.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

শুরু কিংবা অবসান │ছোটগল্প│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ

অতর্কিতে বুলেটের শব্দ ও বারুদের গন্ধ।
নিক্ষিপ্ত গুলির তীব্র শব্দ, মুহুর্মুহু।
দিক্চক্রবাল পরিভ্রমণরত কাকদের কা কা কা ডাকাডাকি, রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরদের ঘেউ ঘেউ ঘেউ চিৎকারে সরব চতুর্দিক। 
নিক্ষিপ্ত গুলিতে আমাদের মগজ বেরিয়ে পড়ে করোটি বিচূর্ণ হয়ে—কলিজা ছিঁড়ে যায় বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে—চোখ বীভৎস হয় অক্ষিকোটর বিস্ফারিত হয়ে...। আমরা লুটিয়ে পড়ি।
প্রাণহীন দেহ আমাদের অতপর।
কালো রাস্তায় জমাট রক্ত ক্রমে কালচে...

দুই.
আমাদের শহরে সুরম্য অট্টালিকার সুন্দর জানালাগুলির কপাট এখন সশব্দে বন্ধ।
সুরক্ষিত এইসব অট্টালিকার প্রধান ফটক হতে কোন সুহাসিনী নারী ও রম্য পুরুষ ফাল্গুনের হাওয়ায় হাওয়ায় রাস্তায় বেড়াতে যায় না। 

দেবশিশুদের কলরব-হুল্লোড়-ক্রীড়া ও অপসৃত দালানকোঠার বারান্দায় সুন্দর মুখশ্রী মিলিয়মান। 
 নাই কোথাও উচ্চারণ, নাই মুচ্ছর্ণা।

তিন.
রাস্তায় যান চলাচল করছিল, হঠাৎ সব উধাও। যে মানুষেরা ঘরে ফিরতে ও বাইরে যেতে পথে ছিল ;অল্প সময়ের ব্যবধানে সকলে এখন উধাও।
সব রাস্তা ফাঁকা। ফাল্গুনের দমকা হাওয়ার নাচে ঝরাপাতার ওড়াওড়ি। টুকরা-টুকরা কাগজ নানাদিকে উড়ে-উড়ে ঘুরে-ঘুরে চলে। 

হাওয়ার দাপটে স্তব্ধ রাস্তায় ধুলার ঘূর্ণি পাক খায় বিষণ্নভাবে।
রাস্তাটা সব হারিয়ে খাঁ খাঁ খাঁ করতে থাকে।

চার.
দিনের আলো ক্রমে মরে আসে।
সন্ধ্যায় অন্ধকার তাড়া দেয়। 
গুটিয়ে যায় দিন।
ঘষা কাঁচের ভেতর দিয়ে প্রতিসরিত আলো। এই আলো ছায়াহীন, কায়াহীন।
নিভু নিভু। এমন আলোতে ভূত দেখা যায়। বাড়িগুলো ভূতের মতো, গাছপালা ভূতের মতো, আকাশের মেঘ ভূতের মতো, লাইটপোস্ট ভূতের মতো... এবং ভূতের মতো এই শহরটা। 

পাঁচ.
ভূতুড়ে এই শহরে হঠাৎ অনিবার্য এক শিশুর জন্ম হয়। শিশুটা জরায়ু ছিঁড়ে ভূতের‚মতো বেরিয়ে কান্না শুরু করে।
মরে স্তব্ধ  হয়ে যায় শিশুটা।
শিশুটার যখন নাভি কাটা হয়, পদ্মফুলের মতো নাভিটা তাকিয়ে থাকে, শিশুটার চোখের সম্মুখে কোনও আকার থাকে না, মা তার আঁচলে শিশুটির নাক-মুখ চাপা দিল, ভূতুড়ে একটা বাতাস শ্বাসপথে প্রবেশ করল—মরা বাতাস
খানিকক্ষণ খামচাল শিশুটা তারপর
যম নিল দম।

ছয়.
দিনের আলো মরে লাশ।
এলোমেলো বাতাসে রঙিন জামা ওড়ে না, শাড়ির আঁচল ওড়ে নাই। কোথাও কেউ নাই কেবল ঘূর্ণিবাতাস সজোরে ধাক্কা খায়
ঘূর্ণি খায় বাতাস 
হা হা করে অট্টহাসে বাতাস... পাক খায় বাতাস
শহরের ছবিটাকে বাতাস নাড়া দিয়ে যায়, টলোমল করে শহর
কোনও শব্দ নাই, বাতাসে চিকন দীর্ঘশ্বাস কেবল,
বাতাসের পাগলামিতে এবার হাহাকার বুক চাপড়ে ওঠে,
বেগতিক বাতাস ক্রমে ফিসফিস করে ওঠে,
বাতাস... ভূতগ্রস্ত ... অন্ধকার
ক্রমে বাতাসে, অস্পষ্ট চাপা কান্না। বাতাস কান্নায় গুমরে ওঠে।
একফোঁটা জল গড়িয়ে-গড়িয়ে পড়ে—এই ফাল্গুনে।
আলো মিলিয়ে গেলে, জ্যোৎস্না হয় জল। জলে জ্যোৎস্না একটা কান্নার মতো। জ্যোৎস্না আকাশে-বাতাসে আহাজারির মতো ছড়িয়ে পড়ে—মেখে যায় চারিদিকে—
বাতাসের পাগলামিতে হাত ধরাধরি করে জ্যোৎস্না তিরতির কাঁপে।

সাত.
টলোমল শহর,
তিরতির কাঁপাকাঁপা জ্যোৎস্না;
উদ্দাম বাতাস–
আর কতিপয় লাশ, নিথর —
মানুষের লুটানো দেহ।
সহসা বাতাসের ঝাপ্টায় হানা দেয় ঘ্রাণমণ্ডলে এক লহমা সুবাস।

আতরওয়ালার শিশি হতে প্রাচীন এক গন্ধ
উড়ে এসে পালিয়ে যায় আবার।
আতরমাখা বাতাস মৃত মানুষের আশেপাশে প্রদক্ষিণ করে বিদায় অতপর।

আট.
আলো মুছে যাওয়ার পর আকাশে অন্ধকারে নক্ষত্র সমাবেশ।
ঝাঁকে-ঝাঁকে জ্বলজ্বলে সব নক্ষত্র পাহারা দিয়ে রেখেছে চাঁদকে। সেই চাঁদ, বুড়ি চাঁদ—কবিতার চাঁদ, চাঁদের গল্প...।
উজ্জ্বল আলোয় ভরপুর চাঁদ, সঙ্গী নক্ষত্রপুঞ্জ দেদারসে আলো বিতরণ করে–
আলো, চাঁদের। আলো, নক্ষত্রের।
সব আলো জড়ো হয়ে বেড়াতে আসে পৃথিবীর বুকে...
আকাশের নিজস্ব আলো, ফকফকা জ্যোৎস্না এই ফাল্গুনের রাতে উঁকি দেয় আমাদের শহরে—বিজন বেজান শহর রূপালি আলোতে রহস্যময় তখন। আলোছায়ায় শহরটা নেশাগ্রস্ত।
শহরে আলো ও ছায়া, তাই ছায়া ছায়া শহর
শহরটা এখন উদাম, ছায়া রমণ করে আলো বিছিয়ে শহরটাকে।
বাতাসে শীৎকার শীষ দিয়ে যায়।
অতএব শহরে অতপর আলো ছায়ার কারুকাজ আর নেপথ্যে শোনা যায়  শব্দসঙ্গীত বেশুমার। 

নয়.
ঘর্ঘর! ঘর্ঘর! ঘর্ঘর!
দূর হতে ভেসে আসে শব্দের এই জটিল বিন্যাস।
ক্রমে স্পষ্টতর দূর হতে আগত অতপর নিকটতর ঘর্ঘর ঘর্ঘর শব্দ—একটানা শুধুমাত্র
কত শব্দ আসে আবার হারিয়ে যায় কিন্তু এই শব্দ হারায় না।
ভূতুড়ে একটা লরি রাস্তার মাথায় এসে থামে। শব্দও থামে।
লরিটার আর্তনাদ এতক্ষণ চরাচরব্যাপী জ্যোৎস্নার মাখন ছুরি দিয়ে কেটে ভাগ ভাগ করে রাখে
যদিও শব্দটা—যান্ত্রিক দানবীয় ঘর্ঘরধ্বনি থামল অথবা চলল তবু মস্তিষ্কের কোষে-কোষে প্রোথিত এই বিকট ধ্বনি—নীরব শহরের প্রেক্ষাপটে ধ্বনির এই ধড়মড়—মস্তিষ্কের ভিতর ঢুকে যাওয়ার পর লরির স্টার্ট বন্ধ হলেও ঘর্ঘর গান শোনা যায় টানা তারপরও।
শহরের অপ্রকাশ্য মানুষদের খুলির গহ্বরে এই ধ্বনি  তখনও অস্তিত্বময়—অতএব লরি যেন থামে না।
রাস্তার মাথায় দাঁড়ানো এই লরিটার দিকে তাকিয়ে থাকে শহরের দালানকোঠা, নিষ্পত্র বৃক্ষ, ফাল্গুনের বাতাস, মায়াবি জ্যোৎস্না ও শূন্য নিঝুম সড়ক—অপলক দৃষ্টিতে বিদ্ধ হয় লরিটা রাস্তায় এখন। 
দেখা যায় : জ্যোৎস্নালোকে ছায়াময় কয়েকটা মানুষ ট্রাক লরিটার ভিতর হতে টপ টপ করে নেমে দাঁড়াল সড়কপ্রান্তে।
ওদের একজন হাতের জ্বলন্ত সিগ্রেটের অংশ সজোরে নিক্ষেপ করলে– আগুনের ফুলকি।
লোকগুলো এবার কিছুক্ষণ স্থির।
বাতাস বয়ে চলে। রাশি- রাশি ঝরাপাতা বাতাসের টানে ঘুরপাক খায়।
এই ফাল্গুনের পূর্ণিমায় মানুষগুলো অন্যমনস্ক আর এলোমেলো থাকে কতক্ষণ,
সময় যায়। মানুষগুলোর শরীর বাতাসে দুলে ওঠে। ফাল্গুনের বাতাসে ঢেউ বারবার।
লোকগুলো দলবদ্ধ। সদলবলে পা চালিয়ে সামনে।
ঋজু—ত্রস্ত—তড়িৎ-পা ফেলা। সামনে চলে আসে মানুষগুলো।
নিকটবর্তী হয়ে একযোগে দাঁড়ায়। শরীর নড়ে না। স্থির-পর্যবেক্ষণ করে সম্মুখে নিবিড়।
কোনও নাই শব্দটুকু এতক্ষণ—সহসা চারদিকের নীরবতা টুকরা হয়ে গর্জে উঠে লরিটার ইঞ্জিন—ঝাঁকুনি দিয়ে সচল হয়... কালো পিচের সড়কে মন্থর গতিতে শব্দ তুলে মানুষগুলোর পেছনে এসে থরথর করে কাঁপতে থাকে লরিটা। লরির হেডলাইটের ঝাঁঝালো আলো সম্মুখ ভাগ ধাঁধিয়ে দেয়।
গাড়িটার ইঞ্জিন বন্ধ ও হেডলাইট নিভে গেলে এতক্ষন ধাঁধানো আলোর  মধ্যে ইতস্তত, বিক্ষিপ্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকা গুঁড়া মাথা, কলজে উপড়ানো– গলিত চোখের লাশ হয়ে যাওয়া নিথর শরীরগুলো চন্দ্রালোকিত আদরে পুনরায় ডুবে যায়—মুখ গুঁজে পড়ে থাকে আবার।
ফাল্গুনের এই রাতে তারাভরা আকাশে চাঁদ উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছে জ্যোৎস্না; কোনও রমণী—মৃতদের মা-বোন-বধূ আলোকময় চুল ছড়িয়ে এক উথাল-পাথাল কান্নায় শোকাচ্ছন্ন বিদায় এবং একটানা ক্রন্দন করে চলেছে।
জ্যোৎস্নাার কান্না থামে না। হঠাৎ একটুকরা মেঘ দেখা গেল জ্যোৎস্না উদ্ভাসিত আকাশে।
হাওয়ার ধাক্কায় চলন্ত মেঘের উড়ান। চাঁদটাকে আর স্থির মনে হয় না। গতিশীল মনে হয় চাঁদটাকে।
মেঘটা দৌড়ে এসে সহসা চাঁদের মুখ চেপে ধরে—আড়াল তৈরি করে—চাঁদের মুখ ঢেকে যায় মেঘে। চাঁদ চাপা পড়ে যায় মেঘে। চাঁদ এখন মেঘময়।
মেঘের কাছে চাঁদ বন্দি হলে চারদিকে তখন ঘোলাটে এক ছবি। 
অস্পষ্ট লোকগুলো নড়াচড়া করে ওঠে। তৎপর হয় ওরা। একটা একটা করে এ-যাবত সড়কে থুবড়ে থাকা মৃতদের দিকে হাত বাড়ায় জ্যান্ত এই ভূতুড়ে মানুষ।
ওদের দায়িত্ব —লাশ গুম করার আগে নিয়ে যেতে হবে এক জায়গায়—ওদেরকে বলা হয়েছে যেমন।
অপসৃত জ্যোৎস্নায় নিহত চাঁদের নিচে নিঝুম সড়কে অতপর একপাল মানুষ মৃতদের নিয়ে হয়ে ওঠে তৎপর।
জ্যান্ত মানুষের দল, কালো পিচের সড়কে বিক্ষিপ্ত ছড়ান-ছিটান-লুটান ছিটকান মগজ, খুবলান চোখ, তোবড়ান কলিজা—গুলিতে নিহতদের মৃত্যুর এই নাম-নিশানা-চিহ্ন বিলোপ করে নিরুদ্দেশ যাত্রায় রওনা দেয়।
লরিতে ভর্তি হওয়া মৃত আর জ্যান্ত মানুষের দল সড়ক সীমানা ত্যাগ করে নৈঃশব্দে মিলিয়মান।
মেঘবন্দি চাঁদ আবার উন্মোচিত হয় এবং অতপর জ্যোৎস্না স্বাভাবিক—ভূত কেটে গেছে।

দশ.
পাঠক, বিরতি গ্রহণ করি স্বল্প সময়।
পণ্যের প্রচারে দেদার বিজ্ঞাপন আয়োজন নয়—নীরবতার এই বিরতি।
পাঠক, অবস্থান করুন...

এগার.
আবদুল আওয়াল ঘুমের ভিতর দাদীজানকে কবরে শোয়ানোর যুদ্ধ করে চলেছে। এই ঘনঘোর আষাঢ়ের এক বিকালবেলায় কবরের জন্য মাটি খুঁড়তে কোদাল চালাতে মাটি ভেদ করে রাশি রাশি পানি উপচে আসছে। সামাল দেয়া যাচ্ছে না, —প্রিয় নাতি সে। দাদীজানের জন্য কবরে মাটির জায়গা জোটানোর এক তীব্র লড়াইয়ে শরীর জুড়ে তার ঘামের স্রোত।
সে হাউমাউ করে কাঁদে আর চিল্লায়। 
তারপর ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে। ভেজা শরীর আর ভেজা দুই চোখ নিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরলো ক্রিং ক্রিং  বেজে চলা সেলফোনটা  রিসিভার করল

হ্যালো, জনাব। এখনই আপনাকে চলে আসতে হবে। সময় নাই বেশি।
এখন অনেক রাত। এত রাতে ঘরের বাইরে...
গাড়ি পাঠানো হচ্ছে।
কি দরকার!!
অবাক হচ্ছেন কেন? এখানে এলে দেখতে পাবেন সবই। গেট রেডি কুইক!
তবু? ... আহ্ ... তবু? ... আহ্ ...
আচ্ছা বলছি। আমার হাতে অনেক লাশ। কয়েকটা লাশের মগজ কালেক্ট করতে হবে। তারপর মগজ বাদে লাশগুলো কবরে পুঁতে ফেলা হবে। আপনার কাজ হবে মগজ কালেক্ট করে আপনার আবিষ্কৃত মেশিন চালিয়ে এই মানুষগুলোর স্মৃতি বের করে চারদিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পেশ।
ভূতুরে ফোন তবে ফিরে এল।

বার.
সারারাত কাশতে কাশতে প্রহর চলে যায়। নিজে ঘুমায় না সে। অন্যকেও ঘুমাতে দেয় না। এমনিভাবে কাশির মহড়া আর নিদ্রাহীন তার জেগে থাকা।
ফাল্গুনের হাওয়া। নাকি জ্যোৎস্নাময় প্রকৃতি। উস্কে দেয় কোনটা---কে জানে!
 ফুসফুসের মধ্যে ঝড়;ফুসফুস তোলপাড় করে কাশির দমক ওঠে।
কাশির দমক বুকের হাপরে সজোরে ধাক্কা দেয়। মনে হয়, বুক ভেঙে যাবে।
কাশতে থাকে যখন, মুখ দিয়ে গ্যাজলা বের হয়ে ফেনা ওঠে।
শরীর চুরমার করে কাশির কলরোল কখনও পরিশ্রান্ত হলে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে পরক্ষণে ফের কাশির দোর্দণ্ড প্রতাপে শরীরে ঝাঁকুনি ওঠে। নুয়েপড়া শরীরে মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা জাগে

কাশেম বুড়া চোখের সামনে দেখে : নিজের মড়া নিজে গোসল করাচ্ছে। মড়া গোসল করিয়ে সে খায় –তার পেশা মড়া গোসল। এই কাজে সে ডাক পেলে  গোসল দিয়ে আসে এবং ফেরার সময় জোটে টাকা।
এই পেশা ছিল তার বাবার। বাবা মরে গেলে কতদিন ধরে এই কাজ করে যাচ্ছে সে মনে পড়ে না। আঙুলে কররেখা গুণতে গিয়ে আর দাগ পায় না—এই পেশায় প্রাচীন সে।
কাশেম বুড়া আবার দেখে : নিজের শরীরটা লাশের খাটিয়ায় সটান। মরার পর শরীরে ওজন ভর করে। নড়াতে-চড়াতে কষ্ট। 
একটা হালাল সাবান; কাফনের কাপড়; কর্পূরের কয়েকটা টুকরা; নীল প্লাস্টিকের  বোতলে গোলাপজল, আগরবাতির কাঠি—যাবতীয় এইসব নিজের জন্য নিজে জোগাড় করে এনেছে। একটা এ্যালুমিনিয়মের পাতিলে আছে গরম পানি।
চারদিক নিজ হাতে চাদর দিয়ে ঘিরে ফেলে পরম মমতায় গোসল দেয়।
হঠাৎ টের পায় উদ্গত কান্না।
বুকের মধ্যে পানি ঢালতে-ঢালতে বলে কলিজাটা ঠাণ্ডা হোক।
নিজেকে কাফনে মুড়িয়ে নাকের ফুটায় তুলা গুঁজে মাথা আর পায়ের কাছে গিঠ দিয়ে খাটিয়ায় নিজেকে শোয়ানোর পর আগরবাতি জ্বালাতেই কে যেন তাকে হরণ করে।
কাফনের কাপড় খুলে হ্যাঁচকা এক টান দিয়ে বলে : যেতে হবে।
কাফনের কাপড় উন্মোচিত হলে উলঙ্গ সে, উজবুকের মতো সামনে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে —কোনও জনমনিষ্যি নজরে আসে না—কেবল তাড়া করে কণ্ঠস্বর। বড় শীতল উচ্চারণ।
অনেক লাশ। সময় নাই। রাত পোহাবার আগে সব মৃতদের যত সংক্ষিপ্তই হোক গোসল দিয়ে কবর খোদকদের হাতে লাশ দিতে হবে। 

তের.
একেকজন মানুষের হলুদাভ মগজ কাঁচের স্বচ্ছ জারে টাটকা রাখার জন্য রাসায়নিক দ্রব্যে ডুবিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মগজ বিশ্লেষণ করে দেখা হবে;একটা যন্ত্র উদ্ধার করবে মগজের মধ্যে লুকানো স্মৃতির সম্ভার—মগজের কোষে ভাঁজে ভাঁজে চাপা পড়ে আছে মানুষের সুবর্ণ স্মৃতি।
মগজে  রক্ষিত কাঁচের জার হতে স্টিলের চামচে উঠিয়ে আয়তাকার কাঁচে লেপ্টে দিয়েপ্রতিটার পেছনে মার্কার কলম দিয়ে ‘মৃতজন ১, ২, ৩ ...’ এইভাবে চিহ্নিতকরণ চলে।
যে যন্ত্রটায় কাজ হবে, একটা চৌকো মনিটরের সঙ্গে তা যুক্ত রয়েছে। এই মনিটরে সংকেত ভেসে ওঠে এবং যে একটি প্রিন্টার এই যন্ত্রের অংশ–সেখানে স্মৃতির সংকেতসমূহ মুদ্রণযোগ্য।
যে সংকেত অনুবাদ করা যায় না, তখন স্মৃতি লুপ্ত থেকে যায়। উদ্ধার হয় না কখনও। স্মৃতি অপ্রকাশের আহাজারি উদ্যত হয় তখন কেবল; স্মৃতিধর সংকেত গুমরে ওঠে না। যন্ত্রের ভেতর নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে মগজের নমুনা  চালান দিলে —যন্ত্রটা কঁকিয়ে উঠে মনিটরে ভেসে উঠবে অবিরাম স্মৃতির সংকেত। এই সংকেত অনূদিত হলে প্রকাশিত হবে মস্তিষ্কের ভেতর মগজের কোষে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির ঠিকানা এবং আভাসিত হবে এর মধ্য দিয়ে লোকটা।
স্মৃতিরা জাগ্রত হয়, গুঞ্জন করে ওঠে, স্মৃতির মধ্যে জমায়েত হয় অজস্র ঘটনা। কত চরিত্র, কত বিবরণ—সংকেত পাঠায় একাদিক্রমে। প্রিন্টার সংকেত মুদ্রণ করে কাগজে। 
এই যে সংকেতগুচ্ছ—কোনটা সংকেত স্পষ্ট কোনোটা-বা আবছায়া আবার কোনও সংকেত অনুবাদে অস্পষ্ট। অনবরত স্মৃতিচারণার সঙ্গে সংকেতেরও বিরাম নাই। সংকেত ভাঙলে তাজা স্মৃতির উৎক্ষেপ তখন। 
স্মৃতির মধ্যে অজস্র মানুষ—ইতিকথা তাঁদের, যেহেতু হৃদয়ে স্মৃতির সমাবেশ।
তাজ্জব করা শক্তি স্মৃতির যে, ফাল্গুনের আরেক পূর্ণিমা রাতে উথাল-পাথাল বাতাসে অলৌকিক সড়কে বিস্মৃতি হতে জীবন্ত মানুষরা সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। মানুষের পুনর্জন্ম ঘটে গেল কোনও অলক্ষে।
একেকজন মানুষ এখন একেকটা সময়;এইসকল মানুষ এবং মানুষকে ধারণ করা বিভিন্ন সময়-কালকে যৌগিক রূপ দিলে খুঁজে পাওয়া যাবে অখন্ড মানুষ।
বাংলার নিজস্ব স্মৃতিকথার পাণ্ডুলিপিসমূহের সংরক্ষণ করবার আয়োজন বড় চমৎকার। সময়ের সন্তান এইসব মানুষের স্মৃতির মধ্যে বসবাসরত নানান চরিত্র ও সংঘটিত ঘটনা এবং যাবতীয় বিবরণ বাংলা নামের এই দেশের আত্মস্মৃতির পাঠ। 

চৌদ্দ.
ফাল্গুনের আরেকটি রাত। এখন নিশুতি।
হঠাৎ বৃষ্টিপাত। বড় অসময়ে—বৃষ্টির আঘাতে মাটির ভেজা-ভেজা প্রথম ঘ্রাণ তাই প্রকৃতিতে। ঝরা বৃষ্টিতে মাটির গন্ধমাখা এমন সময়ে বারিধারার সঙ্গে কম্পিউটারের কীবোর্ডে এবার সচল আঙুলের দ্রুততম সঞ্চালন। আবদুল আওয়াল নায়কদের নায়ক। 
ইতিহাস শুধু অতীত ঘটনা কিংবা সাল তারিখ কিংবা তাম্রলিপি বা শিলালিপির সমাহার নয়। যে মানুষ ভবিষ্যতে বেঁচে থাকবে, অতীত তাদের কেমন ছিল? 

কে-না জানে প্রকৃত অতীত হয়ে উঠতে পারে ইতিহাসের প্রকৃত ভিত্তি।
ইতিহাসের চালিকা শক্তি হিসেবে সাধারণ মানুষের শ্রম-চেষ্টা-কল্পনা ও ধ্যানের মূল্যায়ন হয় নাই। ইতিহাসের আসল উপাদান সাধারণ মানুষ বাদ পড়ে গেছে।
আবদুল আওয়ালের কাজ নয় ঐতিহাসিকের। তবু ফাল্গুনের এমন এক রাত্রিতে বৃষ্টি ও মাটির গন্ধ তাকে দিয়ে, ভূতগ্রস্তের মতো লিখিয়ে নিল কতিপয় অজ্ঞাতনামা নিহত মানুষের স্মৃতির উত্তাপে শেষ পর্যন্ত দেশটার এই আত্মকথা –ইতিহাসের এক নামান্তর;নতুন এক মানবিক ইতিহাসের দলিল!
সাধারণ মানুষ—স্বপ্ন সৃষ্টি আর স্বপ্ন ভাঙার দ্বৈরথে বিজয়ী গণমানুষ এখন বাংলার ইতিহাসের নায়ক। 
আবদুল আওয়াল হরফের পর হরফ সাজিয়ে যায়...
বাইরে এখনও অঝোর বৃষ্টি, তার ভেতরটাও বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে ওঠে। মাটির সোঁদা গন্ধ আলিঙ্গন করে রাখে তাকে।
একটা বন্দুকের কালো নল হঠাৎ উদ্যত।
সহসা গুলির শব্দ।
কাফনের কাপড় পরাবে বলে কাশেম বুড়া এসে হ্যাঁচকা টান মারে।
এই ভঙ্গ বঙ্গদেশে অতপর পাঠ বাকি থেকে যায়।
কাশেম বুড়া ক্রমাগত কাশে। অশক্ত শরীরে কাঁপতে থাকে বেশুমার।
রাতকানা কবরখোদক বৃষ্টিভেজা মাটিতে সাড়ে তিন হাত একটা শয্যা প্রস্তুত করে কোদাল হাতে ঝিমায় আর ভোরের জন্য অপেক্ষা করে।

পনের.
একটি বীজ রোপিত হবে। প্রকৃত সন্তান কখনও মৃত হয় না–রূপান্তরিত বীজ হয়ে যায়।
এই বীজ বৃক্ষ দান করে।
কারণ, বৃক্ষহীন দেশে মানুষ বাঁচে না।

বৃষ্টিভেজা আবহাওয়াতে নির্বোধ একটি কুকুর ডাকে রাস্তায়। 

শুরু কিংবা অবসান
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ 

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: শুরু কিংবা অবসান │ছোটগল্প│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
শুরু কিংবা অবসান │ছোটগল্প│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s16000/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s72-c/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashid-short-story-suru-kinba-abosan.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashid-short-story-suru-kinba-abosan.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy