলো। বলা হলো যৌনতা সম্পর্কে এ সময় পরিলক্ষিত হয় এক অসাধারণ নিস্তব্ধতা। শারীরিক শ্রমের সঙ্গে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও শাকম্ভরী তথা দেবী দুর্গার পক্ষ থেকে প্রাণদায়িনী শাকশব্জির জোগান এবং বাৎসায়নের ‘আহারাদি সমান ধর্ম্ম ঐ অর্থেও ফল কাম’এরকম তত্ত্ব ও তথ্যের আবির্ভাব পাওয়া গেল। যা উপন্যাসের মূল দার্শনিক অভিপ্রায়কে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা দিতে ব্যবহার করা হয়েছে। নিচে যে তথ্য বা তত্ত্ব উল্লেখ করা হলো, তারই সমানুপাতিক একাধিক সম্পূরক দৃশ্য কাহিনির মধ্যে নির্মিত হয়ে আছে। এরকম কয়েকটি তথ্য:
…আদিতে সভ্যতার কেন্দ্রের ব্যক্তির সামগ্রিক জীব প্রক্রিয়ার অন্যতম ছিল যৌনতা। কাম ও প্রজনন ছিল আশ্রম ধর্মের অঙ্গ। পুরুষের শুক্রকে বলা হয় ‘বীজ’ আর নারীর গর্ভরসকে ‘আর্তব’। পুরুষ ‘বীজ’ বপন করে নারীর গর্ভে বা ক্ষেত্রে।
পাশ্চাত্য সেকসুয়ালিটির ডিসকোর্স আবিষ্কারের আগে যৌনতার উন্মোচন ও প্রয়োগ ছিল না অদৃশ্য।
সাড়ে তিন হাজার বৎসর আগে প্রথম সূর্যের উদ্ভাসে সুন্দরী উষার যে অভিসারিকা মূর্তি, তার মধ্যেই শৃঙ্গার চেতনার প্রথম উদ্ভাস।…
…কামকে যদি স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা হয়, তাহলে ভবিষ্যতেও সেগুলো মনের মধ্যে ক্রিয়া করবে এবং স্তব্ধ তাড়নায় উন্মাদ, অবসাদ রোগের সৃষ্টি করবে।… 
…বৈবাহিক দাম্পত্য ছাড়াও আছে আরও দুইটা রতি-স্থান : বেশ্যা আর বিধবা।…
…নারীর মধ্যে মায়ের স্নেহ, দাসীর কর্মকুশলতা, বিপদে মন্ত্রণাদাতার ভূমিকার পাশাপাশি শয্যায় বেশ্যার মতো প্রগলভ আচরণও কিন্তু কাম্যবস্তু। কিন্তু যেন গার্হ্যস্থ ব্রত আর রতি বিলাস এক কথা নয়।… 
…চিৎ হয়ে শুলে স্তন খাড়া ও সুন্দর দেখাবে কিন্তু চলাফেরা কিংবা উপবিষ্ট অবস্থায় স্তন ঝুলতে থাকবে। স্তনের এই অবস্থা হওয়ার পরও কৃত্রিমভাবে স্তনকে উন্নত ও পুষ্ট দেখাবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।…

…যৌন ক্রিয়াকে বাজারের মেয়েরা শিল্পে রূপ দিয়েছে।… 

…অবৈধতা বা বৈধতা নয়, যৌনতার মূল ভিত্তি গাঁথা আছে অপ্রাপ্যতার মধ্যে। বৈবাহিক প্রেমে যদিবা যৌনতার উন্মোচন হয়েও থাকে, যৌনতার প্রধান কেন্দ্র কিন্তু পরকীয়তায়, কেননা সেখানে বাধা আছে, চুরি আছে, লুকানো আছে, ধরা পড়ার শঙ্কা আছে। শঙ্কাহীন প্রেমের মধ্যে যৌনতার মাধুর্য পরিস্ফুট হয় না। পরকীয়া প্রেমের মধ্যে এই যে চৌর্যরীতির জয়গান, যৌনতা সেখানে পরিপূর্ণ প্রকার পায়।…

…মানুষ যৌনতা আবিষ্কার করেছে প্রজননের তোয়াক্কা না করে শুধু যৌনতার আনন্দের জন্য যৌনতায়।….

… নেই দেহভান্ডে তা নাই ব্রহ্মান্ডে।দেহই সকল সত্যের আবাসস্থল, বিশ্বের যা কিছু রহস্য তা দৈহিক ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত।…

এ ধরনের তথ্যের আকছার ব্যবহারের মধ্যে খুড়ি ও ভাসুরপোর মধ্যে একটি যৌনালাপের ইশারাধর্মী গল্পাংশ ব্যবহৃত হয়েছে উপন্যাসে, যা নির্মাণ রীতির দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। লেখকের নিজস্ব থট প্রসেস অনুযায়ী উপন্যাস এগিয়েছে। অনিবার্যভাবেই তাতে জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন ফর্মের উপস্থিতি। কাহিনির মধ্যে এরকম উপ- দৃশ্যের উদ্ধৃতি ব্যবহার বহুল প্রচলিত না হলেও নতুন নয়। আসলে যৌনতার রহস্যময় আবরণের ভিতরে নির্দোষ রঙ্গ-রসিকতা যেমন থাকে তেমনি থাকতে পারে বিপৎজনক উসকানি। নিচে একটি উদ্ধৃতির ব্যবহার লক্ষযোগ্য—
...বাবু সকালে প্রস্তুত হইয়া খুড়ীর বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। খুড়ীও নিভৃত স্থানে ভাসুরপোর আহারের স্থান করিয়া রাখিয়াছিলেন। ভাসুরপো আসিবামাত্র তাহাকে সেই ঘরে বসাইয়া জলখাবার দিলেন তাহাতে জলপানকালেই বাবু একখানি শসা হস্তে করিয়া কহিলেন, খুড়ী, শসা বড় উত্তম ফল, কাটিয়া কেন নষ্ট করিয়াছ, আস্ত থাকিলেই ভাল হইত, খুড়ীও খেলিতে ২ ধাড়ী হইয়াছেন কিনা, অমনি উত্তর দিলেন, অগো, তুমি যে আস্ত শসা ভালোবাস আমি তাহা জানিতাম না আর একটা আস্ত শসা আনিয়া দিব কি?

বাবু : দিলে হানি নাই। গোড়া অবদি মোটা হইয়া আগা ছোটা হয় অথচ গায়ে কাঁটা না থাকে এবং ঠিক সোজা শসা যদি পাই তবে তোমার মায়ের নিকট পাঠাইয়া দি, আমি ভালবাসি না বাসি তিনি অবশ্য ভালোবাসিবেন।

খুড়ী : আমার মাতা বৃদ্ধা হইয়াছেন, শসা গ্রহণ করিতে পারেন না বরং তোমার বউয়ের কাছে পাঠাইয়া দিলে উচিত দান হইবে।

বাবু : খুড়ী, বউকে এমনিতে যে শসা দিয়াছি তাহাতেই তার বশ আছে, সে আর শসা চায় না, তোমাকে যদি তেমন শসা দি তবে তুমিও  বলিবে যে পরম পদার্থ পাইয়াছি।

খুড়ী : সে শসা কোথায় হইয়াছিল।

বাবু : আমার নীলবাগানে। যদি খুড়ী তুমি সে বাগানে যাও তবে আর আসিতে চাহিবে না, আমাদিগের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর অনেক স্ত্রীলোক সে বাগান দেখিতে গিয়াছিলেন তাহারা দেখিয়া আশ্চর্য জ্ঞান করিয়াছেন। খুড়ী, নির্লজ্জ হইয়া তোমাকে বলিতেছি আমার বাগানে ভোজবিদ্যা নির্ম্মিত এক খাট আছে তাহাতে আলস্য রাখিলে যুবতী বৃদ্ধা যেমন কেন স্ত্রীলোক হয়েন না তাহার শরীর হইতে জল ঝরঝর করিয়া পড়িয়া বিছানা ভাসিয়া যায়, এমন সুখের খাট আর কোথাও নাই...

দুই. প্রথম মানুষ এবং আগুনের জন্ম

মানুষ আসবার অনেক আগে পৃথিবীর জন্ম হয়েছে। পৃথিবী যখন প্রাগৈতিহাসিক কালের উত্তপ্ত অবস্থা থেকে ঠান্ডা হলো–মনুষ্যবসতির উপযুক্ত হলো, তখনই ‘কুসুম কথা অমৃত’ উপন্যাসে পৃথিবীর প্রথম মানুষটিকে জন্ম নিতে দেখা গেল। লেখক সেই মুহূর্তটার বর্ণনা করলেন–

আদিতে সূর্য ছিল না, না ছিল কোনো নক্ষত্রমালা। চারদিকে আঁধার, শুধু পানি আর পানি চারদিকে তখন। চারদিক আঁকাবাঁকা জলময়। তারপর হঠাৎ রাত আলোকিত হলো একদিন চাঁদের আলোয়। সবদিক আলোকিত হলো ক্রমে। সূর্যের তাপে জল শুকোতে আরম্ভ করল–ডাঙা জেগে উঠল–পৃথিবীতে এলো প্রথম মানুষ।

একা এই মানুষটির কোনো সঙ্গী নেই। চারপাশে জল-জঙ্গল। কষ্টেসৃষ্টে রাতদিন কাটে। কার সঙ্গে কথা বলবে-কেউ নেই। শীতে কষ্ট পায়–পৃথিবীতে আগুন আসেনি। উলঙ্গ দেহে পোশাক নেই। একদিন সে স্বপ্ন দেখছিল। হঠাৎ চোখ মেলে দেখে -‘‘সামনে দাঁড়ানো এক নারী। বস্ত্রহীন নারীটি মেঘের কোল থেকে নরম রোদ্দুরে নেমে এল এই বাংলায়।’’ এক হলো তারা। এক হয়ে কী করতে হয় তারা জানত না। বনের মধ্যে শয্যা পেতে তারা অজ্ঞাত ধরনের কিছু একটা করে বসল–
‘‘যোনিদ্বারে পুরুষের শিশ্নের আঘাতে, ঘর্ষণে মন্থনে-ঘর্ষণে দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। নারীটির যৌনাঙ্গ থেকে যে আগুন ছড়িয়েছিল চারিদিকে তা থেকে সেই আগুনই পৃথিবীর সব মানুষের জন্য আগুনের হলো উপলক্ষ্য। সকল মানুষের ভাগ্যে জুটল তবে আগুন।’’
কী সুন্দর বর্ণনা তৈরি হয়েছে আদিম বিশ্বাস ও লোক সংস্কৃতির উপাদানকে ঘিরে। এই আগুন মানুষের স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলল। নারীর তলপেট থেকে উৎসারিত আগুন পেয়েছে মানুষ। খাবার দরকার, রুক্ষ প্রান্তরে ফসল ফলাতে হবে। নারী নগ্ন, ঋতুমতি। কোনো এক সূর্যাস্তের সময় নারী শুয়ে পড়ল জমিতে। জমি কাদামাটি হয়ে ওঠে- পাল্টে যায়। একদিন পুরুষ অবাক হয়ে দেখে সোনালি ফসল–এই শস্য মানুষ বাঁচাবে। মানুষ এই আগুন হারালো একদিন। কোনো এক রাতের অন্ধকারে পুরুষ নারী শরীরে ধাবিত হয়,-পরে দেখা যায় ভাইবোন মিলিত হয়েছে। অপমানে বোন ভাইকে তাড়া করে। বোনের হাত থেকে মশাল মাটিতে পড়ে নিভে যায়–আগুন আবার বিদায় নিল চিরতরে। আদিকালের মতো আবার অন্ধকার যুগ ফিরে এল। এবার লেখক স্মরণ করিয়ে দিলেন বিজ্ঞানের মতে–
 ‘‘বিবর্তনে স্ত্রীজাতির উদ্ভব ঘটেছে আগে–তারপর এসেছে পুরুষ।… বিবর্তনের প্রয়োজনে অন্যান্য প্রজাতির মতো মানব প্রজাতিতে ইভের প্রয়োজন হয় আদমের; 
–উপরের গল্পের মতো নয়–ইভের প্রয়োজনীয় পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে ভালো ‘জিন’ বিনিময় করে সে জন্ম দেয় উত্তম প্রজাতির মানব। ...মানব প্রজাতির ক্ষেত্রে ‘ইভ’ বা স্ত্রীলিঙ্গের প্রায় ১৮,০০০ বৎসর পরে এসেছিল পুরুষ লিঙ্গ বা আদম। ’’
এই বাংলায় উত্তরের এক জনপদের কথা। অমাবশ্যার রাতে বৃষ্টির দেবতা হুদুমাকে তুষ্ট করতে গান গেয়ে চলেছে নগ্ন ও বিবস্ত্র একদল নারী। । তারা প্রতীক্ষা করে, নাচে-গায়। হুদুমার সঙ্গে দেখা হলে কেবল তারা জলধারায় নির্বাপিত হবে। অতঃপর বৃষ্টি, জমিতে হবে ফসল–স্ত্রীরা গর্ভবতী হবে–প্রচুর বাচ্চা প্রসব করবে গৃহপালিত পশুসকল। প্রচলিত এই লোক সংস্কৃতিতে নারী ও প্রকৃতি একাকার। গানের অংশ:
হিল হিলায়ছে কোমরটা মোর
শির শিরায়ছে গাও
কোন্ঠে কি না গেইলে এলা
হুদুমার দ্যাখা পাঁও।

তিন. কুসুমের ভালোবাসার চার স্তর : প্রেম, স্পর্শ, আলিঙ্গন ও রতি

এখান থেকেই ’কুসুম কথা অমৃত’ আঙ্গিক ও বিন্যাসের দিক থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে বাঁক নেয়। এতক্ষণ যা ছিল ধ্রুপদীতুল্য ও আচ্ছাদিত, এখানে তা রূপ নেয় চরিত্র নির্ভর সুনির্দিষ্ট কাহিনির বিস্তার বা আখ্যানে। শুরু থেকে যে উর্বরতা বা উর্বরাশক্তির দার্শনিক অভিপ্রায়কে লেখক তিল তিল শ্রম দিয়ে নির্মাণ করেছিলেন; এই পর্বে স্বাধীন যৌনসত্তাকে সঙ্গী করে ভিন্ন ডাইমেনশন যুক্ত করলেন। বাক্য বিন্যাসে গতিময়তা পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক নগর জীবনের ’কুসুম’ নামের বিধবা এক অসুখী নারীর জটিল মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন বিচিত্র উপায়ে প্রবাহিত হতে থাকে। ভালোবাসার চার স্তর : প্রেম, স্পর্শ, আলিঙ্গন ও রতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার ভিতর দিয়ে কুসুমের বিচরণ চারপাশকে জীবন্ত করে রাখে।
অব্যবহিত পূর্বের অংশে যেখানে ন্যারেশনের মধ্য দিয়ে উপন্যাস এগিয়েছে-পার্ট টাইম ছায়া চরিত্র ছাড়া কাহিনিতে গল্পের জন্য নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রের উপস্থিতি ছিল না। প্রতীক, রূপক, তুলনা এবং দর্শনের সংমিশ্রণে একটা ভাবাবেশের উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বক্তব্য-প্রধান আঙ্গিকে উপন্যাসকে এগিয়ে নেওয়া হয়-এ জায়গায় এসে হঠাৎই তা মোড় নেয়। এই পর্বান্তর সংঘটনের জন্য ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে আনার কৌশল ব্যবহার করা হয়। বলা হয়-রাত এখন অনেক। ঘরের মধ্যে বেজে চলেছে ’বেশ্যা সংগীত’। মনে মনে ধাক্কা খেতে হয়। সংগীত অনেক প্রকারের হয়; কিন্তু ’বেশ্যা সংগীত’ কেন'? এ গান শ্রবণের সাথে সাথে কুসুমের মনে জেগে উঠেছে দেহসম্ভোগের স্মৃতি। ক্যাসেটের ফিতায় গান বাজে। ফিতা জড়িয়ে জড়িয়ে যায়-ফিতায় বাজে পতিতার মর্মকথা। এজন্যই কি রিয়াজুর একে বেশ্যা সংগীত বলেছেন? এর অল্প আগেই বেজেছিল যৌন তৃষ্ণাতুর এক ঠুমরি। ক্যাসেটের ফিতা জড়িয়ে গান মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছিল। লেখক বর্ণনা দিচ্ছেন 
'এভাবে চক্রাকারে আবর্তিত ফিতাকে দ্রুত কয়েকবার আগের বাদনের গানের মতো দ্রুততার সঙ্গে আবর্তিত করে আবার সুইচ টিপে যেন স্তনবৃন্তে চাপ প্রযুক্ত করলে বদ্ধ সংগীত স্ফূর্তিতে সুরময় করে তুলবে এই রাত্রি।’
কুসুম রাত্রিবেলায় নিজের বাসায় এই গান শুনছিল। প্রতি রাতেই শোনে। গান শোনাটা তার নিঃসঙ্গ জীবনের  যৌন তৃপ্তি মেটানোর একটা উপায়। এই মিথস্ক্রিয়ার অসাধারণ বর্ণনা পাওয়া যায় উপন্যাসে। কুসুম যখন একটার পর একটা গান শুনছিল;তার মাথার কোষে কোষে বিদ্যুৎ ছড়াচ্ছিল, মাথা আর কাজ করছিল না, তখন চুম্বকের মতো টেনে রাখার মতো একটা বই হাতে নেয় সে। বান্ধবী পরির ধার দেওয়া বই। কতগুলো আন্ডারলাইন করা অংশ সে বারবার পড়ে। এই বইটা তাকে পর্নোগ্রাফি পাঠের আনন্দ দেয়। আন্ডার লাইন করা অংশে বর্ণিত হাই সোসাইটি পরিবারের পিতা-কন্যার সেক্সুয়াল ইমোশানকে কি ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্সের নির্দয় উদাহরণ বলা যাবে?  

…শ্রী সুজয়কে জড়িয়ে নিচ্ছে। সে অস্থির। অসংযত। বলছে: আমাকে নাও, আমি আর পারছি না।

সুজয় : জামা পরো শ্রী। আমি পাগল হয়ে যাব।

শ্রী : আমি পাগল হয়ে আছি বাপি। তুমি বলেছিলে ভালবাসবে। বলেছিলে, আচ্ছা, সরাসরি না পারলে ইউজ ইয়োর ফিংগার। ইটস্ নাথিং বাট এন এক্সক্রিশন। ওটা না হলে আমার পাগল পাগল লাগে। মাম আমাকে বলছে, সাপ্রেশন ইজ মোর ডেনজারাস এন্ড শি টট মি বাই ফিংগারিং; বাপি, বা সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রী-র গলা টিপে ধরেছেন। বলেছেন: তুই আর তোর মা এই পৃথিবীর ময়লা।...
পরি বইটি পড়তে দেওয়ার সময় তাকে বলেছিল-‘‘তোর ছেলে রবিন এবার কোন ক্লাশে যেন ও-হো, ও তো বিবিএ পড়ছে। তোর ছেলেটোর দিকে আমি মাঝে মাঝে একটা যুবতী নারীর চোখ দিয়ে দেখি। আমি বুঝতে পারি, আমারও একসক্রিশন হয়ে যাবে।’’ কুসুমের রাগ ওঠে কিন্তু কিছু বলে না। কুসুমের হাতে বই; সে গান শুনতে থাকে লেখকের বর্ণনায়–
‘‘সংগীত তাকে অথবা সে সংগীতকে অথবা দুইজনে দুইজনকে প্রবল আকর্ষণে সম্ভোগ করে। এই সম্ভোগ করতে করতে, সংগীতের মধ্যে লিপ্ত হয়ে, অবগাহনে, নিজেকে উজার করে আলোকিত হবার ফলে যোনিদেশে কোমলভাব ধারণ ও আলোড়নের ফলে রতিলাভ তার ঘটছে অজস্রবার।"
একই ঘটনার প্রভাবে কুসুমের মধ্যে ইডিপাস কমপ্লেক্স প্রকাশ পায়। কুসুম গান শুনতে শুনতে পুত্র রবিনকে অনুভব করে। এবং পাশেই রবিনের আলাদা ঘরে চলে যায়। মাতা-পুত্রের মধ্যে কিছু কথাও হয়। রবিন মায়ের কোলে মাথা রেখে খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে মায়ের আদর নিল। লেখক বর্ণনা দিয়েছেন–‘সে মুখ নামিয়ে রবিনের কপালে চুমু এঁকে দিল আর তাতে তার স্তন যুগল রবিনের শরীরাংশ কোমলতায় ডুবিয়ে ফেলল। সে তখন আরও বিস্ময়ে অনুভব করল তার স্তন বেয়ে একটি নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে।’ আর রবিনের কী হলো? ‘রবিনের ভেতরটা একবারের জন্য হলেও কাঁপতে থাকল। কুসুম অনুভব করতে পারল যেন সেই কম্পনের মাত্রা। মা ও ছেলে কিছুক্ষণ উদাস হয়ে থাকল যেন।’
কুসুম সংগীতকে ভোগ করে। সংগীত কুসুমকে ‘ভালোবাসার চার স্তর : প্রেম, স্পর্শ, আলিঙ্গন ও রতি, তার নির্জন কক্ষময় ধ্বনি ব্যঞ্জনায়–সুর মূর্ছনায় সত্যিকার ভালোবাসার পর্যায়ক্রমিক উন্মোচন What is love? -এর সন্ধান দিত।…
...অজস্রবার অসংখ্য উপায়ে সংগীতের ভেতর দিয়ে সুখানুভূতি চরমভাবে অনুভব করেছে কুসুম। শরীর বেয়ে যে ঘাম ঝরা তারই সঙ্গে রতিস্খলন হয়ে গেছে সংগীত বাদ্যের যৌন আশ্লেষে, মন্থনের আবেগে এইভাবে অনেকবার। সংগীত তাকে যৌনানন্দ শেষে পরম তৃপ্তি দিয়েছে অনেকবার।’

চার. বসন্ত চলে গেছে-কুসুমের শীতকাল

শরীর আর মন -এই দুটো বৈশিষ্ট্য নিয়েই মানুষ। ‘কুসুম কথা অমৃত’ উপন্যাসটিতে নির্মাণ কৌশলের অংশ হিসেবে একাধিক চিত্রনাট্যের সংযুক্তি ‘কুসুম’ চরিত্রটিকে স্বতন্ত্র গল্পের প্রেক্ষাপটে উপস্থিত করেছে। সেখানে দেখছি:

দৃশ্য। স্থান কুসুমদের বাড়ির উঠান।
সময় রাত।

(দূরে কোথায় ঝিঁঝি ডাকে। পোকার করকর শোনা যায়। ব্যাঙ ডাকে। রাত বাড়ছে। গাছে বাতাস লেগে শব্দ উঠছে, সরসর সরসর। ঘন জ্যোৎস্নায় চারপাশ রহস্যময়।)
কুসুম : এমনি চাঁদনি রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয়।
শশী : চুপ, চুপ কর বউ।
কুসুম : (গাঢ় বিশ্বাস ফেলে) আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন?
শশী : শরীর, শরীর! তোমার মন নাই কুসুম।
          মাথার উপর গাছের পাতায় পাতা ঘসার শব্দ হচ্ছে। সরসর সরসর।

৪৭ বছর বয়সি কুসুমের মনটা যেন এক শরীর। ‘ভাবতে ভাবতে সে স্বীকার করে নিতে বাধ্য যে, কামনা, অভিলাষ আর মিথুন ভাবনার প্রকাশও স্বাধীন হওয়া উচিৎ।’ কুসুমের বসন্ত চলে গেছে। কুসুম বুঝি প্রকৃতিকন্যা বা কোনো এক প্রাগৈতিহাসিক নারী। কুসুমের শরীরের এখন আর লাল দিবস নেই- থেমে গেছে ঋতু। আছে শুধু রক্তের স্মৃতি। পনেরো বছর বয়সে হঠাৎ যার সূচনা– ভয়, ব্যথা, লজ্জা ও অস্থিরতায় সময় কেটেছে। হঠাৎ নতুন উপলদ্ধিতে জগৎকে দেখতে পাওয়া সবই ছিল বিস্ময়কর। সে বলতে পারত কোন মাসের কোন তারিখটি হতে পারে রক্তদিবস? উৎফুল্ল হয়ে লক্ষ্য করতে লাগল শরীরময় পরিবর্তন–‘নিতম্ব তুলনামূলক স্ফীত, স্তন বিকাশ-উন্মুখ, যৌন প্রদেশে রোমবাজি ঘনবদ্ধ। পাতলা মেদ শরীরে সঞ্চিত হয়ে, হালকা ওজনও বৃদ্ধি পেয়েছিল বেশ। স্ফীত স্তনে কেমন যেন একটা সুখবোধ।’ ১৫/১৬ বৎসর বয়সে পাড়ার রত্না নামের সমবয়সি মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব জমে ওঠে। রত্নার কাছ থেকে কুসুম অনেক কিছু প্রথম শিখেছে। বেড়ে উঠবার বেলায় কৈশোরে মায়ের কাছে অনেক বকাঝকা শুনেছিল বুকে ওড়না না রাখার জন্য। স্কুল বন্ধের এক দুপুরে স্তনের সুখানন্দ অনুভব করেছিল– যখন রত্না ও কুসুম একে অপরের স্তন স্পর্শ করেছিল। নতুন অনুভূতিতে কেঁপে উঠেছিল শরীর। আহ! অনাবৃত স্তন রূপ নিয়ে তাকিয়েছিল অভিবাদন গ্রহণের জন্য। স্পর্শন-মর্দন-চোষণ ছিল পরের ঘটনা। বান্ধবীর  কাছ থেকে স্ব-মেহনের প্রথম হাতে খড়ি। সব মিলিয়ে নিজস্ব যৌন অভিমত গড়ে ওঠে। কুসুম বিচলিত হয়ে ভাবে 
রাষ্ট্র কখনো স্বাধীন যৌনতার পক্ষে কথা বলে না। রাষ্ট্রের আইন সব সময়ে ধর্ষককে সুরক্ষা দেয়। এ নিয়ে তার কিছু পর্যবেক্ষণ গড়ে ওঠে। কুসুমের চিন্তাকে এইভাবে উপন্যাসে এগিয়ে নেওয়া হয় –‘‘রাষ্ট্র সুরক্ষার নামে আত্মকাম হতে অসম কাম পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে যৌনতার স্বাধীন সত্তাকে অপমান করেছে। নিবর্তন করেছে। হত্যা করেছে। রাষ্ট্র নিজেকে অযৌন প্রমাণ করতে চেয়েছে কিন্তু নারীর পণ্যায়ন প্রতিহত করতে পারে নাই। কোনো নারী যদি সচেতনে নিজের শরীরকে পণ্য করতে আগ্রহী হয় তবে সেই অধিকারও নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের।.

..রাষ্ট্র কখনো যৌন রসিক না হলেও রাধা-কৃষ্ণের ব্যক্তি-সত্তা প্রকাশে কবিরা অনেক বেশি মানবিক, সামাজিক ও যৌনরসিক বলেই হয়তো রাষ্ট্রের কাঠামোতে কবিদের নির্বাসনের প্রস্তাব ছিল একদা। 
শশী ডাক্তারের মতো রাষ্ট্র সামনে এসে কুসুমকে শাসিয়ে বলেছিল, শরীর। শরীর। 
তোমার মন নাই কুসুম।
তখন অন্তরাত্মা সুরেশের মতো বলে উঠেছিল, মানুষের মন বলে স্বতন্ত্র কোনো একটি বস্তু নেই। যা আছে, তা এই দেহটারই ধর্ম। 
কুসুমের পুরো জীবনই নারী হিসেবে বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে কেটেছে। যশোরে ঘটনাচক্রে প্রথম রতিদান, আড়াল থেকে মিলন দৃশ্য দেখা , বান্ধবীর সঙ্গে উষ্ণ আলিঙ্গনবদ্ধ হওয়ায় উরু সন্ধি অকস্মাৎ ভিজে পিচ্ছিল হওয়া নানান কিছু।
 কুসুমের বিয়ে এবং বিচ্ছেদ দুটোই ঘটে। কুসুমের মনে হয়েছে–‘রাষ্ট্র ক্ষুধা বোঝে সেক্স বোঝে না।’ কুসুম যৌন ধারণা লাভ করেছে রত্নার কাছ থেকে শুনে শুনে। কুসুমের ত্রিশোর্ধ স্বামীর অসংযত অভ্যাসের খেসারত ছিল হিসেবে স্বামীর সঙ্গে অর্গাজমের তুমুল স্বাদ গ্রহণ করা হয়ে ওঠেনি। অবিলম্বে মাথা ব্যথা, ক্রোধ, হতাশা, অবসাদ ও উদ্যোগহীন মনোভাব তার সঙ্গী হয়েছিল। স্বামীর গৃহপরিচারিকার সঙ্গে গোপন অভিসার কুসুমকে আঘাত দিয়েছিল। কুসুমের কানে বাজে কাজের চাকরানিটার কথা। ধরা পড়বার পর সে গলা ফাটিয়ে বলেছিল, ‘ক্ষ্যামতা নাই, খালি চুদুরবুদুর, বউয়ের কাছে যাইতে পারেন না, কাল থেইক্যা থাকুম না।’ কুসুম বদলে যায়। স্বামীর মৃত্যু হয়-"তারপর কুসুম নিঃসঙ্গতার যৌনতায়, ক্রমশঃ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।’ কুসুমের জীবনে সংগীত দারুণ ভূমিকা  রাখে। যেমন–
'"সংগীত তাকে মুক্তি দিয়েছিল যে স্বাদ পায়নি কখনো আগে।… সংগীত তাকে প্রেরণাদায়িনী ও যৌন অভিলাষের নিত্য সহচরী হয়ে তাকে প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের বিপরীতে এইভাবে সাহস যুগিয়েছে মাটি কামড়ে দাঁড়াবার। দাঁড়িয়ে থাকে কুসুম; বেঁচে থাকে আর মৃত্যুর মতো সংগীতকে আঁকড়ে ধরবার খুব ভালো একটা সিদ্ধান্ত তাকে স্বস্তির তকমা দিয়েছে অনায়াসে। আত্মরতি, প্রেম ও নিজের স্তন দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে অর্জন করে নিয়েছে নির্জনতা, আয়ত্ত্ব করেছে অনুশাসন অতিরেক এই প্রকার যৌনতা। একটি হলো শরীর-জীবসত্তা-অনুশাসন-প্রতিষ্ঠান এবং অন্যটি হলো জৈব প্রক্রিয়া –নিয়ন্ত্রণমূলক কলাকৌশল-রাষ্ট্র, যা সব সে ইচ্ছা মতো গ্রহণ-বর্জন করেছে তাচ্ছিল্যে।
সংগীতের মধ্য দিয়ে সে অর্জন করেছে আবার যৌনতাকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। এই বিশ্লেষণ তাকে স্বপ্ন নির্মাণ করতে শেখায় এবং স্বপ্নকে বাস্তবে পাল্টে দিতে। যৌন অধিকারের লড়াইটা শেষ পর্যন্ত বিপ্লবের মতো প্রদীপ্ত।’
পুরুষ চরিতার্থ করার গুরু দায় নিয়ে নারীকে অর্গাজমের ভান করে যেতে হলেও নারী নিজের কাছে নিজের এই সমস্যা বিমুক্ত।"
কুসুমও সংগীতের শক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে -গান শেখে।  লেখকের বর্ণনায় সেই প্রাপ্তিটুকু উঠে আসে এভাবে–
 ‘কুসুম যে গান গায়, সংগীত গুরুর তালিম দেয়া সুরের জাদু লুফে নিয়ে আত্মস্থ প্রাণে সেই গান গাইতে গাইতে গানের তরী ভাসিয়ে সাত -সমুদ্র অতিক্রম করতে করতে, সম্মোহিত ও বিমোহিত, নির্বাক সে এক অমোঘ নিয়তির চুম্বক টানে স্থানান্তর ঘটে যায় নিজের। কত দিন পুরুষের হাতে তার শরীরে লেখা হয় নাই কোনো কিছু, এই বোধ তাকে অচিন এক রাগিনী করে তোলে।’ 

পাঁচ. বাবা-মার ছায়ায় এবং কুসুমের পুরোনো এন্ট্রি

কুসুম তার শৈশব-কেশোর পেরিয়ে বাবা-মায়ের কথা ভাবে। মাকে লেখা বাবার পুরোনো চিঠিগুলো তাঁকে আন্দোলিত করে। সে ভাবতে থাকে –
আমি থাকব। আমি থাকব।
I want to live,I want to live…
…"কুসুমের বাদামী মলাটের একান্ত ব্যক্তিগত খেরো খাতায় অনেক হিজিবিজি লেখার ভিড়ে একটা এন্ট্রি পাওয়া গিয়েছিল–তারিখবিহীন লেখা, লেখাটা অনেক আগের, ধরা যাক সমস্যাটা তখন কেবল দানা বাঁধছিল, সেই সময়ে সে লিখেছিল: তখন আমি জাস্ট ৪০ পেরিয়েছি। লক্ষ্য করতাম মাঝে মাঝেই মুডের পরিবর্তন, এক রকমের জ্বালা এবং অনিয়মিত পিরিয়ড হতো। বুঝতে পারিনি কি ঘটতে চলেছে। শুনেছিলাম, মেয়েদের এই সমস্যার সমাধান করে সুন্দর জীবনদান করতে পারে মেনোপজ বিশেষজ্ঞরা।
চেষ্টা করছি, পারবো না বোধ হয়।"

ছয়. বহুদিন পর...

এই উপন্যাসের বড় শক্তি লেখকের কলম। প্রচলিত গল্প-উপন্যাসের মতো চরিত্রের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। পুরোটাই বর্ণনাত্মক রীতিতে লেখা। মনে হচ্ছিল কেউ ধারা জীবন্ত ধারাবর্ণনা রেখে গেছে-কিন্তু, উত্তম পুরুষে নয়। কুসুম ছাড়া তেমন সক্রিয় চরিত্রও নেই। পুরো ক্যানভাসে কিছু ছায়া চরিত্র বা ফ্ল্যাশব্যাক ক্যারেক্টারের ঘটনা বর্ণনার সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটেছে। কাহিনির প্রয়োজনে যখনই অনুভব করেছেন তখনই উদ্ধৃতি হিসেবে বিভিন্ন গল্পাংশ, গান, কবিতা বা চিত্রনাট্য অনায়াসে ব্যবহার করেছেন এগুলো –সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ নিজস্ব চিন্তাভাবনা অনুযায়ী এই অসাধারণ উপন্যাসটি লিখেছেন। শব্দ নির্বাচন, ভাষা নির্মাণ এবং দার্শনিক অভিপ্রায় সংমিশ্রণে লেখকের আন্তরিকতা ও সংযম শ্রদ্ধা বিস্ময় উদ্রেক করেছে। আমাদের সময়ে অন্যতম সেরা উপন্যাস। 

‘কুসুম কথা অমৃত’ হতে পারত এপিক উপন্যাস বা একরৈখিক সরল কাহিনির মুসাবিদা নয় উর্বরতা ও স্বাধীন যৌনসত্তা যাচনা
শেখ ফিরোজ আহমদ

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : শেখ ফিরোজ আহমদ
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : শেখ ফিরোজ আহমদ
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের উপন্যাস ‌'কুসুম কথা অমৃত' প্রসঙ্গে শেখ ফিরোজ আহমদের প্রবন্ধ।
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s16000/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s72-c/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/11/kusum-kotha-amrito-article-shekh-firoz-ahmed.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/11/kusum-kotha-amrito-article-shekh-firoz-ahmed.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy